ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

লিসবনে সার্দিন উৎসব
প্রকাশ: শুক্রবার, ৩১ মে, ২০২৪, ১:৩৩ এএম  (ভিজিট : ১০৯৬)
চাকরি জীবন ছেড়ে যখন পর্তুগালে এলাম, বিস্ময়ভরা চোখে শুধু এখানকার প্রকৃতি দেখছি আর আমার প্রিয় মাতৃভূমির কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে চাকরির সুবাদে আমার দেশের কত প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরেছি। পাহাড়, নদী, গাছপালা, পাখি কত নিবিড়ভাবে প্রকৃতিকে মুখরিত করে রেখেছে। বুলবুলি, চড়ুই, ঘুঘু পাখির ডাক আমি এখনও মিস করি। এখানেও আমি প্রকৃতির সৌন্দর্য তুলে ধরার কাজটিই করছি প্রায় একযুগ হতে চলল। 

দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপের দেশ পর্তুগালের কথা। আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ের এই দেশটির মানুষের মন অনেকটা বাংলাদেশের ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যের মতোই, ক্ষণে শীতল তো ক্ষণে ক্ষিপ্রতা। বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলের মতো এদেশেরও সমুদ্রে দীর্ঘ উপকূল রয়েছে। রয়েছে কয়েকটি স্বায়ত্তশাসিত দ্বীপ। বিশেষত্বের একটি হচ্ছে ইউরো-এশিয়া মেইনল্যান্ডের সর্বপশ্চিম পাড় এই পর্তুগালে, জায়গাটার নাম কাবোদা রকা। 
পুরো উত্তর আটলান্টিকের তীরঘেঁষা এই দেশটিতে তাই প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। বিশেষত সার্দিন মাছ। 

আর মাছের কথা যদি বলি, তবে মাছে-ভাতে বাঙালিরা কিন্তু এদের সঙ্গে পেরে উঠবে না। কারণ ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী মাছ কনজাম্পশনের দিক দিয়ে পর্তুগিজরা বছরে জনপ্রতি ৫৬ দশমিক ২৪ কেজি মাছ খেয়ে ইউরোপের প্রথম স্থানটি নিজেদের দখলে রেখেছে, যেখানে ইউরোপের অন্যান্য দেশের মানুষ খায় ২৪ দশমিক ৩৫ কেজি। ওদিকে সারা পৃথিবীর হিসাবে বর্তমানে ওরা আবার তৃতীয়। খাদক আর কাকে বলে! অবশ্য ফিচারগুলোতে পর্তুগিজদের  ‘মাছপ্রেমী’ অর্থাৎ ফিশ লাভার হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। আজকের গল্পটা এদেরই ‘মাছের রানি’ সার্দিনকে নিয়ে।  আজ সকালের নাস্তায় পোড়া সার্দিন খেলাম। মাছটি ধোয়া হয় না, সরাসরি গনগনে কয়লার ওপর দিয়ে একটু একটু করে লবণ ছিটিয়ে গ্রিল করা হয়। অলিভ অয়েল, সালাদ, রুচিমতো সস এসব দিয়ে পরিবেশন করা হয়। খেতে দুর্দান্ত রকমের ভিন্ন স্বাদ-কাঁটা-টা পর্যন্ত চিবিয়ে খাওয়া যায়! মাছের স্বাদ অনেকটা আমাদের ইলিশের মতো। মেঘনাপাড়ের মানুষ আমি। ছোটবেলায় আমরা যেমন গাপগুপ করে ইলিশ খেতাম। এখানে প্রচলিত কথা আছে, পর্তুগিজরা দিনে গড়পড়তা তেরোটি করে সার্দিন খায়। 

এটি এখানকার ট্র্যাডিশনাল ডিশ। সার্দিনের যে কত পদের ডিশ হয়, তার ইয়ত্তা নেই। তার মধ্যে পর্তুগালের সাতটি বিস্ময়কর খাদ্যবিলাসের একটি হচ্ছে এই ‘চারকোল গ্রিল বা কয়লায় পোড়ানো’ সার্দিন। যদিও এদেশের মাছের খাবারের রেসিপিগুলো এসেছে মূলত আরবদের হাত ধরে, তবু সার্দিন মাছের গল্পটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এদের একটি ‘কিংবদন্তি’। বেশ মজার গল্প, বলছি ।  সার্দিন নামটা এসেছে ইটালির সার্দিন দ্বীপ থেকে। একসময় সেখানকার সাগরজলেই মাছটির বসতবাটি ছিল। কিন্তু ওরা বাসা পাল্টিয়ে পর্তুগাল চলে আসার সিদ্ধান্ত নিল। লিসবনের প্যাট্রন সেইন্ট অ্যান্টনিও যখন ইটালিতে গিয়ে দুর্দশায় পড়লেন তখন থেকে।  সেইন্ট অ্যান্টনিও একজন রোমান ক্যাথলিক। জন্ম ১১৯৫ সালে। 

লিসবনে রাজার বাড়ি ‘ক্যাসল সাও জোয়া’কে ঘিরে পাহাড়চূড়ায় গড়ে ওঠা বসতি আলফামায় ঠিক ‘ছে ক্যাথেড্রাল’-এর সামনের বাড়িটিতে। পরে সেখানেই তার চার্চটি নির্মাণ করা হয়। মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে তিনি মারা যান। তিনি অত্যন্ত দয়ালু ও হৃদয়বান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি মধুর আচরণ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা-ভালোবাসার প্রতি বিশ্বস্ত থাকার নীতির জন্য ব্যাপকভাবে সমাদৃত ছিলেন। তার স্বল্পকালীন জীবনে তিনি বহু দম্পতির বিয়ে ও পারিবারিক বিরোধ মিটিয়েছিলেন; যার কারণে তাকে ‘বিয়ের যাজক’ নামেও অভিহিত করা হয়। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তার এ বৈশিষ্ট্যের প্রতি আস্থার বিষয়টি পরে বলছি। 

তিনি যখন ইটালির রিমিনি জনপদে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করতে যান, তখন নানা ধরনের দুর্ভোগের শিকার হতে থাকেন। তার দুর্দশা এমন চরমে ওঠে যে, কারো সাহায্য চাওয়া কিংবা কথা বলার মতো লোকও খুঁজে পাননি। তিনি একদিন সাগরতীরে বসে থাকার সময় কিছু মাছ দেখতে পেয়ে তাদের সঙ্গেই তার দুঃখ-দুর্দশার কথা বলতে শুরু করেন। তখন সাগরজলের  ছোট-বড়-দানবীয় সব ধরনের মাছ তীরে এসে তার করুণ কাহিনি শুনতে থাকে। ঘটনাটি স্থানীয়দের চোখে পড়ে এবং ধীরে ধীরে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়তে পড়তে একসময় জনশ্রুতিটি পর্তুগালেও এসে পৌঁছায়।

এদিকে সেইন্ট অ্যান্টনিওর ‘মৎস্যকথন’-এর কিছুদিনের মধ্যেই মিরাকেল ঘটতে থাকে পর্তুগালে আটলান্টিকের তীরে। জেলেদের জালে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ ধরা পড়তে শুরু করে। এত এত মাছ যে মানুষজন খেয়ে আর কূল করতে পারছে না। বিশেষ করে সার্দিন মাছ। জেলেরা তো বেজায় খুশি। সেই সঙ্গে রাজা-প্রজা সবাই খুশি, ঘরে ঘরে আনন্দ উৎসব শুরু হয়ে গেল। কিন্তু তারা কোনোভাবেই বুঝে উঠতে পারছে না-এত মাছ আসছে কোথা থেকে! একসময় মৎস্যকথনের জনশ্রুতিটি পর্তুগালে এসে পড়লে মানুষ ভাবতে ও বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, এই মাছের জোয়ার তাদেরই দেশের সন্তান ঈশ্বরের দূত সেইন্ট অ্যান্টনিওর পক্ষ থেকে ‘ঈশ্বরের উপহার’। তখন থেকে এদেশের মানুষ সেইন্ট অ্যান্টনিও এবং তার উপহার মাছকে সাদরে গ্রহণ করে সার্দিনকে বানিয়ে নেয় ‘মাছের রানি’। 

জনগণের বিশ্বাস এবং ভক্তি অতটুকুতেই থেমে থাকেনি; বরং মাছের এই প্রাচুর্য গোঁড়া। ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী পর্তুগিজদের নানা ধরনের উৎসব-আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে বর্ণাঢ্য রূপ ধারণ করে। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে যেমন সাধু-সন্ত, পীর-মুরশিদ, শিতলাতলা, বটতলা, লৌকিক-অলৌকিক নানা বিষয় বা ঘটনাকে কেন্দ্র করে মাজার-মঠ-মন্দির-মিথ গড়ে উঠেছে এবং এসবের সমন্বয়ে এলাকাভিত্তিক সংস্কার-কুসংস্কারের রীতিনীতি একধরনের ঐতিহ্য ও মেলা-উৎসবের জন্ম দিয়েছে- পর্তুগালেও ঠিক তেমনি নানা ধরনের ধর্মীয়-মিরাকেল কিংবদন্তির গল্প ও প্যাগান রীতিনীতির সমন্বয়ে এলাকাভিত্তিক উৎসব-আনুষ্ঠানিকতার প্রচলন হয়। ফলে মাছের প্রাচুর্যকে কেন্দ্র করে সারা বছর নানা উপলক্ষে ফিস্ট বা ভোজসভার আনুষ্ঠানিকতা চলতে থাকে। বিশেষ করে চার্চের আনুকূল্যে সাধু বা সেইন্টদের নামে এই পর্তুগালেই শতাধিক ফিস্ট বা ভোজনোৎসব রয়েছে। এখানে এসব অনুষ্ঠান জাঁকজমকভাবে পালিত হওয়ার আরও একটি মূল কারণ হচ্ছে, খ্রিস্টধর্মে ভোজনোৎসবের বিশেষ মর্যাদা থাকা এবং জনগণের ধর্মীয় আবেগ ও রীতিনীতির প্রতি বিশ্বাস। 

এছাড়া হরেক রকমের উৎসবকে নিয়ে সারা বছর মেলা তো লেগেই আছে। এসবের পেছনে বড় একটি প্রভাব কাজ করে, সেটি হচ্ছে বাণিজ্য। আর বাণিজ্যের মধ্যে পর্যটনে সেরা হচ্ছে পর্তুগাল। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, নানা ধরনের গল্পকথা মানে কিংবদন্তিগুলোকে কাজে লাগিয়ে সারা দেশকে সাজিয়েছে পর্তুগিজরা। যার আকর্ষণে বছরজুড়েই লেগে থাকে ট্যুরিস্টদের আনাগোনা। সেই সঙ্গে প্রকৃতিও উদারহস্তে পর্তুগালকে দিয়েছে চমৎকার একটি আবহাওয়া। 

যাক, যা বলছিলাম, আর কদিন পরই বড়দিনকে কেন্দ্র করে সার্দিন মাছ খাওয়ার উৎসব শুরু হবে। তারপর থেকে একের পর এক চলতে থাকবে সারা বছর ধরে। তুমি দেখবে আর অনুভব করবে রাস্তার মোড়ে মোড়ে, অলিতে-গলিতে পোড়া কয়লার ধোঁয়ার সঙ্গে সার্দিন মাছের সুবাসে বাতাস ভরে আছে। আঃ! কী সুঘ্রাণ! ছোটবেলায় মায়ের ইলিশ ভাজার সময়কার সুগন্ধির কথা মনে পড়ে যাবে। ট্যুরিস্টরা আসবে খোলা আকাশের নিচে বসে ফাদো সংগীত শুনতে শুনতে পোড়া সার্দিন খেতে আর বিচে গিয়ে রোদ পোহাতে। তবে কি, অলিতে-গলিতে যেখানেই পসরা সাজিয়ে বসুক, তারা কিন্তু আইন মেনে শৃঙ্খলা রেখে ব্যবসা করে। নো রাস্তা দখল নো জেনারেল পাবলিক চলাফেরায় ব্যাঘাত। আর পরিচ্ছন্নতা? আমাদের দেশের মতো যত্রতত্র কাদা, ময়লা, প্লাস্টিক আবর্জনায় ভরিয়ে রাখে না। আসলে এত পরিচ্ছন্ন পরিবেশ সবাইর ভীষণ পছন্দ হবে। 

এখানে শীতের রোদ আরও সুস্বাদু! পোহালে মনে থাকবে অনেক দিন। ওদিকে গ্রীষ্মের কড়া রোদের তো কথাই নেই, ওটা শীতের দেশের মানুষদের জন্য সবচেয়ে চমৎকার টনিক। তখন ট্যুরিস্টরা ঝাঁকে ঝাঁকে আসে। অবশ্য তাজা সার্দিন খেতে হলে আমাদের ইলিশের মতো মৌসুমে অর্থাৎ মার্চ থেকে অক্টোবরের মধ্যে আসতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি জুনে আসা যায়। এ সময়টা সার্দিনের ভরা মৌসুম। ১৩ জুন ফিস্ট অব সেইন্ট অ্যান্টনিও ডে-কে কেন্দ্র করে সার্দিন খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। এ সময় মাসব্যাপী অপরূপ সাজে সজ্জিত থেকে। ওইদিন লিসবনে বর্ণাঢ্য আয়োজনের একটি শোভাযাত্রা হয়। এটি সেইন্ট অ্যান্টনিও চার্চ থেকে শুরু হয়ে আলফামা অঞ্চল ঘুরে আবার সেই একই জায়গা ‘ছে ক্যাথেড্রালে’ এসে শেষ হয়। 

এর প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে, কমপক্ষে পনেরো থেকে কুড়িটি বিয়েইচ্ছুক জুটি বিয়ের সাজে সেজে শোভাযাত্রাটির নেতৃত্ব দিয়ে বিয়ে করতে এই গির্জায় আসে। আগেই বলেছি বিয়ের যাজক হিসেবে সমাদৃত সেইন্ট অ্যান্টনিওর কথা। এসব জুটি এই দিনে এভাবে বিয়ে করাটাকে মনে করে তাদের বিবাহিত জীবন সেইন্ট অ্যান্টনিওর আশীর্বাদে সুখী ও পরিপূর্ণ হবে। তাই সামার মানে এই সময়ে পর্তুগাল বেড়াতে এলে পোড়া সার্দিন, ঝিরিঝিরি বাতাসের কড়া রোদ উৎসব সবকিছু মিলিয়ে মনে রাখার মতো। স্মৃতি বেশি বই কম পাবে না। তবে লোকারণ্যের ভিড় একটু বেশি হবে, প্যানসাও (ভাড়া বাসা কিন্তু হোটেলের মতো) বা হোটেলগুলোতে রুম পাওয়া একটু কষ্টকরই হবে, খরচটাও বাড়বে। কিন্তু বিষয়-বৈচিত্র্য সবাইকে মুগ্ধ করবেই এটা আমি নিশ্চিত।

সময়ের আলো/আরএস/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close