ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

রাইসির জানাজায় মানুষের ঢল
গাজার যুদ্ধ-কূটনীতি ক্ষতিগ্রস্ত
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২৩ মে, ২০২৪, ৩:২১ এএম  (ভিজিট : ৪১২)
ইরানের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি আর তার সফরসঙ্গীদের জানাজায় অংশ নিয়েছে কয়েক লাখ মানুষ। জানাজায় ইমামতি করেছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। এদিকে রাইসির মৃত্যুর পর গাজায় যুদ্ধ বন্ধের এক আলোচনা স্থবির হয়ে পড়েছে বলে খবর মিলেছে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, এ মৃত্যু ইরানের কট্টরপন্থাকে আরও সংহত করবে।

জানাজায় মানুষের ঢল : গত মঙ্গলবার তাবরিজ, কোম এবং তেহরানের গ্র্যান্ড মোসাল্লা মসজিদে কয়েক হাজার মানুষের উপস্থিতিতে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট রাইসিসহ তার সফরসঙ্গীদের শ্রদ্ধা জানানো হয়। নিহতদের কফিনে ইরানের পতাকায় মোড়ানো ছিল। গতকাল বুধবার সকালে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে ইব্রাহিম রাইসিসহ দুর্ঘটনায় নিহত আটজনের মরদেহের কফিন নিয়ে যাওয়া হয়।

ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরো প্রধান ইসমাইল হানিয়া এবং লেবানিজ হিজবুল্লাহ প্রতিরোধের ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল শেখ নাইম কাসেমসহ ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অক্ষের নেতারা জানাজায় উপস্থিত ছিলেন। আরও ছিলেন বিভিন্ন দেশের নেতা, রাষ্ট্রপতি, রাষ্ট্রদূত এবং আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব।

রাইসির জানাজাকে কেন্দ্র করে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজাদি স্কয়ার পর্যন্ত লাখ লাখ জনতার ঢল নামে। এর আগে প্রেসিডেন্ট রাইসি এবং তার সহযোগীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মঙ্গলবার গভীর রাতে তেহরানের ইমাম খোমেনি মোসাল্লায় একটি শোক অনুষ্ঠানে জনস্রোত নেমেছিল।

ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ কুরআনের ভাষা আরবিতে নিহতদের জন্য প্রার্থনা করা হয়। প্রার্থনায় খামেনি বলেন, ‘হে আল্লাহ, আমরা তার ভালো কাজ ছাড়া আর কিছুই দেখিনি।’ প্রার্থনার সময় ইরানের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ মোখবার পাশে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে কেঁদে ফেলেন। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে রাইসিকে আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে ইরানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর মাশহাদে দাফন করা হবে।

গাজায় যুদ্ধ বন্ধের আলোচনা স্থবির : ওমানে ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এক গোপন আলোচনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছিল। মিডল ইস্ট আই বলছে, এখন ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি এবং তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আকস্মিক মৃত্যুর কারণে তা বিপন্ন হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট ৩ ইরানি সূত্র মিডল ইস্ট আইকে জানায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সিনিয়র মধ্যপ্রাচ্য উপদেষ্টা ব্রেট ম্যাকগার্ক এ মাসের শুরুতে পশ্চিমের সঙ্গে সংলাপের ব্যাপারে ইরানের আলি বাগেরি কানির সঙ্গে পরোক্ষ আলোচনা করেছিলেন। আলোচনাটি মাস্কাটে হয়েছিল, যেখানে এক দশক আগে তেহরান এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে গোপন বৈঠকের আয়োজন হয়েছিল। ওই আলোচনার কারণেই ২০১৫ সালে (জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন) পারমাণবিক চুক্তি হয়েছিল।

জানুয়ারি থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে প্রথম দফা আলোচনা শুরু হয়েছিল। আলোচনার ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র মিডল ইস্ট আইকে বলেছে যে বাঘেরি কানি এবং ম্যাকগার্কের মধ্যে আলোচনা ভালোভাবে এগিয়ে চলেছে এবং তারা কিছু চুক্তিতে পৌঁছানোর কাছাকাছি ছিলেন।

বাঘেরি কানি সে সময় উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। তবে রোববারের হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় রাইসিসহ হোসেইন আমির-আব্দুল্লাহিয়ানের মৃত্যুর পর তিনি এখন ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী। যুক্তরাষ্ট্র-ইরান আলোচনায় প্রাধান্য পায় তিনটি বিষয়। প্রথমত, ইসরাইলে সরকার পরিবর্তনের জন্য একটি যৌথ ইচ্ছা। দ্বিতীয়ত, গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধের সমাপ্তি এবং তৃতীয়ত সংঘাত যেন পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে না পড়ে। ইরানের শাসক সংস্থার ঘনিষ্ঠ একজন বিশ্লেষক মিডল ইস্ট আইকে বলেছেন, আলোচনাটি একদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যদিকে ইরান এবং তার মিত্রদের মধ্যে যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার একটি উপায় হিসেবে কাজ করতে চেয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

রাইসির মৃত্যুর পর ইরানে ৫০ দিনের মধ্যে একটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে হবে। মিডল ইস্ট আই বলছে; অনিশ্চিত এ সময়ে বৈদেশিক নীতির বড় ধরনের বদলের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্ভাবনা কম। এদিকে নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা। বিশ্লেষকরা তাই মিডল ইস্ট আইকে বলেছেন, গাজা যুদ্ধের সমাপ্তি কিংবা পরমাণু আলোচনা; দুই-ই পিছিয়ে গেল রাইসির মৃত্যুর কারণে।

পরমাণু আলোচনাও স্থবির : ৭ অক্টোবর ইসরাইলের ওপর হামাসের হামলা এবং পরবর্তীতে গাজায় আগ্রাসন শুরুর পর থেকে ইরানের মিত্ররা (ইয়েমেনের হুথি আন্দোলন ও ইরাকি আধাসামরিক বাহিনী) এ অঞ্চলে মার্কিন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে। দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে রিপাবলিকান গার্ড কমান্ডারদের হত্যার প্রতিক্রিয়ায় ইরান যখন ইসরাইলের ওপর ব্যাপক হামলা চালায় তখন ইরানি ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকেও মার্কিন বাহিনীর দ্বারা গুলি করা হয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এবং তেল নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার বিষয়েও আলোচনা হতে পারত বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

পরমাণু চুক্তি ইরানে নিষেধাজ্ঞা উপশমের বিনিময়ে তেহরানের পারমাণবিক উন্নয়ন কর্মসূচির লাগাম টানতে সক্ষম হয়েছিল। ট্রাম্প প্রশাসন ২০১৮ সালে একতরফাভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এ চুক্তি থেকে থেকে প্রত্যাহার করার পরে চুক্তিটি ভেঙে যায়। যাই হোক, গত বছর ওয়াশিংটন ও তেহরান বন্দিবিনিময়ে সক্ষম হয়। তেলের রাজস্ব বাবদ ইরানের ৬ বিলিয়ন ডলার যুক্তরাষ্ট্র তাদের ফিরিয়ে দেয়।

সূত্রের দাবি অনুযায়ী, মাস্কাট আলোচনা শুরুর আগে ম্যাকগার্ক জাতিসংঘে ইরানের দূত সাইদ ইরাভানির সঙ্গে দেখা করেন। এক সূত্রের ভাষ্য ম্যাকগার্ক বাইডেনকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, ‘আমি মার্কিন নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত ইরানের সঙ্গে একটি পারমাণবিক এবং ব্যাপক চুক্তির জন্য আলোচনা করব না; কারণ ইরানিরা তাদের প্রতিশ্রুতি রাখতে পারে না।’

২০২১ সালে বাইডেন ট্রাম্পকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসার পর ২০২২ সালে পরমাণু চুক্তির পুনরুজ্জীবন ঘটাতে চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে তেহরান তা প্রত্যাখ্যান করে। ম্যাকগার্কের দাবি, বাইডেন তাকে বলেছেন যে ইরানের এ ভূমিকার কারণে রিপাবলিকানদের কাছে অনেক কথা শুনতে হয়েছে তাদের। বাইডেনের ইচ্ছে, তার দেশের নির্বাচনের পর এ নিয়ে আবার আলাপ শুরু করবেন।

এদিকে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা আইএইএ-ও বলছে, রাইসির মৃত্যু পরমাণু আলোচনাকে স্থবির করবে। রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মৃত্যু পরমাণু আলোচনায় দেরির কারণ হবে। ‘তারা এখন শোকের মধ্যে আছে, যা বিবেচনায় নেওয়া জরুরি।’ রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন তিনি।

কট্টরপন্থা পোক্ত হওয়ার আশঙ্কা : রাইসির মৃত্যুতে দেশটির রাষ্ট্রীয় নীতিতে খুব বেশি পরিবর্তন আসবে না বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা। গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইরানবিষয়ক পরিচালক আলি ভায়েজ নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ইরানের রাষ্ট্রীয় পদ্ধতি এমন এক পথে চলে যেখানে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার পরিবর্তন হলেও তা ভবিষ্যতের নির্দিষ্ট লক্ষ্যের পথেই এগোতে থাকবে। তিনি একে ‘কট্টরপন্থি দৃষ্টিভঙ্গি’ বলে উল্লেখ করেন। এর আওতায় দেশটির পররাষ্ট্রনীতি, আঞ্চলিক সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন ও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য যন্ত্রাংশ তৈরির লক্ষ্য থেকে তারা বিচ্যুৎ হবে না। বিশ্লেষক ভায়েজ বলেন, যাকেই পরবর্তী প্রেসিডেন্ট পদে বসানো হোক, তাকে এ দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে।

বিশ্লেষক লীনা খতিব দ্য গার্ডিয়ানে লিখেছেন, রাইসি মধ্যপন্থী ছিলেন না বটে। তবে তার মৃত্যু ইরানে কট্টরপন্থাকে আরও পোক্ত করতে পারে। ‘রাইসির মৃত্যু ইরানে উত্তরাধিকার বিষয়ে সিদ্ধান্ত ত্বরান্বিত করতে কাজ করবে। তবে এটি তেহরানের জন্য রাজনৈতিক দিক পরিবর্তনের কারণ হবে না; না আন্তর্জাতিক, না অভ্যন্তরীণভাবে। সবমিলিয়ে ইরানের শাসনব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ বৃত্ত সঙ্কুচিত হতেই থাকবে। শাসনের আমলাতান্ত্রিক এবং সামরিক উপাদানগুলো আগের চেয়ে বরং আরও শক্তভাবে একত্রিত হবে।’ লিখেছেন তিনি।

সময়ের আলো/আরএস/ 





https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close