ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

মে দিবস ও প্রহসনের বিচার
প্রকাশ: বুধবার, ১ মে, ২০২৪, ৩:০২ এএম আপডেট: ০১.০৫.২০২৪ ৮:১০ এএম  (ভিজিট : ৫৬২)
আজ পহেলা মে। মহান মে দিবস। ১৮৮৬ সালের এই দিনে শিকাগো শহরের শ্রমিকরা দৈনিক কাজের সময়সীমা ৮ ঘণ্টা করার দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট শুরু করে। এ কর্মসূচির অংশ হিসেবে প্রায় ৩ লাখ শ্রমিক কাজ ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে। অনেকটা শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হয় এদিনের কর্মসূচি। দ্বিতীয় দিনেও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। শ্রমিক হত্যার প্রথম ঘটনা ঘটে ৩ মে ম্যাককরমিক রিপার ওয়ার্কসে। আর পরদিন অর্থাৎ ৪ মে সংঘটিত হয় হে মার্কেট ট্র্যাজেডি। এ আন্দোলনের নেতা অগাস্ট স্পিজ ছিলেন জার্মান বংশোদ্ভূত একজন অভিবাসী শ্রমিক এবং সাংবাদিক। কারখানায় কাজ করার পাশাপাশি তিনি জার্মান ভাষায় প্রকাশিত শ্রমিকশ্রেণির মুখপত্র ‘দ্য আরবেইটার-জেইতুং’-এর সম্পাদক ছিলেন। শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হওয়ায় প্রহসনের বিচারে অগাস্ট স্পিজ এবং তার তিন সহযোগীকে ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। 

মে দিবসের পটভূমি
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে শ্রমিকদের দৈনিক ১০ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য করা হতো। এ কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে তাদের দেওয়া হতো নামমাত্র মজুরি। ফলে ক্রীতদাসের চেয়েও দুর্বিষহ তাদের জীবন। এমন একটি পরিস্থিতিতে ১৮৬০ সালে শ্রমিকরা তাদের মজুরি না কমিয়ে দিনে ৮ ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের জন্য দাবি জানান। এ ক্ষেত্রে তাদের স্লোগান ছিল-৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম এবং ৮ ঘণ্টা অবসর বিনোদন।

১৮৮৪ সালে এ আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। শ্রমিকরা তাদের এ দাবি কার্যকর করার জন্য ১৮৮৬ সালের ১ মে পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। শ্রমিকদের পক্ষ থেকে বারবার মালিক পক্ষের কাছে এ দাবি জানানো হলেও তাদের কাছ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি। এরই মধ্যে শ্রমিকদের দাবির পক্ষে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় একাধিক প্রবন্ধ প্রকাশ হয়। এতে শ্রমিক বিদ্রোহ ওঠে চরমে। আর শিকাগো হয়ে ওঠে প্রতিবাদ-বিদ্রোহের মূল মঞ্চ। পহেলা মে যতই এগিয়ে আসছিল, দুই পক্ষের সংঘর্ষ ততই অবধারিত হয়ে ওঠে। মালিকপক্ষ শ্রমিকদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। পুলিশ আগে থেকেই শ্রমিকদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে আসছিল। নতুন করে শ্রমিক বিদ্রোহ দেখা দেওয়ায় তারা আরও সক্রিয় হয়ে ওঠে। অন্যদিকে এ বিদ্রোহ প্রতিহত করতে মালিকপক্ষ পুলিশকে বিশেষ অস্ত্র কিনে দেয়। 

হে মার্কেট ট্র্যাজেডি 
পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, ১৮৮৬ সালের পহেলা মে শিকাগো শহরের প্রায় ৩ লাখ শ্রমিক কাজ ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে। প্রথম ও দ্বিতীয় দিন অনেকটা শান্তিপূর্ণভাবেই পালিত হয় এ ধর্মঘট কর্মসূচি। কিন্তু ৩ মে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। এদিন একদল ধর্মঘটি শ্রমিক ম্যাককরমিক রিপার ওয়ার্কসে (একটি কৃষি প্লান্ট) কর্মরত শ্রমিকদের আন্দোলনে যুক্ত হতে বলে। কেননা এ কারখানার শ্রমিকরা ধর্মঘট উপেক্ষা করে কাজ করছিল এবং তারা শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। পুলিশ বিনা উসকানিতে ধর্মঘটী শ্রমিকদের ওপর গুলি চালায়। এতে ৬ জন শ্রমিক নিহত হয়, গুরুতর আহত হয় আরও বেশ কয়েকজন। এ ঘটনার প্রতিবাদে ধর্মঘটি শ্রমিকরা পরদিন (৪ মে) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় শোভাযাত্রা বের করার সিদ্ধান্ত নেয়।

পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, আন্দোলনরত শ্রমিকরা মিছিলের উদ্দেশ্যে হে মার্কেট স্কয়ারে সমবেত হয়। শোভাযাত্রা-পূর্ব সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছিলেন শ্রমিকনেতা অগাস্ট স্পিজ। ওই সময় কে বা কারা সমাবেশের কাছে দায়িত্বরত একদল পুলিশের ওপর বোমা নিক্ষেপ করে। এতে মেথিয়াস জে ডিগান নামে একজন পুলিশ অফিসার ঘটনাস্থলেই মারা যান এবং বেশ কয়েকজন আহত হন। বোমা বিস্ফোরণের পর পুলিশ বাহিনী শ্রমিকদের ওপর অতর্কিতে হামলা শুরু করে এবং গুলি চালিয়ে অন্তত ১১ শ্রমিককে হত্যা করে। তবে শ্রমিক হত্যার প্রকৃত সংখ্যা আজও প্রকাশ করা হয়নি। অনেকেই মনে করেন, ওইদিন কয়েকশ শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করা হয়।

প্রহসনের বিচার এবং ফাঁসি
বোমা হামলার ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার অভিযোগে পুলিশ ৮ শ্রমিকনেতাকে গ্রেফতার করে। তারা হলেন-অগাস্ট স্পিজ, আলবার্ট পার্সন, স্যামুয়েল ফিল্ডেন, লুইস লিং, মাইকেল শোয়াব, জর্জ অ্যাঙ্গেল, অ্যাডলফ ফিশার ও অস্কার নেবে। এ মামলায় শ্রমিকনেতা অগাস্ট স্পিজসহ ৮ জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। 

তাদের মধ্যে মাইকেল শোয়াবকে যাবজ্জীবন এবং অস্কার নেবেকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আর বাকি ৬ জনকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে স্যামুয়েল ফিল্ডেন মার আবেদন করলে তাকে ফাঁসির পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ফাঁসি দেওয়ার আগেই কারারুদ্ধ অবস্থায় ‘লুইস লিং’ আত্মহত্যা করেন। বাকি ৪ জনকে ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে ফাঁসি দেওয়া হয়। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে অগাস্ট স্পিজ বলেন, ‘এমন একটা দিন আসবে যখন আমাদের এই নীরবতা, তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অনেক শক্তিশালী হবে।’

কিন্তু মিথ্যা এবং প্রহসনকে বেশি দিন সত্য ও ন্যায় হিসেবে পরিচালিত করা যায় না। ১৮৯৩ সালের ২৬ জুন ইলিনয়ের গভর্নর জন পিটার অল্টগেল্ডের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মিথ্যা ছিল ওই বিচার। সেইসঙ্গে পুলিশের কমান্ডারকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের দৈনিক ‘আট ঘণ্টা কাজ’-এর দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়। আর ১ মে পালিত হয় শ্রমিকদের আত্মদান আর দাবি আদায়ের দিন হিসেবে। 

এদিন পৃথিবীর সব প্রান্তে ধ্বনিত হয় অগাস্ট স্পিজের সেই নীরবতা। তার সেই নীরবতা এখন হয়ে উঠেছে বিশ্বে প্রতিটি মেহনতি মানুষের দাবি আদায়ের কণ্ঠস্বর। তবে ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস, শ্রমিক আন্দোলনকে দমন করতে হে মার্কেটের ঘটনায় নিরপরাধ শ্রমিকনেতাদের ফাঁসি দেওয়া হলেও সেই বোমা নিক্ষেপকারীকে কখনোই চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়নি এবং আজও এ ঘটনার কোনো তদন্ত ও বিচার হয়নি।

হে মার্কেট স্মৃতিস্তম্ভ
শিকাগোর ফরেস্ট পার্কে জার্মান ওয়াল্ডহেইম কবরস্থানে (বর্তমানে যা ফরেস্ট হোম কবরস্থান) ফাঁসি দেওয়া ৫ শহিদ শ্রমিককে (ফিল্ডেন ছাড়া) সমাহিত করা হয়। ১৮৯৩ সালে তাদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়। এর ১০০ বছর পর ভাস্কর আলবার্ট ওয়েইনার্ট নির্মিত সেই স্মৃতিস্তম্ভটিকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ন্যাশনাল হিস্টোরিক ল্যান্ডমার্ক হিসেবে ঘোষণা করে। 

গ্রানাইটের তৈরি ১৬ ফুট উঁচু এ স্মৃতিস্তম্ভের সামনের দৃশ্যে দেখা যায়, একজন পতিত শ্রমিককে ধরে রেখেছে বিচারের প্রতিনিধিত্বকারী এক নারী। তার পায়ের নিচে লেখা রয়েছে অগাস্ট স্পিজের সেই সর্বশেষ উক্তিটি- The day will come when our silence will be more powerful than the voices you are throttling today. স্তম্ভটির পেছনের দৃশ্যে রয়েছে গভর্নর অল্টগেল্ডের একটি ব্রোঞ্জের ফলক, যা তার ন্যায়বিচারের প্রতীক। উল্লেখ্য, শিকাগোর সেই হে মার্কেট স্কয়ারেও একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে, সেটি নিহত পুলিশ অফিসার মেথিয়াস জে ডিগানের স্মরণে!

বিশ্বব্যাপী মে দিবস
হে মার্কেট ট্র্যাজেডির ২ বছর পর ১৮৮৮ সালে আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবারের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সেন্ট লুইস শ্রমিক সম্মেলনে কাজের সময় ৮ ঘণ্টা নির্ধারণের দাবিতে ‘মে দিবস পালনের’ ঘোষণা দেওয়া হয়। এর এক বছর পর ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী বছর থেকে অর্থাৎ ১৮৯০ সালের ১ মে বিশ্বব্যাপী পালন হয়ে আসছে ‘মে দিবস’ বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ হিসেবে। পরবর্তী সময়ে রাশিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর মে দিবস এক বিশেষ তাৎপর্য অর্জন করে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ ১ মে সর্বজনীন শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর অনেক দেশ এই দিনটিকে রাষ্ট্রীয় ছুটি ঘোষণা করে।


সাংবাদিক ও গবেষক

সময়ের আলো/আরএস/ 








https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close