ভারতের চলমান লোকসভার নির্বাচনের মাঝেই সংরক্ষণ ইস্যুতে পারস্পরিক বাদানুবাদ শুরু হল কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি ও প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের মধ্যে। সংরক্ষণ ইস্যুতে এই দুই দল একেবারে সম্মুখ সমরে। গত কয়েকদিন ধরে প্রায় প্রতিটি সভা সমিতি থেকেই সংরক্ষণ ইসুকে হাতিয়ার করে বিজেপি এবং কংগ্রেস একে অপরকে লক্ষ্য করে তোপ দাগতে দেখা যাচ্ছে।
ভারতের বিজেপি শাসিত রাজ্য গুজরাট কিংবা মধ্যপ্রদেশ- প্রতিটি জায়গায় নির্বাচনী প্রচারণায় গিয়ে কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধী বলছেন, ‘মোদি যদি ফের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ভারতের ক্ষমতায় আসে তবে সংবিধান পরিবর্তন করে দেশ থেকে সংরক্ষণ তুলে দেবে।’ রাহুলের বক্তব্য ‘সংরক্ষণের প্রধান লক্ষ্য কি? দেশের গরিব, দলিত, আদিবাসী, পিছিয়ে পড়া মানুষেরা এর অংশীদার হবে। এটাই লক্ষ্য হওয়া উচিত। দেশে যে সরকার আছে, তারা দেশের অর্থ ন্যায়ের সাথে সকলের মধ্যে বন্টন করে দেবে। এটাই সংরক্ষণের মূল বিষয় হওয়া উচিত। কিন্তু সংরক্ষণকে শেষ করে দেওয়ার জন্য বেসরকারিকরণ, সেনাবাহিনীতে অগ্নিবীর প্রকল্প চালু করা হচ্ছে। যেখানে সমাজের দুর্বল শ্রেণীর লোক একটু সুবিধা পায় সেখানেই বিজেপির লোকেরা তাদের সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত করছে।’
কংগ্রেসকে পাল্টা নিশানা করে তাদের বিরুদ্ধে মুসলিম তোষণ নীতির অভিযোগ তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। প্রধানমন্ত্রীর স্পষ্ট বার্তা ‘যতদিন তিনি বেঁচে আছেন ততদিন দলিত, আদিবাসী, অন্য অনগ্রসর শ্রেণীদের প্রাপ্য সংরক্ষণ কেড়ে নিয়ে ধর্মের ভিত্তিতে তা মুসলিমদের দিতে দেবেন না।’ দুইদিন আগে তেলেঙ্গানার মেদক জেলার জাহিরাবাদ, এবং বর্ধমান জেলার দুর্গাপুরের এ প্রচারণা থেকে মোদির নিশানা ‘যারা সংসদে চলতে দেয় না, যারা নির্বাচন কমিশনের দিকে আঙুল তোলে, যারা ইভিএম নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তারা আজ ভোট ব্যাংকের কারণে সংবিধানের নিন্দা করতে নেমে পড়েছে। কিন্তু কংগ্রেস ও তাদের সহযোগীরাও শুনে নিন- যতদিন মোদি জীবিত থাকবেন... দলিত, আদিবাসী, অন্য অনগ্রসর শ্রেণীর জন্য বরাদ্দ সংরক্ষিত কোটা থেকে আমি কিছুতেই ধর্মের ভিত্তিতে মুসলমানদের সংরক্ষণ দেব না, দেব না, দেব না।’
মোদি আরও বলেছেন, যতদিন মোদি আছে, সংবিধানের রচয়িতা বাবা সাহেব আম্বেদকর ভারতের সংবিধানে তপশিলি জাতি, তপশিলি উপজাতি, অন্য অনগ্রসর শ্রেণী, দলিত মানুষদের যে সংরক্ষণ দিয়েছে তার পুরো রক্ষা করা হবে। কখনোই তাদের উপরে কোন আঘাত আসতে দেবো না। আর যারা (কংগ্রেস) ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণ দিতে চায়, ওরা লিখিত ঘোষণা করুক যে ধর্মের ভিত্তিতে তারা সংরক্ষণ চালু করবে না। তপশিলি জাতি, উপজাতি, অন্য অনগ্রসর শ্রেণীদের সংরক্ষণে হাত লাগাবে না। কিন্তু ওরা সেটা ঘোষণা করবে না। কেননা ওরা, কর্নাটকে অন্য অনগ্রসর শ্রেণীর প্রাপ্য সংরক্ষণের কোটা থেকে ধর্মের ভিত্তিতে মুসলিমদের সংরক্ষণ দিয়েছে। ওরা ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণ চালু করেছে। ভোট ব্যাংকের জন্য তারা আদিবাসী, দলিত, পিছিয়ে পড়া মানুষদেরদের সংরক্ষণ ছিনিয়ে নিতে চায়।
ধর্মের ভিত্তিতে মুসলমানদের সংরক্ষণের বিরোধিতা করে কংগ্রেসকে নিশানা করেছেন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথও। তিনি বলেছেন, কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি সহ বিরোধীদলের জোট ‘ইন্ডিয়া’ নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়কে সংরক্ষণের আওতায় আনতে চায়। কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে যেকোনো ধরনের সংরক্ষণের বিরোধী বিজেপি।
তার অভিযোগ ‘‘কর্ণাটকে অন্য অনগ্রসর শ্রেণীর সংরক্ষিত কোটা থেকে মুসলিমদের সংরক্ষণ করার কংগ্রেসের যে প্রচেষ্টা তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। কংগ্রেসের এজেন্ডার অংশই ছিল ভারতকে ‘ইসলামীকরণ এবং বিভাজন’ এর দিকে ঠেলে দেওয়া।’’
যোগীর দাবি ‘কংগ্রেস তফসিলি জাতি, তফসিলি উপজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মানুষদের সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চেয়েছিল।’
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও এই ইস্যুতে কংগ্রেসকে তোপ দেগেছে। বুধবার ছত্রিশগড়ের কাঠগোড়া এলাকায় একটি নির্বাচনী প্রচারণা থেকে শাহ বলেন, ‘কংগ্রেসের একটাই ফর্মুলা সেটা হল মিথ্যে কথা বলা, সেটাকে চিৎকার করে বলা এবং অনবরত সেই মিথ্যে বলে যাওয়া। তারা বলছে তৃতীয়বারের জন্য যদি মোদি ভারতের ক্ষমতায় আসে তবে সংরক্ষণের কোটা তুলে দেবে। তারা আমাকে নিয়েও একটা ভুয়া ভিডিও ছড়িয়েছিল। গত দশ বছর আমার আমরা ক্ষমতায় আছি কিন্তু মোদি কখনোই তফসিলি জাতি, তফসিলি উপজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মানুষদের সংরক্ষণ তুলে দেয়নি এবং কংগ্রেসকেও সেই সংরক্ষণ তুলতে দেবো না।’
তবে কেবল রাহুলই নয়, কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদরাও কয়েকদিন আগে গুজরাটের ধরমপুর থেকে এক নির্বাচনী প্রচারণা থেকে ঠিক একই অভিযোগ করে বলেন, ‘বিজেপির কার্যকর্তারাই বলছেন তৃতীয়বারের জন্য তারা ক্ষমতায় আসলে সংবিধান পরিবর্তন করবেন। কিন্তু মোদীজি তা অস্বীকার করছেন। প্রথমে তারা যেটা করতে চায়, সেটা তারা স্বীকার করে না। কিন্তু ক্ষমতায় এসে সেটাকেই কার্যকর করে।’
এমনকি কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক (কমিউনিকেশন) জয়রাম রমেশও এই অভিযোগ তুলে বুধবারের সংবাদ সম্মেলন থেকে বলেন, ‘লোকসভা ভোটে মোদির ৪০০ আসন পার করার লক্ষ্যমাত্রার অর্থ হল, তিনি চাইছেন দেশের সংবিধান বদল করতে।’ শুধু কংগ্রেসই নয়, বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র অন্যতম শরিকদল সমাজবাদী পার্টির প্রধান ও উত্তরপ্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবও সংরক্ষণ ইস্যুতে মুখ খুলেছেন। তার অভিমত ‘ভারতের বড় বড় সংস্থাগুলো যদি বিক্রি হয়ে যায়, কিংবা বেসরকারিকরণ হয়ে যায় তবে সংরক্ষণ কিভাবে মিলবে? বিমানবন্দর, প্লেন, রেল, হাসাপাতাল সব বিক্রি করে দিচ্ছে, যেখানে কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। তবে কি সেখানে সংরক্ষণ থাকবে?’
সময়ের আলো/জেডআই