মুবাসসিরা খানম রাখি, বয়স ৫ বছর। কারাগারে জন্ম তার, মায়ের সঙ্গে বসবাস করতে হচ্ছে সেখানেই। বাইরের জগৎ ও আত্মীয়স্বজনদের দেখার সুযোগ হয়নি তার। এ শিশু কোনো অপরাধ না করে থাকলেও মায়ের অপরাধে তার সঙ্গে ফাঁসির সেলে কারাযাপন করতে হচ্ছে। এতে তার স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হচ্ছে।
দেশ-বিদেশে আলোচিত ফেনীর সোনাগাজীর মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফীকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কামরুন নাহার মনির শিশু সন্তান মুবাসসিরা খানম রাখি। আলোচিত এ মামলার অন্যতম আসামি কামরুন নাহার মনিকে ২০১৯ সালের ১৬ এপ্রিল গ্রেফতার করে পিবিআই। গ্রেফতারের সময় মনি অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। গ্রেফতারের পরদিন মনিকে আদালতে তুলে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে আদালত ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রাফীকে পুড়িয়ে হত্যার সময় ব্যবহৃত বোরকাগুলো যে দোকান থেকে কেনা হয়েছিল, আসামি মনিকে নিয়ে ২০১৯ সালের ১৯ এপ্রিল সে দোকানে অভিযান চালায় পিবিআই। একই বছরের ২০ এপ্রিল রাতে প্রসবব্যথা উঠলে আসামি কামরুন নাহার মনিকে ফেনী জেলা কারাগার থেকে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে কন্যাসন্তান প্রসব করেন মনি।
মনির স্বামী রাশেদ খান রাজু সময়ের আলোকে জানিয়েছেন, বর্তমানে কাশেমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে মায়ের সঙ্গে শিশুকন্যা কারাযাপন করছে। অবুঝ শিশু জন্মের পর থেকেই মায়ের সঙ্গে শাস্তি ভোগ করছে। বঞ্চিত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ থেকে।
নুসরাত জাহান রাফীকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ৫ বছর ইতিমধ্যে পার হয়েছে। বর্তমানে বিচারিক আদালতের রায়ের ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল শুনানি উচ্চ আদালতে অপেক্ষায় রয়েছে। বাদী ও আসামি পক্ষের স্বজনরাও উচ্চ আদালতের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
এর আগে ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফীকে যৌন নিপীড়নের চেষ্টার দায়ে সোনাগাজী ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ দৌলাকে আটক করে পুলিশ। পরে ৬ এপ্রিল ওই মাদরাসার সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে অধ্যক্ষের সহযোগীরা রাফীর শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে তার শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে যায়। একই বছরের ১০ এপ্রিল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে রাফীর মৃত্যু হয়। এ ঘটনা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশি গণমাধ্যমেও সমালোচনার ঝড় তোলে। ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে আন্দোলনকারীরা।
৬১ কার্যদিবসে গত বছরের ২৪ অক্টোবর ১৬ আসামির মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ। এ ছাড়া প্রত্যেক আসামিকে ১ লাখ টাকা করে জরিমানাও করেন আদালত। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন-সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার বহিষ্কৃত অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ দৌলা, নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, সোনাগাজীর পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, হাফেজ আবদুল কাদের, আবছার উদ্দিন, কামরুন নাহার মনি, উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে শম্পা ওরফে চম্পা, আবদুর রহিম শরীফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন ওরফে মামুন, মোহাম্মদ শামীম, মাদরাসার তৎকালীন গভর্নিং বডির সহ-সভাপতি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি রুহুল আমিন। এরমধ্যে অন্য মামলায় গ্রেফতার থাকায় ফেনী কারাগারে রুহুল আমিন ও কাউন্সিলর মাকসুদ আলম এবং বাচ্চাসহ কামরুন নাহার মনি কাশিমপুর কারাগারে থাকলেও বাকি আসামিরা কুমিল্লা কারাগারে রয়েছেন।
অন্যদিকে ফেনী কারাগারে বিভিন্ন মামলায় অন্য নারী আসামিদের সঙ্গেও তাদের ৩ শিশু ছেলে ও ৪ কন্যা সন্তান রয়েছে। তারাও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছে না।
ফেনী কারাগারের জেলার মোহাম্মদ শাহ আলম সময়ের আলোকে জানান, রাফী হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রুহুল আমিন অন্য ৪টি ও মকসুদ আলম ২টি মামলায় গ্রেফতার থাকায় তারা ফেনী কারাগারে রয়েছেন। বাকি আসামিরা নিয়মানুযায়ী অন্য কারাগারে রয়েছেন।
সময়ের আলো/আরএস/