দেশে চলমান উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি। এমনকি তৃণমূল থেকে সকল স্তরের নেতাকর্মীদের নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশগ্রহণেও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। তবে থেমে নেই বিএনপি নেতা-কর্মীরা। তারা গোপনে প্রার্থীদের সমর্থন দিয়ে যুক্ত হচ্ছেন প্রচার-প্রচারণায়ও। সম্প্রতি ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম এবং মঙ্গলবার দ্বিতীয় ধাপে বরিশালের চারটি উপজেলায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এমন একাধিক তথ্য উঠে আসে। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ছে তথ্য-প্রমাণ।
অভিযোগ রয়েছে, দলীয় সিদ্ধান্তের কারণে প্রকাশ্যে ভোটের বিরোধিতা করলেও গোপনে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন নেতারা। তবে এসব নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নেয়া হচ্ছে না সাংগঠনিক ব্যবস্থা। বরং স্থানীয় হাইকমান্ডের পৃষ্ঠপোষকতায় অভিযোগ থেকে পার পেয়ে যাচ্ছেন অভিযুক্ত নেতারা। তাই এ বিষয়ে কেন্দ্রের নেতাদের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন তৃণমূল নেতারা।
জানা গেছে, গত ৮ মে প্রথম ধাপে বরিশাল সদর উপজেলা এবং বাকেরগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া গত মঙ্গলবার (২১ মে) শেষ হয় হিজলা ও মুলাদী উপজেলা নির্বাচন। চার উপজেলায় চেয়ারম্যান এবং ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন আওয়ামী লীগ নেতারা। এ নির্বাচনে বিএনপির কোন নেতাকর্মী প্রার্থী না হলেও ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততার প্রমাণ মেলেছে নানাভাবে।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বাকেরগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের কয়েকটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে। মোস্তফা আল মাদানী এবং মুরাদ হোসেন রনি নামের দুটি ফেসবুক আইডিতে ছবিগুলো পোস্ট করা হয়। ছবি ট্যাগ করা হয়েছে দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবুল হোসেন খানসহ বিএনপির একাধিক নেতাকে।
ছবিতে দেখা যায়, বরিশাল দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও বাকেরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক জিয়াউল আহসান জুয়েলের বাড়িতে বসেই সদ্য নির্বাচিত চেয়ারম্যান রাজিব তালুকদারের নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
ছবির ক্যাপশনে দাবি করা হয়েছে, ভোটের দিন জিয়াউল আহসান জুয়েলের বাসায় বসেই চেয়ারম্যান প্রার্থী রাজিব তালুকদারের ভোটের স্লিপ ভোটারদের দেয়া হচ্ছে। বিষয়টি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। তাছাড়া ছবিতে ভোটের কার্যক্রম এবং ভোটারদের উপস্থিতিও লক্ষ্য করা যায়। এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও এসেছে সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকের কাছে।
অপরদিকে, ৮ মে বরিশাল সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ কর্মী হালিমা বেগম হ্যাপি। তাকে বিজয়ী করতে সক্রিয় ভূমিকা পালনের অভিযোগ উঠে সদর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও চরবাড়িয়া ইউনিয়নের সহ-সভাপতি গাজী জাকির হোসেন মিল্টনের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি তাদের এ সংক্রান্ত ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। যদিও নির্বাচিত হওয়া হ্যাপি মিল্টনের আপন বোন বলে জানা গেছে।
এদিকে, নিজ বাড়িতে চেয়ারম্যান প্রার্থী রাজিব তালুকদারের নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগ অস্বীকার করে বাকেরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য জিয়াউল আহসান জুয়েল বলেন, ‘যেখানকার ছবি ফেসবুকে পোস্ট করা হয়েছে, সেটা কোন বাড়ি নয়। ওটা আমাদের পারিবারিক বৈঠকখানা। সেখানে আমি ছাড়াও আরও অনেকের ছবিও আছে।’
তিনি বলেন, ‘বৈঠকখানা থেকে কৃষ্ণকাঠি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রের দূরত্ব একেবারেই কম। ভোট চলাকালে বৃষ্টি নামায় কেন্দ্রের পাশে থাকা একজন প্রার্থীর কর্মীরা ভোটার স্লিপ নিয়ে বৈঠকখানায় ঢুকে পড়ে। তবে ভোটের দিন থেকে অন্তত ২৫ দিন আমি বরিশাল শহরের বাড়িতেই ছিলাম। বিষয়টি উপজেলা, জেলা এবং আমাদের টিম লিডার তদন্ত করে দেখেছে। তারা অভিযোগের প্রমাণ পায়নি।’
তিনি দাবি করেন, ‘যেই ছেলে ফেসবুকে ছবি পোস্ট করেছে, সে ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি ছিলো। সংসদ নির্বাচনের সময় সে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করে। এজন্য জেলা স্বেচ্ছাসেবক দল তাকে বহিষ্কার করে। তার বহিষ্কার ঠেকাতে আমি কেন সুপারিশ করিনি, সেজন্য এখন আমার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেছে।
তবে বিএনপির স্থানীয় নেতাদের অভিযোগ, জিয়াউল আহসান জুয়েল দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবুল হোসেন খানের ঘনিষ্ঠজন। এ কারণে লোক দেখানো তদন্তের মাধ্যমে বিষয়টি ধামাচাপা দেয়া হয়েছে। তাই এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের সুদৃষ্টি কামনা করেন তারা।
এ প্রসঙ্গে দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবুল হোসেন খান বলেন, ‘ফেসবুকে ছবিগুলো দেখে আমি নিজেই হতবাক হয়েছিলাম। তাই নিজেই ঘটনাস্থলে গিয়ে বিষয়টি তদন্ত করেছি। দেখলাম জিয়াউল আহসান জুয়েলের বাড়ি থেকে ভোট কেন্দ্রের দূরত্ব মাত্র এক-দেড়শ ফুটের মধ্যে। ভোট কেন্দ্রের পাশে পুকুরের ঘটনায় বসে একজন প্রার্থীর পক্ষে ভোটার স্লিপ দেয়া হচ্ছিল। বৃষ্টির কারণে তারা ওই বাড়িতে ঢুকে পড়ে। তাছাড়া জুয়েল বাড়িতে থাকে না। তার বাড়িতে দুজন কাজের লোক থাকে।
তিনি বলেন, ‘যে ছবি প্রকাশ করা হয়েছে, তা দিয়ে অভিযোগ প্রমাণিত হয় না। কেননা আমার বাড়ির দেয়ালেও অনেক প্রার্থীর পোস্টার লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। এর মানে এটা দাঁড়ায় না যে, আমি প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছি। তাছাড়া ক্ষতি আছে জেনেও সে যদি কাজটি করেই থাকে, তবে সেটা গোপনে না করে প্রকাশ্যে কেন করলো সে প্রশ্নও থেকে যায়। তাই সার্বিক দিক বিবেচনা করে জিয়াউল আহসান জুয়েলকে লিখিতভাবে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
এদিকে, গোপনে এবং প্রকাশ্যে প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করা নেতাকর্মীদের তালিকা এবং শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে দক্ষিণ জেলা বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘গত ২০ বছর দল ক্ষমতায় নেই। নেতাকর্মীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হলে তারা যাবে কোথায় মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নেতাকর্মীদের সতর্ক করা হয়েছে। তাছাড়া আমরা বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করে কোন নেতাকর্মীকেই খুঁজে পাইনি। এখন গোপনে কেউ কাজ করলে প্রমাণ ছাড়াতো আর তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব না।’
সময়ের আলো/আরআই