ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও জোরপূর্বক কলেজছাত্রীকে বিয়ে
ওসি মিজানকে বাঁচাতে মরিয়া তদন্ত কমিটি
প্রকাশ: রবিবার, ২৩ জুন, ২০২৪, ১:০৩ এএম  (ভিজিট : ৯৩২)
অনেক অপকর্মের জন্ম দেওয়া গাজীপুরের জয়দেবপুর থানার এক সময়ের অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সৈয়দ মিজানুর ইসলামকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। অভিযোগ রয়েছে, স্ত্রী-সন্তান থাকা সত্ত্বেও এক কলেজছাত্রীকে ভুয়া কাবিননামায় জোরপূর্বক বিয়ের পর গাজীপুরের একটি রিসোর্টে রেখে দীর্ঘদিন শারীরিক সম্পর্ক চালিয়ে যান তার সঙ্গে। এক পর্যায়ে ওই তরুণীকে হত্যার পরিকল্পনা করেন তিনি। এ অভিযোগে ওই তরুণী আইজিপি ও জেলা পুলিশ সুপার বরাবর একটি অভিযোগ দেন।

অভিযোগের তদন্তকারী প্রধান কর্মকর্তা গাজীপুর জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সানোয়ার হোসেন। তদন্ত কমিটি ওসির বিরুদ্ধে কোনো শাস্তির সুপারিশ না করেই গত এপ্রিল মাসে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে গোপনে প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় ভুক্তভোগী নারী সংসার করছেন এবং তাকে ভরণপোষণ দেওয়া হয় বলেও উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে ওসিকে বাঁচানোর বিষয়টি বুঝতে পেরে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স ফের তদন্তের নির্দেশ দেয়।

পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স সূত্র জানায়, সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী একজন সরকারি কর্মকর্তার নৈতিক স্খলনজনিত ঘটনা গুরুদণ্ড অপরাধের শামিল। এ ধরনের অপরাধের শাস্তি বাধ্যতামূলক অবসর, চাকরি থেকে অব্যাহতি, স্থায়ীভাবে বহিষ্কার এবং সর্বনিম্ন দণ্ড নিম্নপদে পদাবনতি। ওসি মিজান একজন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা। কিন্তু প্রতিবেদনে ওসি মিজানের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের শাস্তির সুপারিশ না থাকায় তা তদন্তের জন্য ফেরত পাঠানো হয়েছে বলে ওই সূত্র জানায়।

ওসি সৈয়দ মিজানুর ইসলামের দ্বিতীয় স্ত্রী ওই কলেজছাত্রী সময়ের আলোকে বলেন, ওসি মিজান প্রথমে ভুয়া রেজিস্ট্রি বিয়ে করে দুই মাস সংসার করার পর গাজীপুরের রিসোর্টে এনে বিয়ে অস্বীকার করেন। ফিরে যেতে জোরজবরদস্তি করেন। এক পর্যায়ে ভাড়াটে সন্ত্রাসী দিয়ে রিসোর্টের ভেতর তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন ওসি মিজান। ওই সন্ত্রাসীরা দরজা খুলতে বলেন এবং এক পর্যায়ে দরজা ভেঙে প্রবেশের চেষ্টা করেন। পরে উপায় না পেয়ে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল করে পুলিশের সাহায্য চাই। খবর পেয়ে ডিবি পুলিশ উদ্ধার করে আমাকে গাজীপুরের পুলিশ সুপারের কাছে নিয়ে যায়। আমি তার কাছে সব জানিয়ে লিখিত অভিযোগ করি। তিনি ন্যায়বিচারের আশ্বাস দেন। কিন্তু বিচার না করে উল্টো বাঁচিয়ে দেওয়া হয়েছে ওসিকে। এসপির কাছে ওসির বিচার চেয়ে দ্বিতীয়বার প্রতারিত হয়েছি। আমি প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাইব। তিনি একজন মা।

ওসি মিজানের দ্বিতীয় স্ত্রী ভুক্তভোগী কলেজছাত্রী বলেন, প্রথম স্ত্রীর কথা গোপন করে ওসি মিজান তাকে বিয়ে করেছিলেন। ওসি নেশা করেন। বহু নারীতে আসক্ত। যেখানেই চাকরি করেছেন সেখানেই নারী কেলেংকারির জন্ম দিয়েছেন। এসব কারণে তাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে রাজি ছিলাম না। কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তারা অনেকটা জোর করেই তাকে পুলিশ সুপারের নির্দেশমতে বিয়েতে বাধ্য করেন। বিয়ের পর ওসি মিজান নিজেও ক্ষমা চেয়ে আর ভুল হবে না বলে অঙ্গীকার করেন। এসপিসহ সবাই আশ্বাস দেন, স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ওসি তার সঙ্গে সংসার করবেন। ডিবির ওসি দেলোয়ার হোসেনসহ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন। বিয়ের পর আমাকে কাজি অফিসে ফেলে রেখে প্রথম স্ত্রীকে নিয়ে চলে যান ওসি মিজান। পরদিন থেকে ডিভোর্সের জন্য বিভিন্ন ধরনের চাপ ও হুমকি দিতে থাকেন। টাকা দিয়ে তদন্ত কমিটিকে কিনে ফেলেছেন-এমন দম্ভ দেখান। একাধিকবার আমার গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জে রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ডিভোর্সের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। এ ঘটনায় পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সানোয়ার হোসেন। তার কাছে বিয়ের পরবর্তী সব ঘটনা লিখিতভাবে জানিয়েছি। তারপরও ওসিকে বাঁচিয়ে গোপনে গত এপ্রিল মাসে এসপির মাধ্যমে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে তদন্ত প্রতিবেদন পাঠায় তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় ‘ওসি তার সঙ্গে সংসার করছেন, মাসে মাসে মানিঅর্ডার করে টাকা পাঠাচ্ছেন।’ অথচ সম্পূর্ণ মিথ্য তথ্য দিয়ে প্রতিবেদন দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয় বার বিয়ে করার পর একদিনের জন্যও সংসার করেননি ওসি মিজান। ছয় মাসের মধ্যে গত জানুয়ারি মাসে ৮ হাজার টাকা পাঠিয়ে ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। অথচ আমি এক টাকাও পাইনি। প্রতিবেদন পাঠানোর আগে তদন্ত কমিটি আমার কাছে অন্তত ফোন করে হলেও টাকা পাঠানোর বিষয়ে সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন ছিল। আমি টাকা নিয়েছি কি না, প্রমাণ দিক তদন্ত কমিটি।’

তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে ভুক্তভোগী আরও বলেন, ‘আসলে তারা মিজানকে শুরু থেকেই বাঁচানোর চেষ্টায় ছিল। ওই চেষ্টার অংশ হিসেবে তারা মিজানের সঙ্গে আমার আবার তড়িঘড়ি বিয়ে দেয়। বিয়ে না দিলে মিজানের বিরুদ্ধে ওই রাতে ধর্ষণ মামলা হতো। জেলে যেতে হতো। সাসপেন্ড হতে হতো। আমি একজন কলেজছাত্রী। আমার জীবন নষ্ট করে তারা নিজেদের লোককে রক্ষা করেছে। একবারের জন্যও তারা ভাবেনি আমার ভবিষ্যৎ কী হবে। আমি গাজীপুরের পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে ন্যায়বিচার পাইনি। বিচারের জন্য প্রয়োজনে আদালতের দ্বারস্থ হব।’

প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে গাজীপুরের পুলিশ সুপার কাজী শফিকুল আলম সময়ের আলোকে বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। তবে কী সুপারিশ করা হয়েছে ওসির বিরুদ্ধে তা জানানো হয়নি। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে প্রতিবেদন ফেরত আসার বিষয়টিও জানা নেই। একই কথা বলেছেন তদন্ত কমিটির প্রধান গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সানোয়ার হোসেন।

তবে কমিটির অন্য একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে সময়ের আলোকে বলেন, দ্বিতীয় স্ত্রীকে টাকা পাঠানোর মানি অর্ডারের রসিদ প্রমাণস্বরূপ দিয়েছেন ওসি মিজান। এ কারণে অভিযোগকারীর সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন পড়েনি। নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধের জন্য ওসির শাস্তির সুপারিশসহ কিছু বিষয় উল্লেখ না করায় প্রতিবেদন ফেরত পাঠিয়েছে পুলিশ হেডকোয়ার্টার। ত্রুটি-বিচ্যুতি ঠিক করে অচিরেই তদন্ত প্রতিবেদন আবার পাঠানো হবে।

ওসি সৈয়দ মিজানুর ইসলামের বাড়ি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার দক্ষিণ স্বরমঙ্গল গ্রামে। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর থানার ওসি থাকাকালে গত বছরের নভেম্বর মাসে প্রথম স্ত্রী ও দুই সন্তানের কথা গোপন রেখে রেজিস্ট্রি করে ওই কলেজছাত্রীকে বিয়ে করেন ওসি মিজান। জাতীয় নির্বাচনের আগে তাকে গাজীপুরের জয়দেবপুর থানায় বদলি করা হয়। সেখানে স্ত্রীকে নিয়ে একটি রিসোর্টে থাকতেন ওসি। গত ১৬ জানুয়ারি কলেজছাত্রী ঝর্নাকে বিয়ে করার বিষয়টি অস্বীকার এবং বিয়ের কাজি ও রেজিস্ট্রি জাল-জালিয়াতি ছিল জানিয়ে মানিকগঞ্জ ফিরে যেতে চাপ ও ভয়ভীতি দেখান। ৯৯৯-এ কল পেয়ে জেলা পুলিশ রিসোর্ট থেকে কলেজছাত্রী ঝর্নাকে উদ্ধার করে। পরে ওসি মিজানকে ডেকে নিয়ে আটক রাখা হয়। পরে এসপি ও প্রথম স্ত্রীর সম্মতিতে দ্বিতীয়বার বৈধভাবে বিয়ে পড়ানো হয়।

সময়ের আলো/আরএস/ 





https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close