ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

বুড়িগঙ্গার পানিতে উৎকট দুর্গন্ধ
প্রকাশ: বুধবার, ২২ মে, ২০২৪, ৮:২৬ এএম  (ভিজিট : ৩৬০)
এক সময় বুড়িগঙ্গায় ছিল স্বচ্ছ টলটলে পানি। মৃদু ঢেউয়ের তালে চলত পালতোলা নৌকা। নির্বিঘ্নে বুড়িগঙ্গার বুকে চলেছে স্টিমার-লঞ্চ। দুই তীরের মানুষ নদীতে মাছ ধরেছে। জলজ প্রাণী বসবাস করেছে স্বাচ্ছন্দ্যে। বিকেলে, সন্ধ্যায় মানুষ বুড়িগঙ্গার পাড়ে আড্ডা জমিয়েছে। বুড়িগঙ্গা ঢাকাবাসীকে ইলিশ মাছও উপহার দিয়েছে। সেই প্রাণোচ্ছল নদী অত্যাচারে-অনাচারে, দূষণে-বিষণে এখন মৃতপ্রায়। এখন বুড়িগঙ্গার তীরে নাক চেপে ধরে হাঁটতে হয়। ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা নদী এখন নিথর। দূষণে নদীর পানি দুর্গন্ধময় এবং আলকাতরার মতো কালো হয়ে গেছে। মানববর্জ্যরে পাশাপাশি শিল্পবর্জ্য, হাসপাতালের বর্জ্য ও পলিথিন ইত্যাদির কারণে বুড়িগঙ্গা দূষিত বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। এক সময় যে নদী মাছে ভরপুর ছিল, এখন সেখানে শুধু বিষাক্ত কালো পানির উৎকট গন্ধ।

জানা গেছে, বুড়িগঙ্গা নদীর অন্তত তিন শতাধিক পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিন ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের হাজার হাজার টন বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। এ ছাড়া পলিথিন ও প্লাস্টিক রিসাইক্লিং কারখানা বর্জ্য, শতাধিক ডায়িং কারখানার বর্জ্য এবং কেরানীগঞ্জের বাসাবাড়ির বর্জ্য গভীর রাতে ময়লার ভ্যান দিয়ে নদীতে ফেলায় এ দুর্গন্ধ আরো বাড়ছে। এমনকি ময়লা পানি ও দুর্গন্ধে নদীটিতে সাকার ফিশরাও নেই।

এছাড়া হাজারীবাগের কিছু চামড়া কারখানার দূষণের সাথে কামরাঙ্গীরচর, ইসলামবাগ, পোস্তা, লালবাগসহ নদীর পাড়ে অবস্থিত কয়েক শ’ পলিথিন ও প্লাস্টিক রিসাইক্লিং কারখানা, কেরানীগঞ্জের দুই শতাধিক ড্রাইং কারখানাসহ হাজারেরও অধিক বিভিন্ন কারখানা এবং শ্যামপুর, পাগলা-ফতুল্লা এলাকায় শত শত কারখানা থেকে ক্যামিকেল মিশ্রিত পানি নদীতে মিশে পানি দূষিত হচ্ছে। তবে স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন অবৈধ কলকারখানার বর্জ্য সবচেয়ে বেশী নদীতে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। এমনকি নদীর দু’পাড়ের গৃহস্থালির বর্জ্য ও স্থাপনা ভাঙ্গা সুড়কিও নিক্ষেপ করা হচ্ছে। বছরের পর বছর হাজার হাজার টন টন বর্জ্য নদীতে নিক্ষেপ করলেও নির্বিকার সংশ্লিষ্ট সংস্থা পরিবেশ অধিদফতর। ড্রেনের পানি পরিশোধনের পর নদীতে নিক্ষেপের বিধান থাকলেও এখন পর্যন্ত ঢাকায় বর্জ্য ট্রিটমেন্টের জন্য কোনো তরল বর্জ্য শোধনাগার স্থাপন করতে পারেনি ওয়াসা ও সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ।

কেরানীগঞ্জের চর কালিগঞ্জ, জিনজিরা ও আগানগর এলাকার ব্যবসায়ী সোহেল হোসেন, সোহেল আহমেদ ও বাদশা মিয়াসহ একাধিক ব্যক্তি সময়ের আলোকে বলেন, নদীর পানির অসহনীয় দুর্গন্ধে এখানকার মানুষ দিশেহারা। বুড়িগঙ্গা নদী তীরের এলাকাজুড়ে উৎকট গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। তাছাড়া কাশি, শ্বাসকষ্ট, বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ সবসময় লেগেই থাকে। বেশি সমস্যায় পড়ছে শিশু ও বৃদ্ধরা।

স্থানীয়রা জানায়, নদীপাড়ের মহল্লা থেকে ভ্যানগাড়িযোগে ময়লা এনে নদীতে ফেলা হচ্ছে। তা ছাড়া পানি বাড়ার সাথে সাথে ময়লা আবর্জনাও বেশি ফেলা হচ্ছে নদীতে। এমন হাজার হাজার কারখানা থেকে কেমিক্যাল মিশ্রিত তরল বর্জ্য ও বিভিন্ন সংস্থার ড্রেনেজ বর্জ্য দেদারছে নদীতে গিয়ে মিশছে।

২০ বছর ধরে চকবাজারে ব্যবসা করেন মো. লিয়াকত আলী। থাকেন কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যায়।  তিনি সময়ের আলোকে বলেন, আমি প্রতিদিনই নৌকা দিয়ে ২বার করে নদী পারাপার হই। বর্ষকালে নদীর পানি বেশী থাকায় পরিষ্কার থাকে। আর বর্ষা যেতে না যেতেই পানির রং কালো হয়ে যায়। আর দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে। এছাড়া নৌযানগুলো থেকে উপর্যুপরি পোড়া তেলসহ নানা বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীতে। শুষ্ক মৌসুম শুরু হতেই এসব এলাকার মানুষ মশা-মাছির উপদ্রব ও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

এদিকে, নদীতে সংযুক্ত স্যুয়ারেজ লাইনের মুখে ‘ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট’ না থাকায় কোটি কোট মানুষের মলমূত্র বুড়িগঙ্গার জলে মিশে। গত ১৮ মার্চ ওয়াইজঘাট এলাকায় একটি স্যুয়ারেজ লাইনের মুখে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট তৈরি করে এ প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী। গত এক বছরে প্রকল্পটির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটেনি। ফলে ইতোমধ্যেই নদীর মিঠা পানির সুস্বাদু মাছ ও বিভিন্ন জলজপ্রাণীর মৃত্যু হয়েছে। প্রতি বছর বুড়িগঙ্গায় সাকার ফিস নামে রাক্ষুসে মাছে টইটম্বুর থাকে। মাঝিদের বৈঠায়ও লাগে মাছের আঘাত। অথচ এ বছর এখনো কোনো সাকার মিলছে না।

কয়েকজন মাঝির সাথে প্রতিবেদকের কথা হলে তারা জানান, রাতের আঁধারে কেরানীগঞ্জ মডেল টাউন ও ইস্পাহানী আবাসিক এলাকার হাজারখানেক বাড়ির ময়লা ও আবর্জনা ফেলছে নদীতে। ময়লা ফেলার জায়গা না থাকায় এমনটা করছে তারা। মাঝিরা আরও জানান, এক সময়ে সাকারের উৎপাত দেখা গেলেও ময়লা পানি এবং বেশি দুর্গন্ধ থাকায় এখন আর দেখা মিলছে না সাকার মাছের। শুকনো মৌসুমে বুড়িগঙ্গায় সাকার মাছ থাকে না। এ সময়ে নদীর পানি কম থাকে এবং পানিতে দুর্গন্ধ থাকায় সাকার চলে যায় বড় নদীতে।

সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, আগানগর, চরকালীগঞ্জ, খেজুরবাগ, কালীগঞ্জ, হাসনাবাদ, দোলেশ্বর, খোলামুড়া, বরিশুর, মান্দাইল, জিনজিরা, ইস্পাহানী, পটকা জোর ও মীরেরবাগ এলাকা ঘিরে গড়ে ওঠেছে শতাধিক ইটিপিবিহীন ডায়িং কারখানা। তার মধ্যে বারবার যাদের জেল জরিমানা করা হয়েছে, এসব কারখানার মধ্যে গ্লোবাল ওয়াশিং, আধুনিক ওয়াশিং, কালারটাচ ওয়াশিং, মায়ের দোয়া ওয়াশিং ডাইং, সততা ওয়াশিং ডাইং, রিমা ওয়াশিং প্লান্ট, সায়মা ওয়াশিং প্লান্ট, সানমুন ওয়াশিং প্লান্ট, গ্লোবাল ওয়াশিং ডাইং, শ্রাবণী ওয়াশিং ডাইং, এফ এম ওয়াশিং ডাইং, সারা প্রিন্টিং, ফোর স্টার ওয়াশিং প্লান্ট, আল বারাকা ওয়াশিং ডাইং ও বিসমিল্লাহ ডাইং প্লান্টসহ শতাধিক কারখানার বর্জ্য নিয়মিত বুড়িগঙ্গার পানিতে মিলছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে পরিবেশ অধিদফতর এবং উপজেলা প্রশাসন অভিযান চালালেও দুই তিন দিন পর ফের অবৈধ কল কারখানাগুলো ঠিকই চলছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির বলেন, 'কারখানার অপরিশোধিত রাসায়নিক বর্জ্য ও সিটি করপোরেশনের বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় ফেলা হচ্ছে নিয়মিত। আমরা নানা সময় বিষয়টি নিয়ে সিটি করপোরেশন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে কথা বলেছি। আসলে তারা কেউই কার্যকারী ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এ নিয়ে কারও আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের শরিফ জামিল বলেন, একসময়ের দূষণমুক্ত ও খরস্রোতা বুড়িগঙ্গা কল-কারখানা ও মানবসৃষ্ট বর্জ্যের কারণে প্রায় মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে এখানে কোনো মাছ কিংবা জলজ জীবের অস্তিত্ব থাকে না। আমরা একে জৈবিকভাবে মৃত অবস্থা বলি।

কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার  ইউএনও মো. আবু রিয়াদ বলেন, ডিসি মহোদয়ের নির্দেশনা রয়েছে যাতে করে কোনো কলকারখানা ইটিপিবিহীন অবস্থায় চলতে না পারে। বুড়িগঙ্গা দূষণে জড়িতদের কোনোভাবে ছাড় দেয়া হবে না। ওইসব অপরাধীদের শাস্তি দিতে শিগগিরই অভিযানে নামবে উপজেলা প্রশাসন।

পরিবেশ অধিদফতর মহাপরিচালক ডক্টর আবদুল হামিদ বলেন, পরিবেশ দুষ্কৃতকারীদের ছাড় দেয়া হবে না। বিভিন্ন সময়ে অবৈধ কল কারখানার বিরুদ্ধে অভিযান চালায় পরিবেশ অধিদফতর। এ সময় জেল জরিমানাও করা হয়ে থাকে। তারপরও যদি কোনো কারখানা নদী দূষণে জড়িতের অভিযোগ মিলে তাহলে ওইসব কারখানার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এসব বিষয়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান সারোয়ার মাহমুদ জানান, কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে নদী রক্ষা কমিশন কাজ করছে। অচিরেই বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলসহ অন্যান্য নদী দখল ও দূষণের কবল থেকে উদ্ধার হবে। তাই মনিটরিং করা হচ্ছে। এজন্য নদীরক্ষা কমিশনের নিজস্ব লোকবল, মেশনারিজ ও তদারকির ক্ষমতা বাড়ানো দরকার। তিনি বলেন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে জেল জরিমানা করলেও ফের আবার ওইসব নদী দূষণ অপরাধীরা যাতে পার পেয়ে না যায় সে বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছি।


সময়ের আলো/এএ/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close