ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ পায়রায়
প্রকাশ: বুধবার, ২২ মে, ২০২৪, ৭:২৩ এএম  (ভিজিট : ৪৪২)
সরকারের ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত পায়রা বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নে নেওয়া প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এ ব্যয়ের মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা অনিয়ম হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। অর্থাৎ মোট ব্যয়ের ৫০ শতাংশেরও বেশি টাকা নয়ছয় হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

পরিবহন অডিট অধিদফতরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এসব অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের লেনদেনের ওপর করা নিরীক্ষায় মোট ১৩টি আপত্তি উঠে আসে। এর মধ্যে তিনটি আপত্তি নিষ্পত্তির তথ্য পাওয়া যায় নথি বিশ্লেষণে। যদিও প্রকল্প পরিচালক বলছেন ১০টি আপত্তি নিষ্পত্তি হয়েছে।

পরিবহন অডিট অধিদফতরের প্রতিবেদন ও প্রকল্প পরিচালকের দফতর সূত্রে জানা গেছে, পায়রা বন্দরের কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন (ডিআইএসএফ) শীর্ষক প্রকল্পটির বিভিন্ন কাজে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত মোট ৩ হাজার ৭৫২ কোটি ১৩ লাখ ৫৭ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। এর আগে পরিবহন অডিট পরিদফতরের নিরীক্ষায় ১৩টি আপত্তি উঠে আসে। এসব আপত্তির সঙ্গে সম্পর্কিত মোট অর্থের পরিমাণ ১ হাজার ৮৯১ কোটি ২৭ লাখ ৩৭ হাজার ৪৭৪ টাকা। অর্থাৎ মোট ব্যয়ের ৫০ দশমিক ৪০ শতাংশ অর্থই অনিয়ম হয়েছে।

গত ফেব্রুয়ারিতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) একজন উপপরিচালক এ প্রকল্প পরিদর্শনে যান। পরিদর্শন শেষে তিনি আইএমইডিতে যে প্রতিবেদন জমা দেন তাতে অনিয়মের বিষয়ে বলা হয়, ডিআইএসএফ প্রকল্পটি ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত। শুরু থেকে জুন ২০২২ পর্যন্ত সময়ে পরিবহন অডিট অধিদফতরের মাধ্যমে ১৩টি অডিট আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে। 

২০২১-২২ অর্থবছরের পরিবহন অডিট অধিদফতরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আপত্তির বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রকল্পে উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতির পরিবর্তে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে অদক্ষ ঠিকাদারের মাধ্যমে কার্য সম্পাদনে অনিয়মিত ব্যয় হয়েছে ২২৬ কোটি ৩৩ লাখ ৭১ হাজার ৩৬৬ টাকা।

একটি টাগবোট ক্রয়ে ১৮ মাসের মধ্যে সরবরাহের চুক্তি করে ১২ মাস সময় বৃদ্ধি করা হয়। এরপর অনুমোদিতভাবে ৩৬ মাস অতিবাহিত হলেও টাগবোট প্রাপ্তি ছাড়াই বিল পরিশোধ করায় অনিয়মিত ব্যয় ৩০ কোটি ৮৯ লাখ ৪৮ হাজার টাকা।

অধিগ্রহণ করা ভূমিতে থাকা ঘরবাড়ি, গাছপালা ও অন্যান্য স্থাপনা নিলামে বিক্রি না করায় আর্থিক ক্ষতি ১৭ কোটি ৬৬ লাখ ৯০ হাজার ৯১৩ টাকা।

নিলামে বিক্রি না করে বিনামূল্যে ঘরবাড়ি, গাছপালা ও অন্যান্য স্থাপনা অপসারণ করায় ভ্যাট ও আয়কর বাবদ সরকারের আর্থিক ক্ষতি ১ কোটি ৭৬ লাখ ৬৯ হাজার ৯২ টাকা।

অগ্রিম বিল পরিশোধের সময় আয়কর ও ভ্যাট কর্তন না করায় এবং অন্যান্য বিল পরিশোধকালে নির্ধারিত হার অপেক্ষা কম হারে ভ্যাট কর্তন করায় আর্থিক ক্ষতি ২৬ কোটি ২ লাখ ৬৭ হাজার ২০৬ টাকা।
মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে বিলম্ব জরিমানা বা লিকুয়েডেটেড ড্যামেজ কর্তন ব্যতীত বিল পরিশোধ করায় আর্থিক ক্ষতি ৯০ লাখ ২০ হাজার ২৫ টাকা।

প্রকৃত আয়তন অপেক্ষা অতিরিক্ত আয়তনে ইম্প্রুভ সাবগ্রেডের পরিমাণ প্রাক্কলনে অন্তর্ভুক্ত করে বিল পরিশোধ করায় আর্থিক ক্ষতি ১৫ লাখ ৬৬ হাজার ৫১০ টাকা।

পিপিআর ২০০৮ এবং চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে সাব কন্ট্রাক্টরের মাধ্যমে কার্য সম্পাদন করে অনিয়মিত ব্যয় ১ হাজার ৫৮৩ কোটি ১৬ লাখ ৪ হাজার ২০৫ টাকা।

বাংলাদেশ ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআইডব্লিউটিএ) সঙ্গে সমন্বয় না করে প্রয়োজনীয়তা নিরূপণ ব্যতীত বার্থিং-আনবার্থিংয়ের জন্য ইয়ার্ড ও জেটি নির্মাণের আগেই সংযোগ নদীর ড্রেজিং সম্পন্ন করে বিল পরিশোধ করায় সংস্থার আর্থিক ক্ষতি ২২৭ কোটি ৫৯ লাখ ৯১ হাজার ৫৪৭ টাকা।

অনিষ্পত্তি এসব আপত্তিতে জড়িত অর্থের পরিমাণ ১ হাজার ৮৮৬ কোটি ৯১ লাখ ৩৭ হাজার ৩১৭ টাকা। এ ছাড়া আরও তিনটি আপত্তি নিষ্পত্তি হয়েছে বলে সবশেষ নথি সূত্রে জানা গেছে।

এসব নথিতে অভিযোগের বিষয়ে বলা হয়েছে, পিপিআর ২০০৮ এবং চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে ঠিকাদারের মাধ্যমে বীমা করা হয়নি এবং বীমা না করায় প্রিমিয়ামের ভ্যাট বাবদ রাজস্ব ক্ষতি ১ কোটি ২২ লাখ ৪৯ হাজার ১০৮ টাকা।

ডিপিপিতে সংস্থান করা অর্থ অপেক্ষা অধিক মূল্যে চুক্তি সম্পাদন করে বিল পরিশোধ করায় আর্থিক ক্ষতি ২০ কোটি ৪৮ লাখ ৯৬ হাজার ৭৭২ টাকা।

চুক্তি করা পরিমাণ অপেক্ষা অধিক পরিমাণের বিল পরিশোধ করায় আর্থিক ক্ষতি ১ কোটি ১১ হাজার ৩৭২ টাকা।

প্রকল্পের উদ্দেশ্যের বিষয়ে ডিপিপিতে বলা হয়েছে, পায়রা বন্দরের ন্যূনতম অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে সীমিত আকারে বন্দরের কার্যক্রম চালু করা এবং একটি পূর্ণাঙ্গ বন্দর গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় ভূমি অধিগ্রহণ; ভূমি অধিগ্রহণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত আনুমানিক সাড়ে ৩ হাজার পরিবারের পুনর্বাসন ও ৪ হাজার ২০০ জনের প্রশিক্ষণ; জাতীয় মহাসড়ক এন-৮-এর সঙ্গে পায়রা বন্দরের যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে ৫ দশমিক ২২৩ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ এবং আউটার বার ও নদীপথে চিহ্নিত বারগুলোর প্রয়োজনীয় ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ নৌপথের মালামাল ও কন্টেইনার পরিবহন নিশ্চিত করা।

প্রকল্প পরিচালক ক্যাপ্টেন এম মনিরুজ্জামান সময়ের আলোকে বলেন, ‘অডিট আপত্তি পুরোনো বিষয়। যে পরিমাণ কাজ হয়েছে তার চেয়ে বেশি আপত্তি উঠেছে। অডিট আপত্তি অনিয়মের প্রমাণ নয়। এগুলোর বিষয়ে জবাব দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ১০টি আপত্তি নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকিগুলোও শিগগিরই নিষ্পত্তি হয়ে যাবে।’

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সময়ের আলোকে বলেন, নিয়ম হচ্ছে কাজ বুঝে পাওয়ার পর অর্থ ছাড় করবে। তার আগে যদি অর্থ ছাড় করে তা হলে সেটা অনিয়ম। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুল মেনে কাজ করতে হবে। যেসব অডিট আপত্তি উঠে এসেছে সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। 

তিনি বলেন, অডিট আপত্তিতে যেসব বিষয় উঠে আসে তার মধ্যে বেশিরভাগই পরে নিষ্পত্তি হয়ে যায়। যেসব অভিযোগ থাকে সেগুলো প্রমাণ হতে অনেক সময় লাগে। এর মধ্যে অনেক কর্মকর্তা বদলি হয়ে যান, আবার অনেকে চাকরি থেকে অবসরে চলে যান। ফলে তাদের শাস্তির আওতায় আনা যায় না। এ জন্য অডিট আপত্তি দ্রুত নিষ্পত্তিতে ব্যবস্থা নিতে হবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সময়ের আলোকে বলেন, জনগণের কল্যাণের উদ্দেশ্যে উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়ে থাকে। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নের সুযোগ নিয়ে কিছু ব্যক্তি প্রতারণা ও অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে নিজেদের সম্পত্তি বৃদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। এ ধরনের কাজ তারা একা করে না। তাদের সঙ্গে আরও অনেকেই জড়িত থাকে। তারা পরস্পর যোগসাজশে এ ধরনের অনিয়ম করে থাকে। 

তিনি আরও বলেন, এগুলো বড় ধরনের অনিয়ম। স্পষ্টভাবে ডেলিভারি করার আগেই বিল পরিশোধ করা দুর্নীতির প্রমাণ করে। এগুলো আমলে নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের উচিত মামলা করা। যারা দোষী তাদের শাস্তির আওতায় আনা।

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close