ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

যবিপ্রবি ছাত্রলীগে অপকর্মের পাহাড়, লাগাম টানবে কে?
প্রকাশ: সোমবার, ১০ জুন, ২০২৪, ১:২৮ এএম  (ভিজিট : ৩৯০)
কমিটি ঘোষণার পর থেকে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (যবিপ্রবি) শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ছাত্রলীগের নির্যাতনে রেহাই পাননি সাধারণ শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সাংবাদিক, চাকরিপ্রার্থী কেউই। প্রায় দেড় ডজন ঘটনায় তদন্ত কমিটি হলেও বিচার করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কথায় অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে তা হলে এই বেপরোয়া ছাত্রলীগের লাগাম টানবে কে?

১৪ অক্টোবর যবিপ্রবিতে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় সংগঠনবিরোধী, শৃঙ্খলা পরিপন্থী ও সংগঠনের সুনাম ক্ষুণ্নের অভিযোগে যবিপ্রবি শাখা ছাত্রলীগের সব কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করে বিজ্ঞপ্তি দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এর প্রায় এক মাস পর ভবিষ্যতে সংগঠনের শৃঙ্খলা ও মর্যাদা পরিপন্থী কার্যকলাপে সম্পৃক্ত হবে না, এই শর্তে যবিপ্রবি শাখার কমিটির ওপর আরোপিত স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে কেন্দ্রীয় কমিটি। এরপরও সংগঠন বিরোধী কার্যক্রম থেকে বিরত থাকেনি তারা।

আবাসিক হলে ডেকে নিয়ে রাতভর নির্যাতন : আবাসিক হলে শাহরীন রহমান প্রলয় নামে এক শিক্ষার্থীকে ছাত্রলীগ সভাপতির রুমে ডেকে নিয়ে রাতভর নির্যাতনের অভিযোগ উঠে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সোহেল রানা ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে। শহীদ মসিয়ূর রহমান হলের ৩০৬ নম্বর কক্ষে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনায় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সোহেল রানাসহ ছাত্রলীগের আট নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন ওই শিক্ষার্থী। মামলার এজহারে ওই শিক্ষার্থী বলেন, খেলার মাঠে কথাকাটাকাটির জেরে ছাত্রলীগ কর্মী শাহিনুর আমাকে মেরে আমার মাথা ফাটিয়ে দিলে আমি প্রক্টর বরাবর লিখিত অভিযোগ করি। এ অভিযোগ করায় আবাসিক হলে ডেকে নিয়ে আমাকে রাতভর নির্মমভাবে নির্যাতন করে আহত করা হয় এবং তারা বলতে থাকেন অভিযোগ তুলে না নিলে গুলি করে হত্যা করে হবে। এ ছাড়াও এ ঘটনা চেপে যেতে তার মাকে মুঠোফোনে হুমকি দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে বাড়িতে বোমা মারা হবে বলে মুঠোফোনে হুমকি দেওয়া হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় ওই শিক্ষার্থীকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

সালাম না দেওয়ায় শিক্ষার্থীকে নির্যাতন : আবাসিক হলে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতিকে সালাম না দেওয়ায় ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন বায়োসাইন্স বিভাগের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে মারধরের অভিযোগ রয়েছে সভাপতি সোহেল রানার অনুসারীদের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী যশোর কোতোয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি ও হলের প্রভোস্ট ও প্রক্টর বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থী। 
১৭ চাকরি প্রার্থীকে অপহরণ : গত বছরের ৭ ডিসেম্বরে যবিপ্রবিতে লিফট অপারেটর পদে নিয়োগ পরীক্ষা দিতে আসা ১৭ জন চাকরি প্রার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ছাত্রাবাসে আটকে রাখার অভিযোগ উঠে শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে। এ ছাড়া অপহরণ হওয়া একজন ভুক্তভোগী যশোর কোতোয়ালি থানায় শাখা ছাত্রলীগের ৬ জন নেতাকর্মীর নামে মামলা করেন। এ ঘটনায় অপহরণের সত্যতাও পায় তদন্ত কমিটি। কিন্তু অদৃশ্য কোনো কারণে ওই ঘটনায় কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

সিসি ক্যামেরার হার্ডডিস্ক ছিনতাই : লিফট অপারেটরের নিয়োগ পরীক্ষায় ১৭ জন চাকরি প্রার্থী অপহরণের ঘটনার প্রমাণ লোপাট করতে ৭ ডিসেম্বর শহীদ মসিয়ূর রহমান হলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজের হার্ডডিস্ক ছিনতাইয়ের অভিযোগ ওঠে শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।

অধ্যাপকের গাড়ি ভাঙচুর : গত ৫ ফেব্রুয়ারি দুপুর ২টার দিকে ছাত্রলীগের মিছিল চলাকালে এফএমবি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সুব্রত মণ্ডলের প্রাইভেটকার ভাঙচুর অভিযোগ ওঠে শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় তিনি প্রক্টর বরাবর মৌখিক অভিযোগ দেন। পরবর্তী সময়ে বিভাগের শিক্ষার্থীরা ভাঙচুরের প্রতিবাদ জানিয়ে মানববন্ধন করতে চাইলে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ছাত্রী লাঞ্ছিতের অভিযোগ পাওয়া যায়।

সংবাদ সংগ্রহকালে টার্গেট করে সাংবাদিকদের মারধর : শাখা ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে দৈনিক আমাদের সময়ের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি শিহাব উদ্দিন সরকারকে বেধড়ক মারধর করে আহত করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ ছাড়া তার মোবাইল ফোনও ছিনিয়ে নেওয়া হয়। গত বছরের ১৭ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মসিয়ূর রহমান হলে এ ঘটনা ঘটে। এ ছাড়াও গত বছরের ২০ মার্চ ফেসবুক পোস্ট দেওয়ায় দেশ রূপান্তরের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি সজীবুর রহমানকে আবাসিক হলে ডেকে নিয়ে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতির কক্ষে শারীরিক ও মানসিকভাবে লাঞ্ছিত করেন সভাপতি। গত বছরের ২২ মে মানবজমিনের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতির সহ-সভাপতিকে কোনো কারণ ছাড়াই গেস্ট রুমে ডেকে নিয়ে নির্যাতন করেন দুই ছাত্রলীগ নেতা। এ ঘটনায় উচ্চতর তদন্ত কমিটি গঠন করলেও আলোর মুখ দেখেনি প্রতিবেদন।

শিক্ষার্থী হলে ডেকে দশ লাখ টাকা চাঁদা দাবি : শ. ম. র হলের ইসমাইল হোসেন নামে এক ছাত্রকে চাঁদার দাবিতে ৪ ঘণ্টা আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় যশোর কোতোয়ালি থানায় মামলাও করা হয়।

প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ : শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আল মামুন সিমনের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে মৌলবাদবিরোধী মিছিলে হামলায় চালায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদক সোহেল-তানভীরের অনুসারীরা। এ ঘটনায় চারজন আহত হন। পরে সিমন এ ঘটনায় প্রক্টর বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ৮ জনকে বহিষ্কার করে।
রুম পরিবর্তন না করায় শিক্ষার্থী নির্যাতন : ৩১ আগস্ট রুম পরিবর্তন না করায় শিক্ষার্থীকে মারধরের অভিযোগ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি নাজমুস সাকিব ও শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আসিফ আল মাহমুদের বিরুদ্ধে।

শিক্ষক লাঞ্ছিত : গত বছরের ১৬ জুলাই শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বহনকারী বাসের চাবি কেড়ে নেওয়া, অফিসকক্ষের এসি ও লিফট বন্ধের অভিযোগ ছিল শাখা ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। এ ঘটনার প্রতিবাদে শিক্ষক সমিতি ২২ দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ রেখেছেন।

এসব ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে। কয়েকটি ঘটনায় কয়েকজনকে বহিষ্কার করলেও তারা সবসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে অবস্থান করে পুনরায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন। তবে কোনো এক অদৃশ্য কারণে বড় ঘটনাগুলোতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ফলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে ছাত্রলীগ।

ছাত্রলীগের লাগাম টানা যাচ্ছে না কেন? এমন প্রশ্নে উপাচার্য ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা শিক্ষকরা লাগাম টানতে পারব না। সেটা সম্ভবও না। কারণ, এটা রাজনৈতিক বিষয়। রাজনৈতিকভাবেই এর সমাধান করতে হবে। ছাত্ররাজনীতি ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করে দিচ্ছে, এটা রাজনীতিবিদদের বুঝতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর ছাত্রলীগ আর এই মারামারি, টেন্ডারবাজি করা ছাত্রলীগ এক না। সংগঠনের সুনাম ক্ষুণ্নকারীদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।

উল্লেখ্য, ২০০৭ সালের ২৫ জানুয়ারি যশোর শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার আমবটতলা গ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘স্টুডেন্ট কোড অব কনডাক্ট’ অনুযায়ী ক্যাম্পাসে সব ধরনের রাজনৈতিক মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালের মে মাসে ছাত্রলীগ সেই নিয়ম ভেঙে রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের রাজনৈতিক সহিংসতার প্রথম বলি হন শিক্ষার্থী নাঈমুল ইসলাম রিয়াদ। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ ১০ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করা হয়। এখনও সেই মামলার বিচার হয়নি। সেই ধারাবাহিকতায় রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সহিংসতার ঘটনা ঘটেই চলেছে।

সময়ের আলো/আরএস/ 




এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ


https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close