ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

অপ্রস্তুত ট্যানারি পল্লী
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১৩ জুন, ২০২৪, ৭:২৫ এএম  (ভিজিট : ৪৯৪)
বছর ঘুরে ফের দোরগোড়ায় কুরবানির ঈদ। এবার দেশে এক কোটিরও বেশি পশু জবাই হতে পারে। এত পশুর চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে কতটা প্রস্তুত সাভারের হেমায়েতপুরের ট্যানারি পল্লী?

এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গতকাল সরেজমিন দেখা যায়, ট্যানারি পল্লীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারই অকেজো। এর মাধ্যমে যথাযথভাবে বর্জ্যমিশ্রিত পানি পরিশোধন হয় না। এই দূষিত পানিই পাশের ধলেশ্বরী নদীতে ফেলা হচ্ছে। ধ্বংস করা হচ্ছে পরিবেশ-জীববৈচিত্র্যের। এ ছাড়া চামড়ার উচ্ছিষ্ট বা কঠিন বর্জ্য ফেলার ডাম্পিং স্টেশনও তৈরি হয়নি এতদিনে। এসব কারণে বাংলাদেশ থেকে চামড়া কেনা কমিয়ে দিয়েছে বিদেশি ক্রেতারা। কারণ ট্যানারি পল্লী মানসম্পন্ন না হওয়ায় এলডব্লিউজি সনদ পায়নি এখানকার অনেক কারখানা। আর এই সনদ না পাওয়া কারখানা থেকে চামড়া নেয় না বিদেশি ক্রেতারা।

এ অবস্থাতেই নতুন করে এক কোটিরও বেশি চামড়ার অধিকাংশই নেওয়া হবে সাভারে। নতুন চামড়া সংরক্ষণ করার মতো সক্ষমতা ট্যানারিগুলোর রয়েছে কি না- এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ সময়ের আলোকে বলেন, ‘ট্যানারি পল্লী নিয়ে আমরা বিপাকে আছি। এখানকার পরিস্থিতি কেমন, তা সরকারের ওপর মহল থেকে নিচ পর্যন্ত-সবারই জানা। আসলে আমরা যে স্বপ্ন নিয়ে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তর করে সাভারের হেমায়েতপুরে এসেছিলাম, সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। বরং সেখানে গিয়ে আমরা নানা রকম সংকটের মুখে পড়েছি। প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে ট্যানারি পল্লী গড়ে তোলা হলেও কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারসহ অনেক কিছুই ঠিকমতো কাজ করছে না। এখনকার উৎপাদিত চামড়া বিদেশি ক্রেতারা নিতে চাচ্ছে না।’

তিনি বলেন, কুরবানি ঈদের এত চামড়া নেওয়ার মতো প্রস্তুতি নেই সাভারের ট্যানারি পল্লীতে। এর প্রধান কারণ গত বছরের প্রায় ৪০ শতাংশ চামড়া এখনও ট্যানারিগুলোতে রয়েছে। এ ছাড়া নতুন মৌসুমের জন্য চামড়া কিনতে আমরা ব্যাংক থেকে ঋণ চেয়েও পাচ্ছি না। অনেক ট্যানারি মালিকের হাতে টাকা নেই। টাকা না থাকলে কীভাবে চামড়া কিনবেন ট্যানারি মালিকরা।

গতকাল বুধবার ট্যানারি পল্লী এলাকা সরেজমিনে দেখা যায়, সাভারের চামড়া শিল্পনগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার এখনও পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। সেখানে নেই কোনো স্থায়ী ভাগাড় বা ডাম্পিং ইয়ার্ড। কমপ্লায়েন্স শতভাগ নিশ্চিত না হওয়ায় চামড়া খাতের রফতানি সম্ভব হচ্ছে না। ২০১৭ সালে ট্যানারি শিল্প হাজারীবাগ এলাকা থেকে সাভারে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু এতে রফতানিতে তেমন প্রভাব পড়েনি।
সাভার বিসিক চামড়া শিল্পনগরীর বেশিরভাগ ট্যানারির নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। যেসব কারখানায় কাজ চলছে, সেসবের একটিরও নেই এলডব্লিউজি সনদ। বিশ্বের নামিদামি ব্র্যান্ডগুলোর কাছে ভালো দামে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিক্রি করতে হলে চামড়া শিল্পের বৈশ্বিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ বা এলডব্লিউজির সনদ থাকতে হয়। কিন্তু সাভার চামড়া শিল্পনগরীর ১৪২টি ট্যানারির মধ্যে একটিরও নেই সেই সনদ।

গতকাল গিয়ে দেখা যায়, ট্যানারিগুলোতে চলছে উৎপাদন কাজ। পিকআপ ভ্যান থেকে চামড়া মাথায় করে কারাখানায় ঢোকাচ্ছেন শ্রমিকরা। বেশ কিছু ট্যানারি কুরবানির ঈদ সামনে রেখে প্রস্তুতি সেরেছে। অন্যদিকে দীর্ঘদিন বর্জ্য ফেলায় ভরে গেছে পুরোনো দুটো ডাম্পিং ইয়ার্ড। ঈদের বিপুল পরিমাণ চামড়ার বর্জ্য ডাম্পিং করতে নতুন করে চলছে দুটি পুকুর খননের কাজ। এ ছাড়া অন্যান্য দিনের মতোই সিইটিপির দূষিত পানি ড্রেনের মধ্য দিয়ে গিয়ে পড়ছে ধলেশ্বরী নদীতে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়েস্টেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান কোম্পানি লিমিটেড ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো, গোলাম শাহনেওয়াজ বলেন, সিইটিপি নিয়ে সমস্যা রয়েছে এটি অস্বীকার করার কিছু নেই। তবে আমরা চেষ্টা করছি ভালো কিছু করার। নদীতে সরাসরি দূষিত পানি ফেলা হয় এটি সত্য নয়। আমাদের ট্রিটমেন্ট অনুযায়ী প্রায় ৮০ শতাংশ শোধিত পানি নদীতে যাচ্ছে।

মালিকরা বলছেন, হাজারীবাগ থেকে সাভারে এসে ট্যানারি শিল্পের আরও বেশি খারাপ অবস্থা। সিইটিপির সমস্যার কারণে তারা পাচ্ছেন না এলডব্লিউজির সনদ। প্রক্রিয়াজাত চামড়া রফতানি করছে পারছেন না কাক্সিক্ষত বায়ারদের কাছে। শুধু চীনে চামড়া রফতানি করে তাদের পক্ষে আর টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না।

ট্যানারি মালিক মজিবুর রহমান মজু বলেন, প্রতি মাসে দুই থেকে তিন লাখ টাকা দিতে হচ্ছে সিইটিপিকে। এত টাকা দিলেও কি কাজে আসছে এই প্রতিষ্ঠানটি? সিইটিপির কারণে ট্যানারি শিল্প আজ ধ্বংসের পথে। এরা রাতের আঁধারে নদীতে বর্জ্যসহ পানি ছেড়ে দেয়। সেটি সাংবাদিক, পরিবেশ নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে বিদেশিরা জানতে পেরে আমাদের কালো তালিকাভুক্ত করে দিয়েছে। যে কারণে আমরা বিশ্বের নামিদামি ব্র্যান্ডগুলোর কাছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিক্রি করতে পারছি না। সিইটিপি তাদের কর্মকাণ্ড ঠিকভাবে পালন করলে আমরা এলডব্লিউজির সনদ পেতাম। তখন ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে আমাদের চামড়ার রফতানি করা যেত। আমাদের যেহেতু এলডব্লিউজির সনদ নেই, তাই শুধু চীনের কাছে কম দামে চামড়া বিক্রি করতে হচ্ছে।

সানলাইট ট্যানারির মালিক মো. পারভেজ বলেন, বর্তমানে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির বিল যে পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে, তাতে কারখানা চালাতে প্রতি মাসে লোকসান গুনতে হচ্ছে ৫-৭ লাখ টাকা। বিদেশে আমাদের চামড়ার কোনো চাহিদা নেই। এদিকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের জোরালো কোনো উদ্যোগ নেই, আমরা এ ব্যবসা করব কীভাবে?

শ্রমিকদের কঠিন জীবন : চামড়া শিল্পনগরীতে ১৪২টি ট্যানারিতে কাজ করছে প্রায় ৭ থেকে সাড়ে ৭ হাজার শ্রমিক। মজুরি বোর্ড অনুযায়ী এসব শ্রমিকদের যে বেতন দেওয়ার কথা রয়েছে সেটি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা। এসব শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ হয় তাদের কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে।

সাভারের ট্যানারিগুলোতে স্থায়ী ও অস্থায়ী দুই ধরনের শ্রমিক কাজ করেন। তাদের মধ্যে নতুনদের ৭-৯ হাজার এবং অভিজ্ঞ শ্রমিকদের ১০-১২ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হয়। তাদের আবাসন, চিকিৎসাসহ জীবনযাপনের মৌলিক চাহিদা পূরণের নেই যথাযথ ব্যবস্থা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে আরও নাজেহাল তারা।

কামাল উদ্দিন নামের এক শ্রমিক জানান, তিনি প্রতি মাসে ১২ হাজার টাকা বেতন পান। কিন্তু এই টাকা দিয়ে তার সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হয়। অন্য কোথাও কাজ না পেয়ে বাধ্য হয়েই সাভারের ট্যানারি শিল্পে কাজ করছেন গত চার বছর ধরে।

ট্যানারি শ্রমিক সিদ্দিক কাজ করছেন ১২ বছর ধরে। হাজারীবাগে তার বেতন ছিল ১০ হাজার টাকা। তখন জিনিসপত্রের যে দাম ছিল তা দিয়ে কোনোমতে চলত তার সংসার। বর্তমানে দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতিতে ১৪ হাজার টাকা বেতনে এখন আর সংসার চলছে না। নিরুপায় হয়ে তিনি করছেন এ কাজ। ছাড়তেও পারছেন না।

ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেকের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি জানান, ট্যানারি শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা করার দাবিতে তারা আন্দোলন করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি নারী শ্রমিকদের প্রসূতি কল্যাণ সুবিধাসহ শ্রম আইন অনুযায়ী প্রাপ্য সব সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে তাদের আন্দোলন চলমান আছে।

সবকিছুর দাম বাড়ে কমে শুধু চামড়ার দাম : প্রতি বছর কুরবানির ঈদে ট্যানারি মালিকরা পশুর কাঁচা চামড়া কেনেন পানির দরে। অথচ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সূত্র মতে, বছরে ১৩-১৪ হাজার কোটি টাকার চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বাণিজ্য করেন ট্যানারি মালিকরা। তবে বঞ্চিত হয় অসহায়-গরিব মানুষ। অর্থাৎ কুরবানিদাতা, চামড়ার মূল্যের সুবিধাভোগী এবং চামড়াপণ্য ব্যবহারকারী ভোক্তাকে ঠকতে হয়। অন্যদিকে বাড়তি মুনাফা তুলে নিচ্ছেন ট্যানারি মালিক ও বিভিন্ন পর্যায়ের পশুর চামড়া ব্যবসায়ীরা।

দেশে সবকিছুর দাম বাড়লেও কেবল কুরবানির পশুর চামড়ার দাম কমছে। পরিসংখ্যান মতে, ২০১৩ সালেও ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৮৫-৯০ টাকা; খাসির চামড়ার দর প্রতি বর্গফুট ৫০-৫৫ টাকা নির্ধারিত হয়েছিল। অথচ ২০২৪ সালে গরুর চামড়ার মূল্য নির্ধারিত হয়েছে প্রতি বর্গফুট ৫৫-৬০ টাকা; খাসির চামড়ার মূল্য ২২-২৫ টাকা। দেখা যাচ্ছে, গত ১১ বছরে প্রতি বর্গফুটে গরুর চামড়ার মূল্য কমেছে প্রতি বর্গফুটে ৩০ টাকা, খাসির চামড়ার মূল্য কমেছে ২৮-৩০ টাকা।

বাহ্যিক দৃষ্টিতে মূল্যের এ কমতি দেখা গেলেও বাস্তবে টাকার ক্রয়ক্ষমতা অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় নিলে চামড়ার মূল্য আরও অনেক কম। এক পরিসংখ্যান বলছে, গত ১০ বছরের গড়ে জিনিসপত্রের দাম ১৩৩ শতাংশ বেড়েছে, অর্থাৎ যে জিনিসের দাম ২০১৩ সালে ১০০ টাকা ছিল তার বর্তমান মূল্য ২৩৩ টাকা। সে হিসাবে ২০১৩ সালে ৯০ টাকার প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার মূল্য ঢাকায় ২১০ টাকা হওয়ার কথা; কিন্তু ২০২৪ সালের ঘোষিত মূল্য ঢাকায় মাত্র ৬০ টাকা বর্গফুট। এর অর্থ হলো ১১ বছরে চামড়ার দাম ২৮ শতাংশে নেমেছে। দাম প্রায় ৪ ভাগের ১ ভাগ হয়েছে।

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close