প্রতি বছর এপ্রিলের প্রথম থেকেই গ্রীষ্মের একটা প্রভাব আমার ওপর রাজত্ব করতে থাকে। কিন্তু তবু কেন জানি গ্রীষ্মের সঠিক আমেজ অনুভব করি না। অথচ গ্রীষ্ম তখন শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু আমার গ্রীষ্ম শুরু হয় ঘটা করে, অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল, মানে বৈশাখ থেকে।
বাটিকের কাজ করা পাঞ্জাবি এবং সাদা পায়জামা, পায়ে চটি পরে বাংলা একাডেমি চত্বরে ঘুরতে না পারলে এবং রোদে পুড়ে ঘর্মাক্ত হয়ে বর্ণিল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে না পারলে, আমার মনে হয় গ্রীষ্মের শুরু কোথায়! ছোটবেলায় মফস্বল শহরে বাসার পাশেই ছিল এক বিরাট পুকুর। দুপুরে বাসায় ভাত খেতে গিয়ে একটা গামছা প্যান্টের পকেটে লুকিয়ে রাখতাম। বাবা-মা ঘুমিয়ে পড়লেই মনের আনন্দে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতাম। কয়েক বন্ধু একত্র হয়ে লুকানো গামছা প্যাঁচিয়ে মনের উচ্ছলতায় পুকুরে লাফিয়ে পড়তাম। সবচেয়ে আনন্দ পেতাম ডুব দিয়ে পুকুরের নিচের দিকে ঠান্ডা পানির স্তরে। যতক্ষণ দম আটকে সেখানে থাকা যায় ততক্ষণ আনন্দ।
তবে আনন্দের যে কাজটা সবচেয়ে বেশি উৎফুল্ল করে তুলতো, তা হলো পাড়ার কোনো গাছ থেকে কাঁচা আম চুরি করে গুড় এবং কাঁচা ঝাল দিয়ে ভর্তা বানিয়ে খাওয়া। মাঝেমধ্যে ঘুষ হিসেবে এই কাঁচা আমের ভর্তা দিয়ে মায়ের পিটুনি থেকেও বাঁচতাম।
আমাদের শহরে ডাকাতিয়া নদীর পাড়েই সরকারি ডাকবাংলো। সেই ডাকবাংলোতে ছিল একটা শিমুল গাছ। এই গাছের লাল ফুলের সমারোহ আর নদী থেকে আসা মৃদুমন্দ জলজ হাওয়া একটা অদ্ভুত আবহ সৃষ্টি করত। প্রায় দুপুরে আমরা বন্ধুরা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে ওই শিমুলতলায় আড্ডায় বসতাম। মৃদুমন্দ বাতাসে শুরু হতো আমাদের কবিতা পাঠের আসর। মাঝেমধ্যে উৎসুক শ্রোতা-দর্শকের ভিড় জমে যেত। ওদের উৎসাহ এবং হাততালি আমাদের অনুপ্রেরণা জোগাতো।
আমি যখন কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র, সবেমাত্র যৌবনের আনন্দে উদ্বেলিত হচ্ছি তখনই নতুন এক অভ্যাস গড়ে উঠতে শুরু করল। আমরা বন্ধুরা প্রায়ই এক উদ্ভট উৎসবের আয়োজন করতাম। ধূমপানের উৎসব। গ্রীষ্মের বিকালে আমরা কয়েক বন্ধু মিলে মুখার্জিঘাটের জয়নাল মাঝির নৌকা ঘণ্টা হিসেবে ভাড়া করতাম। গ্রীষ্মের অতি প্রিয় ফল পাকা কাঁঠাল আর মুড়ি এবং এক প্যাকেট গোল্ডেন ফাইভ সিগারেট নিয়ে নৌকায় চড়তাম।
জয়নালকে বলতাম, ‘ডাকাতিয়া ছেড়ে সোজা মেঘনার চরে চলে যাও।’ নৌকা নদীর মাঝখানে যেতেই আমাদের ধুমপান উৎসব শুরু হয়ে যেত। পুরো প্যাকেট শেষ করে মুখের গন্ধ দূর করার জন্য নদীর পানি দিয়ে ভালোভাবে সবাই কুলি করত। তারপর কাঁঠাল এবং মুড়ির ভুরিভোজন চলত। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে মুখ থেকে দুর্গন্ধ দূর হয়েছে কি না নিশ্চিত হলে তবেই পাড়ে উঠতাম। প্রায়ই দেখা যেত নৌকা ভ্রমণ শেষ করে যখন নামতে যাব, হঠাৎ এক বন্ধু অন্যজনকে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দিয়েছে। বাকিরা নিজেদের বাঁচাতে চেষ্টা করেও পারত না। ‘আমি যখন নদীতে তোরা বাদ যাবি কেন!’ বলেই এমনভাবে নৌকা দোলাতো যে সবাই একসঙ্গে পানিতে। তারপর সবাই ইচ্ছেমতো নদীতে ঝাঁপিয়ে নিজেদের শরীর জুড়িয়ে তবেই বাসায় ফিরতাম।
রবিঠাকুর গ্রীষ্ম নিয়ে লিখেছেন : নাই রস নাই, দারুণ দাহনবেলা। / খেলো খেলো তব নিরব ভৈরব খেলা॥ যদি ঝরে পড়ুক পাতা,/ ম্লান হয়ে যাক মালা গাঁথা,/ থাক জনহীন পথে-পথে মরীচিকা জাল ফেলা॥/ শুষ্ক ধুলায় খসেপড়া ফুলদলে/ ঘূর্ণি-আঁচল ওড়াও আকাশতলে।/ প্রাণ যদি করো মরুসম/ তবে তা-ই হোকÑ হে নির্মম,/ তুমি একা আর আমি একা,/ কঠোর মিলনমেলা।।
কিন্তু কবিগুরুর সঙ্গে আমি একমত নই। ‘নাই রস নাই, দারুণ দাহনবেলা।’ এই গ্রীষ্মে কবিগুরু দাহনবেলা খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু আমি পেয়েছিলাম ‘দারুণ বেলা’। আমার প্রেম-ভালোবাসা ঘর বেঁধেছিল এই দারুণ গ্রীষ্মের কালে। সে এক রস-লাগা শিহরিত সময়। চাকরি সূত্রে আমি তখন সিলেটে। সময়টা দারুণ গ্রীষ্ম। সিলেটে এই কাঠফাটা রোদ তো এই বৃষ্টি! এমনই দিনে আমার জন্মশহর থেকে বেড়াতে গেল একজন মাতা আর কন্যা। পরিচিত বলে আমার বাসায় থাকার স্থান। তাদের বেড়ানোর দ্বিতীয় দিন প্রচণ্ড রোদকে কাবু করে নেমে এলো বৃষ্টি। সেদিনের বৃষ্টি আমার জন্য ছিল এক অনন্য সৃষ্টি। বৃষ্টিময় ছন্দের দুপুরে ঘুমিয়ে ছিল কন্যা। অবাধ্য রেশমি চুল বারবার তার কপোলে উড়ে আসছিল। আমার নজর তখন ঠায় তার কপোলে স্থির। চোখ স্থির কিন্তু নিজেকে স্থির রাখা ছিল কষ্টকর। হঠাৎ আমার মধ্যে কী হলো জানি না, দ্রুত কন্যার কাছে গিয়ে তার কপালে চুমু খেলাম। অপ্রস্তুত সে, চোখ খুলে বিস্ফারিত নয়নে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে।
নীরবে তার চোখের ভাষায় পড়লাম, ‘এটা কি হলো?’ আমি জোরে জোরে বললাম, ‘ভালোবাসি তোমাকে’। একই সঙ্গে কোনো এক কবির বলা কথা মনে পড়ে গেল, ‘দুঃখ দিনের সুখ স্বপ্ন দেখার যে আনন্দ/ দারুণ গ্রীষ্মে শ্রাবণ রাত্রির কল্পনাতেই সেই সুখ।’ মাকে এখন আর কাঁচা আমের ভর্তা ঘুষ দিতে হয় না। তবে প্রেমিকা স্ত্রীকে কখনো হাঁড়িভাঙ্গা, কখনো ল্যাংড়া, কখনো গোপালভোগ ঠিকই ভেট দিতে হয়। না হলে সিলেটের সেই বৃষ্টিময় দুপুরের চুমুর খোঁটা এখনও খেতে হয়। গ্রীষ্মের উত্তপ্ততা ছাড়া রসহীন কিছুই কি থাকে? গ্রীষ্ম তো আসলেই রসে টইটম্বুর।
সময়ের আলো/আরএস/