ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

বিদায়, কবি অসীম সাহা
কবিতার অস্থির জ্যোৎস্নায় ভিজে ভিজে
প্রকাশ: শুক্রবার, ২১ জুন, ২০২৪, ৪:২০ এএম  (ভিজিট : ৪৮৮)
একদিন ‘পূর্ব-পৃথিবীর অস্থির জ্যোৎস্না’র গান শুনিয়েছিলেন, আজ তিনিই জ্যোৎস্না হয়ে গেছেন। হ্যাঁ, অসীম সাহা এখন অসীম লোকের বাসিন্দা। কবি, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক। ছোট-বড় সবার জন্যে লিখেছেন। করেছেন সম্পাদনা। মধ্যযুগের প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’কে আধুনিক বাংলা ভাষায় বিনির্মাণ করেছেন। অনুবাদ করেছেন। বিচিত্র বিষয় নিয়ে তিনি লিখেছেন। লেখালেখির সঙ্গেই কাটিয়েছেন সারাটা জীবন। ব্যক্তিমানুষ হিসেবে ছিলেন স্পষ্টভাষী। কবিতার বক্তব্য প্রকাশেও সাধারণত রাখতেন না আড়াল। যদিও কখনো কখনো ছিলেন রূপকাশ্রয়ী। অসীম সাহা ১৯৪৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন নেত্রকোনায়, মামার বাড়িতে। পৈতৃক ভিটা মানিকগঞ্জে হলেও পিতার কর্মসূত্রে শৈশব-কৈশোর কাটিয়েছেন মাদারীপুরে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ষাটের দশকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুবাদে ঢাকার সঙ্গে সেই যে জড়িয়ে গেলেন, তারপর এখানেই শিল্পের সঙ্গে বসত করে কাটিয়ে দিলেন বাকি জীবন। 
অসীম সাহা কবিতায় ষাটের দশকের হলেও তার প্রথম কবিতার বই বের হয় বেশ পরে। ১৯৮২ সালে। পূর্ব-পৃথিবীর অস্থির জ্যোৎস্নায়। ৩৭টি কবিতা নিয়ে মলাটবদ্ধ হয় বইটি। অসীম সাহার কবিতায় আরোপিত কোনো অনুষঙ্গ নেই। কবিতার প্রয়োজনেই একে একে সেখানে এসে জড়ো হয় নানান চিত্রকল্প, উপমা, রূপক। কখনো কখনো সূক্ষ্ম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বাজিয়ে নেন ছন্দকে। ‘পূর্ব-পৃথিবীর অস্থির জ্যোৎস্নায়’ কাব্যের প্রথম কবিতার তিন লাইনে বিন্যস্ত প্রথম বাক্যটি যদি আমরা পাঠ করি, তাহলে দেখব চমৎকার একটি চিত্র আমাদের আবেশিত করে। তিনি লিখেছেন-
‘ধুলোবালিমাখা, রুক্ষ, এলোমেলো কয়েকগুচ্ছ চুল
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে সে বসে আছে বিরহকাতর
এই পূর্ব-উপকূলে।
(বিরহকাতর এক দগ্ধ বাউলিনী)
তখন ‘সে’ সর্বনামের আড়ালে বসে থাকা এক বাউলিনীর ছবি আমাদের মানসপটে ভেটে ওঠে। এভাবে বাউলিনীর কথা বলতে শুরু করে তিনি শোনান প্রকৃতির কথা, প্রেমের কথা, নারী ও শিশুর কথা, স্বদেশের কথা। এই বাউলিনী দগ্ধ, বিরহকাতর হলেও তার দুচোখ জুড়ে স্বপ্ন। ‘নিশ্চয় কেউ আসবে।’
তাই বলা চলে প্রথম থেকেই অসীম সাহার কবিতায় হতাশা, অন্ধকার, শূন্যতা উঠে এলেও তিনি মূলত আশাবাদী কবি। এবং রোমান্টিক। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই রোমান্টিকতার ধার কিছুটা কমে এসেছে। এর যৌক্তিক কারণও অবশ্য আছে। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশ আমাদের যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল, তা ভাঙতে বেশি সময় লাগেনি। ’৭৫-এর আগস্টে রক্তাক্ত হয় আমাদের স্বপ্ন। তারপর একের পর এক স্বৈরশাসনে বিপর্যস্ত হয়েছে স্বদেশ। ফলে বাস্তব অভিঘাতগুলো অসীম সাহার কবিতায় আরও স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে। 
এক প্রাবন্ধিক অসীম সাহার কবিতা সম্পর্কে লিখেছেন : ‘উত্তরকালে কবিতাবলিতে রোমান্টিকতা ফ্যাকাশে হয়েছে (কিন্তু মরে যায়নি), স্পষ্টতর হয়েছে বাস্তবতার অভিঘাত। এ-প্রসঙ্গে ‘উদ্বাস্তু’ সিরিজের দশটি কবিতার কথা বলা যায়। উদ্বাস্তু হওয়া পঞ্চাশোত্তীর্ণ কবির স্মৃতি-কোলাজ এই কবিতাগুচ্ছ। এখানে আছে : কখনো তার খোকনকে সামনে রেখে, কখনো একাকী- অনেক না-বলা কথা; কখনো কৈশোরস্মৃতি, কখনো যৌবনের স্বপ্ন; কখনো বারো বছরের নিরুপমা, কখনো সরস্বতী-শীলা সাহার রক্তসিঁদুর মাখার গল্প।’
তবে কবিতার শুদ্ধতার দিকেই ছিল তার ঝোঁক। নিরেট বক্তব্য বা সেøাগাননির্ভর কবিতা তিনি লেখেননি। শব্দালঙ্কারে, অর্থালঙ্কারে কবিতাকে সাজিয়েছেন। অবয়ব গড়েছেন। কবিতার পট নির্মাণের জন্য কখনো পুরাণ, কখনো ইতিহাস, কখনো সমকাল, কখনো বা দৈনন্দিন জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ জিনিসের দ্বারস্থও হয়েছেন। 
বিষয় হিসেবে ‘প্রেম’ তার কবিতায় বারবারই ঘুরে ফিরে এসেছে। প্রেমে তিনি যতটা অতীন্দ্রিয়, তার চেয়ে বেশি জৈবিক, দেহনির্ভর। ‘প্রেম পদাবলি’ শিরোনামে তার একটি বই আছে। যেখানে তিনি দুই পঙ্ক্তির শিরোনামহীন কবিতাগুলো সংখ্যা চিহ্নিত করে বইটির অবয়ব সাজিয়েছেন। সেখান থেকে কয়েকটি কবিতা উদ্ধৃত করছি।
ক. ‘ঘুমিয়ে থাকা তোমার বুকের পাহাড় দুলে ওঠে
এক নিমেষে তৃষ্ণাকাতর কাঁপন লাগে ঠোঁটে।’
খ. ‘দিনরাত্তির আঁতিপাঁতি খুঁজছি ক্যাটালগ
তোমার বুকের পাহাড়চূড়ায় হবোই পর্যটক।’
পাঠকমহলে অসীম সাহা কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও গদ্যেও তিনি প্রচুর কাজ করেছেন। বিশেষ করে তার প্রবন্ধের কথা বলব। প্রবন্ধে তিনি শব্দকে ইস্পাতের ধারালো তরবারির মতোই ব্যবহার করেছেন। এখানে বক্তব্যে তিনি ঋজু। সোজাসাপটা। অকপট। 
একটি উদাহরণ দিচ্ছি।
‘একবার এক সাহিত্য-সম্পাদক তার পাতায় আমাকে বড় দৈর্ঘ্যরে কোনো কবিতা দিতে বারণ করলেন। কেন? পত্রিকার সম্পাদক নাকি বড় কবিতা ছাপতে বারণ করেছেন। তা হলে সব কবিকেই পত্রিকার কলাম-ইঞ্চি মেপে কবিতা লিখতে হবে? না তা নয়, যদি ‘শামসুর রাহমান-জাতীয়’ কবি হন, তা হলে চলবে। অন্যদের বেলায় নয়। কবিতার ভালোমন্দ বিবেচনায় নেওয়ার দরকার নেই, দরকার শুধু নামের। এসব নাম ছেপে জাতে উঠতে হবে না? তা হলে এসব সাহিত্য-সম্পাদকদের দরকার কী? তারা কী সম্পাদনা করবেন? বিভিন্ন কবির কাছ থেকে কবিতা চেয়ে শুধু ছাপার কাজটাই যদি তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, তা হলে তারা সাহিত্য-সম্পাদক কেন? তাদের পদটির নাম ‘সাহিত্য-সংকলক’ কিংবা ‘সাহিত্য-সংগ্রাহক’ দেওয়াই কি শ্রেয় নয়? ওইসব পত্রিকার মালিক/ সম্পাদকরা ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখবেন কি?’
(কবিতা-টবিতা নিয়ে কিছু কথা)
জানি না, যেসব সাহিত্য-সম্পাদককে উদ্দেশ করে তিনি উপরিউক্ত কথাগুলো বলেছেন, তারা বিষয়টি বিবেচনায় এনেছেন কি না? বর্তমানে সবকিছুর সঙ্গে সাহিত্যেও অরাজকতা চলছে। এই অরাজকতা অবশ্য আগেও ছিল। কিন্তু বর্তমানে তার প্রভাব হয়তো বেড়েছে। চেয়ার দেখে যেমন কিছু কিছু সাহিত্য-সম্পাদক লেখা ছাপে, ঠিক চেয়ার দেখেই অনেক অধ্যাপকও তোষামদ করে প্রবন্ধ রচনা করেন। ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়। সাহিত্য-সম্পাদক নামের বামনদের ভিড়ে আহসান হাবীবের মতো উচ্চতাসম্পন্ন সাহিত্য-সম্পাদকও আছেন। থাকবেন। তবে উপরিউক্ত উদ্ধৃতি দেওয়ার কারণ এই প্রবন্ধ যদি কোনো তরুণকে প্রাবন্ধিকের নাম উহ্য রেখে পড়তে দেওয়া হয়, তাহলে সে হয়তো বুঝতে পারবে না এটি কোন প্রবীণ সাহিত্যিকের কলম থেকে বেরিয়েছি। ভাববে, তাদেরই সমধর্মী কোনো তেজী তরুণের কলম থেকে নির্গত হয়েছে। এই যে সমকালকে ধারণ করা, কালের অসংগতিকে শানিত বক্তব্য দিয়ে ফালাফালা করে কেটে ফেলা, সর্বোপরি তারুণ্যের আলোয় নিজেকে আলোকিত করা, নিঃসন্দেহে তা একজন লেখকের শক্তিমত্তার পরিচায়ক। অসীম সাহার কোনো বিষয় নিয়ে লিখতে গিয়ে ভাবালুতায় আচ্ছন্ন হয়ে গদ্য রচনা করেনি, যুক্তির দ্বারা তা খণ্ডন করেছেন। দুই বাংলার জনপ্রিয় সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় কোনো সাক্ষাৎকারে বর্ণপ্রথার পক্ষে সাফাই গাইলে অসীম সাহা যুক্তির মাধ্যমে সেই বক্তব্যের অসাড়তা প্রমাণ করেছেন। তিনি লিখেছেন :
‘আপনি (শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়) অসবর্ণপ্রথাকে ভাঙতে চান না, আপনি চান এই প্রথার স্থায়িত্ব। তা না হলে আপনার এই ঔদ্ধত্য তো মুহূর্তেই ধুলায় লুটিয়ে পড়তে বাধ্য। কী বলবেন আপনি মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদিদের সম্পর্কে? তাদের মধ্যে তো হিন্দুধর্মের মতো বর্ণপ্রথার প্রচলন নেই। তা হলে সেখানে প্রতিভাবান মানুষের জন্ম হচ্ছে কীভাবে?’
(বর্ণবাদী কথাসাহিত্যিকের অন্তর্বয়ান)
এখানে আমরা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য খণ্ডনের পাশাপাশি এক উদার, অসাম্প্রদায়িক অসীম সাহার দেখা পাই। এই অসাম্প্রদায়িক, সাহসী মানুষ এখন বড় প্রয়োজন আমাদের। ব্যক্তি অসীম সাহাকে যারা জানেন, চেনেন, তারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, কোনো কবি-সাহিত্যিক অসুস্থ হয়ে ঢাকার কোনো হাসপাতালে ভর্তি হলে অসীম সাহা সেই খবর সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতেন। আর কখনো তিনি এই মানবিক দায়িত্ব পালন করবেন না। বাংলা একাডেমি, শাহবাগ, কাঁটাবনে আর দেখা যাবে না শ্মশ্রুমণ্ডিত এই কবিকে। বিদায়, কবি অসীম সাহা। আপনার কবিতার অস্থির জ্যোৎস্নায় আমরা আরও অনেক দিন ভিজতে থাকব।

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close