ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে চার দিন ধরে বিদ্যুৎ নেই ভোলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা মনপুরায়। এতে অন্ধকারে বসবাস করছে স্থানীয় বাসিন্দারা। বিদ্যুৎ না থাকায় ভয়াবহ মানবিক সংকটে জীবনযাত্রা অতিবাহিত করছেন স্থানীয়রা। তাদের অভিযোগ, বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডি কোম্পানির গাফিলতির কারণে আজ মনপুরা অন্ধকারে।
এ বিষয়ে আবাসিক প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) ফরিদুল ইসলাম বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে বিদ্যুতের খুঁটি পড়ে গেছে। তাই বিদ্যুৎ দেওয়া যায়নি। বিদ্যুতের লাইন মেরামতের পর বিদ্যুৎ দেওয়া হবে।
সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছেন উপজেলার ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে ভর্তি রোগীরা। চরম গরমে অস্থির হয়ে পড়েছেন তারা। রোগীদের হাতে হাতে দেখা যাচ্ছে হাতপাখা। এমনকি বিদ্যুৎ না থাকায় টয়লেটে পানি পর্যন্ত নেই। সরেজমিন ঘুরে এমন ভয়াবহ চিত্রই দেখা গেছে।
এ ব্যাপারে হাসপাতালের দায়িত্বে থাকা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (টিএস) ডা. কবির সোহেল বলেন, বিদ্যুৎ না থাকার কারণে স্বাস্থ্যসেবা চরম আকার ধারণ করেছে। অবশ্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, বহির্বিভাগে জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। হাসপাতালের সব কাজ ও রোগীদের সেবা অব্যাহত রয়েছে।
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা জানান, গত চার দিন ধরে বিদ্যুৎ না থাকায় গরমে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তারা। এ ছাড়া টয়লেটে পানি নেই, নিচ থেকে পানি আনতে হয়।
এদিকে পুরো উপজেলায় বিদ্যুৎ না থাকায় পড়ালেখা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের। ফ্রিজে থাকা সব খাবার নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা সদরে বসবাসকারীরা। বিদ্যুৎ না থাকায় তারা গোসলসহ অন্যান্য কাজ করতে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।
ভয়াবহ তাণ্ডব চালিয়ে চলে গেছে ঘূর্ণিঝড় রিমাল। কিন্তু এর প্রভাবে ভয়াবহ ক্ষতির শিকার হয়েছেন মনপুরা উপজেলার উপকূলীয় ইউনিয়ন ১ নং মনপুরা, উত্তর সাকুচিয়া, দক্ষিণ সাকুচিয়া, হাজিরহাট, কলাতলীসহ বিচ্ছিন্ন ছোট-বড় ১০টি চরাঞ্চলে বসবাসকারী ৫০ হাজারেরও বেশি বাসিন্দা। ঘর-বাড়ি হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। এর মধ্যেই জোয়ারের লোনাপানি নলকূপে প্রবেশ করায় খাওয়ার বিশুদ্ধ পানির সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। জোয়ারের লোনাপানিতে পাঁচটি ইউনিয়নের বেশিরভাগ নলকূপের পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া জোয়ারের পানি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে আধা-কাঁচা টয়লেট। এ কারণে যত্রতত্র প্রাকৃতিক কাজ সারতে বাধ্য হচ্ছেন স্থানীয়রা।
এ বিষয়ে মনপুরা উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী আশরাফ হোসেন বলেন, লোনাপানি ঢুকে অযোগ্য হয়ে যাওয়া নলকূপের তালিকা করা হচ্ছে। এ ছাড়া পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হচ্ছে। নিরাপদ টয়লেট তৈরিরও উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। ৪ নং দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অলি উল্লা কাজল বলেন, ঘরবাড়ি ভেঙে সব শেষ। এখন বিশুদ্ধ খাবার পানি ও নিরাপদ টয়লেটের সমস্যা দেখা দিয়েছে।
উপজলোর মূল ভূখণ্ড থেকে বাইরে বিচ্ছিন্ন নবগঠিত বেড়িবাঁধহীন কলাতলী ইউনিয়নের অবস্থা খুবই শোচনীয়। সেখানে ২০ হাজারের ওপরে মানুষের বসবাস। এই চরে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হয়েছে। এখানে ধসে গেছে বেশিরভাগ বাড়ি-ঘর। খাবার পানির উৎসগুলো লোনাপানি ঢুকে আপাতত নষ্ট হয়ে আছে। ঝড়ে চরের কাঁচা টয়লেটগুলো ভেঙে পড়ায় আর খাবার পানি সংরক্ষণে প্রতি বাড়িতে থাকা ড্রামগুলো ভেসে যাওয়ায় তৈরি হয়েছে বিশাল মানবিক সংকট। এ ছাড়া চরশামসুদ্দিন, সোনারচর, চরবদনা, কাজিরচর ও ঢালচরের অবস্থাও নাজুক। এসব এলাকায় বেড়িবাঁধ না থাকায় ৬-৭ ফুট জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায়। এখনও পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন চরবাসী।
বিচ্ছিন্ন কলাতলী ইউনিয়নের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন হাওলাদার ও ২ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবদুল আজিজ এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। হাজিরহাট ইউনিয়নের সোনারচর গ্রামের বাসিন্দারা জানান, লোনাপানিতে নলকূপ ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ায় বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া আধাকাঁচা টয়লেট ভেসে যাওয়ায় প্রাকৃতিক কাজ দিনের বেলায় না সারতে পেরে রাতের বেলায় সারতে হচ্ছে খোলা আকাশের নিচে।
সময়ের আলো/আরএস/