ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

বিশ্বে বাড়ছে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু
প্রকাশ: শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪, ১:৩১ এএম  (ভিজিট : ৩৬২২)
সংঘর্ষ এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রেক্ষাপটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অগণিত লোক শরণার্থী হয়েছিলেন। যুদ্ধশেষে একমাত্র ইউরোপেই ৪০ মিলিয়নেরও অধিক লোক শরণার্থী ছিল। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তি জাতিসংঘ ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রশাসন (ইউএনআরআরএ) গঠন করে; যার প্রধান কাজ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন দেশসহ ইউরোপ ও চীন থেকে আসা শরণার্থীদের সহায়তা করা। তাদের নিয়ন্ত্রণে ও প্রত্যক্ষ সহায়তায় ৭ মিলিয়ন লোক নিজ বাসভূমিতে ফিরে যায়। কিন্তু উদ্বাস্তু এক মিলিয়ন লোক মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানায়।

বিশ্বযুদ্ধের শেষ মাসে প্রায় পাঁচ মিলিয়ন জার্মান বেসামরিক নাগরিক পূর্ব প্রুশিয়া, পোমারানিয়া এবং সিলেসিয়া রাজ্য থেকে রেড আর্মির প্রচণ্ড আক্রমণের হাত থেকে রক্ষার লক্ষ্যে ম্যাকলেনবার্গ, ব্রান্ডেনবার্গ এবং স্যাক্সনিতে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নেয়।

১৯৯১-৯২ সালে আড়াই লাখের অধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী মিয়ানমারের সামরিক জান্তার নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। তাদের অনেকেই বিশ বছর যাবৎ বাংলাদেশে অবস্থান করছে। বাংলাদেশ সরকার তাদের দুটি ভাগে ভাগ করেছে। একটি শরণার্থী ক্যাম্পে অবস্থানকারী স্বীকৃত রোহিঙ্গা; অন্যটি বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিশে যাওয়া অস্বীকৃত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। কক্সবাজারের নয়াপাড়া এবং কুতুপালং এলাকার দুটি ক্যাম্পে ত্রিশ হাজার রোহিঙ্গা বাস করছে। 

আরাকান রাজ্যে গত কয়েক মাসে রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক নির্যাতনের ফলে তাদের বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। কঠোর নিবন্ধিকরণ আইনে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব, চলাফেরায় বিধিনিষেধ আরোপ, ভূমি বাজেয়াপ্তকরণ, মিয়ানমারের বৌদ্ধদের অবস্থানের জন্য জোরপূর্বক উচ্ছেদ, ২০০৬ সালের শেষ পর্যায়ে পশ্চিমাঞ্চলীয় আরাকানের ৯টি মসজিদের আশপাশে অবকাঠামোগত প্রকল্প গ্রহণের জন্য দায়ী বলে ধারণা করা হয়। 

বিশ্বে যুদ্ধ-সংঘাতের কারণে এক বছরের ব্যবধানে উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৫০ লাখ। ২০২৩ সাল শেষে অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু হয়েছে রেকর্ড ৭ কোটি ৫৯ লাখ মানুষ। আগের বছর শেষে বিশ্বে উদ্বাস্তু ছিল ৭ কোটি ১১ লাখ মানুষ। ১৪ মে এক বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল ডিসপ্লেসড মনিটরিং সেন্টার’ (আইডিএমসি)। 

নিজ ভূমি ছেড়ে অথবা আশ্রয়ের সন্ধানে অন্য কোথাও অস্থায়ীভাবে যারা অবস্থান করেন, তাদের বলা হয় শরণার্থী বা উদ্বাস্তু। জাতিগত সহিংসতা, ধর্মীয় উগ্রতা, জাতীয়তাবোধ, রাজনৈতিক আদর্শগত কারণে সমাজবদ্ধ জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তাহীনতাই এর প্রধান কারণ। ৩১ ডিসেম্বর ২০০৫ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তান, ইরাক, সিয়েরালিয়ন, মিয়ানমার, সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদান এবং ফিলিস্তিন বিশ্বের প্রধান শরণার্থী উৎসস্থল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। আইডিপি অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শরণার্থী এসেছে দক্ষিণ সুদান থেকে, যা প্রায় ৫ মিলিয়ন। জনসংখ্যা অনুপাতে সবচেয়ে বেশি আইডিপি রয়েছে আজারবাইজানে। সেখানে ২০০৬ সালের তথ্য মোতাবেক প্রায় আট লাখ শরণার্থী অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে।

১৯৫১ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক শরণার্থীদের মর্যাদা বিষয়ক সম্মেলনে অনুচ্ছেদ ১এ-তে সংক্ষিপ্ত আকারে শরণার্থীর সংজ্ঞা তুলে ধরা হয়। একজন ব্যক্তি যদি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন ও দেখতে পান যে, তিনি জাতিগত সহিংসতা, ধর্মীয় উন্মাদনা, জাতীয়তাবোধ, রাজনৈতিক আদর্শ, সমাজবদ্ধ জনগোষ্ঠীর সদস্য হওয়ায় তাকে ওই দেশের নাগরিকের অধিকার থেকে দূরে সরানো হচ্ছে; সেখানে ব্যাপক ভয়ভীতির পরিবেশ বিদ্যমান এবং রাষ্ট্র তাকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে; তখনই তিনি শরণার্থী হিসেবে বিবেচিত হন। ১৯৬৭ সালের সম্মেলনের খসড়া দলিলে উদ্বাস্তুর সংজ্ঞাকে বিস্তৃত করা হয়। আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় অনুষ্ঠিত আঞ্চলিক সম্মেলনে যুদ্ধ এবং অন্যান্য সহিংসতায় আক্রান্ত ব্যক্তি কর্তৃক নিজ দেশত্যাগ করাকেও এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। 

যুদ্ধ-সংঘাতের মতো কারণে যারা উদ্বাস্তু হয়ে নিজ দেশ ছেড়ে অন্য কোনো দেশে চলে যেতে বাধ্য হন, তাদের বলা হয় শরণার্থী। অন্যদিকে নিজ দেশের সীমানার ভেতরেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হন বা স্থানান্তরিত হন, তাদের বলা হয় অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু। আইডিএমসি বলছে, সংঘাত-সহিংসতায় বিশ্বজুড়ে ৬ কোটি ৮৩ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু হয়েছেন। অন্যদিকে দুর্যোগের কারণে উদ্বাস্তু হয়েছেন আরও ৭৭ লাখের বেশি মানুষ। বার্ষিক প্রতিবেদনে সংস্থাটি জানায়, গাজা ও সুদানে চলমান সংঘাতের কারণে এবার উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা এত বেশি বেড়েছে। এছাড়া গত পাঁচ বছরে নিজ দেশেই সীমানার ভেতর উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। 

আইডিএমসির পরিচালক আলেকজান্দ্রা বিলাক বলেন, বিগত দুই বছরের বেশি সময় ধরে আমরা উদ্বেগজনকভাবে বিশ্বের রেকর্ডসংখ্যক মানুষকে নতুন করে অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু হতে দেখেছি। আর এটি ঘটছে সংঘাত ও সহিংসতার কারণে। আলেকজান্দ্রা আরও বলেন, যুদ্ধ-সংঘাতে মানুষ যে ধ্বংসযজ্ঞের মুখোমুখি হয়, সেটি থেকে বেরিয়ে আসতে এবং নতুন করে জীবন সাজাতে লাখ লাখ মানুষের বছরের পর বছর লেগে যায়। জীবনে আর সেই সুযোগও পান না অনেকে।

আইডিএমসির প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের যুদ্ধের কারণে ২০২৩ সালের শেষে এসে ১৭ লাখ ফিলিস্তিনি অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু হয়েছেন। গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে ওই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল।

অবরুদ্ধ গাজা। ইসরাইলি হামলার মুখে অনিরাপত্তা ও অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছে সেখানকার অধিকাংশ মানুষ। ইসরাইলের আক্রমণের হুমকিতে প্রায় ৩৪ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির সংখ্যা ১৭ লাখ। পরিসংখ্যানে আরও দেখা যায়, ১০ বছর পর যুদ্ধে ধীরগতি সত্ত্বেও সিরিয়ায় ৭২ লাখ মানুষ এখনও অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত। ২০১৪ সালে এ সংখ্যা ছিল প্রায় ৭৬ লাখ। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ব্যাপকভাবে অনুষ্ঠিত যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও ইয়েমেনে বাস্তুচ্যুতদের সংখ্যা ৪৫ লাখ রয়ে গেছে। 

অন্যদিকে ইরাকে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা তিন বছর ধরে প্রায় ১১ লাখ। উল্লেখ্য, সংঘাতসহ নানা কারণে যারা উদ্বাস্তু হয়ে নিজ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে অন্য দেশে চলে যেতে বাধ্য হন, তাদের শরণার্থী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর যারা নিজ দেশের সীমানার ভেতরই এক জায়গা থেকে অন্যত্র স্থানান্তরিত হন, তাদের অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

বাড়তে থাকা বাস্তুচ্যুতদের বিষয়ে চিন্তিত আইডিএমসির পরিচালক আলেকজান্দ্রা বিলাক বলেন, ‘গত দুই বছরের বেশি সময়ে আমরা উদ্বেগজনকভাবে সংঘাত ও সহিংসতার কারণে নতুন করে রেকর্ডসংখ্যক মানুষকে অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু হতে দেখেছি।’ সংঘাত ও এর ফলে মানুষ যে ধ্বংসযজ্ঞের মুখোমুখি হয়, তা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন করে জীবন সাজাতে লাখো মানুষের বছরের পর বছর সময় লেগে যায়। এ বিষয়ে বিলাক আরও বলেন, ‘এটা ভাবা ভুল যে, সব বাস্তুচ্যুত মানুষ কয়েক সপ্তাহ পরে তাদের বাড়িতে ফিরে আসবে, হতে পারে কয়েক মাস পরে এবং তারপর তারা যেখানে ছেড়েছিল সেখানেই তাদের জীবন শুরু করবে। যুদ্ধবিরতি দিলেও মানুষ কি পরদিন থেকেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে? যে বাড়িগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে সেগুলো পুনর্নির্মাণ করতে কয়েক বছর লেগে যাবে।’ 

আমরা মনে করি, বিশ্ব শান্তির স্বার্থে এই যুদ্ধের অবসান জরুরি। সে ক্ষেত্রে শক্তিশালী আন্তর্জাতিক কোনো মধ্যস্থতাকারীকে দুপক্ষকে এক টেবিলে বসানো এবং টেকসই শান্তি স্থাপনে সহযোগিতা করতে হবে। 

সাংবাদিক

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close