ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

পানির চরম সংকট
চলনবিল অঞ্চলে পানিশূন্য ৮৫ নদী
প্রকাশ: সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৩:৫৮ এএম  (ভিজিট : ৩৭৮)
নাটোরের চলনবিল অঞ্চলে পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। প্রমত্ত পদ্মা নদী শুকিয়ে মরা নদীতে পরিণত হয়েছে অনেক আগেই। নদীর বুকে জেগে উঠেছে বড় বড় চর। সেই সঙ্গে পদ্মার প্রধান প্রধান শাখা নদী বড়াল, আত্রাই ও গড়াইসহ অন্তত ৮৫টি নদী পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। শুকনো নদ-নদীতে চাষ করা হচ্ছে বোরো ধান। এসব নদীতে পানি না থাকায় মৎস্যজীবীরা বেকার হয়ে পড়েছেন। তার সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে তাপপ্রবাহ।

চৈত্রের পর বৈশাখের প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে পুড়ছে দেশ। টানা প্রায় এক মাস ধরে তীব্র গরম, খরা, অনাবৃষ্টি, শুষ্ক ও বৈরী আবহাওয়া বিরাজ করছে। দুঃসহ হয়ে উঠেছে জীবনধারণ। পানির সন্ধানে দূর-দূরান্তে ছুটছে মানুষ। আবহাওয়া অফিস ও পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলোর পূর্বাভাস বলছে, এ বছর উচ্চতাপ ও খরা পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হতে পারে। অন্যদিকে চলনবিল অঞ্চলে দ্রুত নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর। আগামী দিনে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। নাটোর পৌরসভার মেয়র উমা চৌধুরী জলি পানি সংকটের কথা স্বীকার করে বলেন, খরা মৌসুম এলেই আমাদের নিরাপদ পানির সংকটে পড়তে হয়। এ সময় পৌর এলাকায় অনেক টিউবওয়েল অকেজো হয়ে যায়। সরকার যদি পানি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে নদী থেকে দূষণমুক্ত পানি উত্তোলন ও প্রাকৃতিক পানির উৎস সংরক্ষণে এখনই উদ্যোগ না নেয় তা হলে সামনে কঠিন বিপদ অপেক্ষা করছে।

নাটোর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী নুরুল কবীর ভূঁইয়া বলেন, সমগ্র দেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্পের আওতায় নাটোরেও কাজ করছি আমরা। এর আগে জেলায় নিরাপদ পানি সরবরাহ, পল্লী পানি সরবরাহ, অগ্রাধিকারমূলক গ্রামীণ পানি সরবরাহের কাজ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ছিল ২ হাজার ৯০৪টি সাবমার্সিবল পাম্পযুক্ত টিউবওয়েল ও ৭৯টি সাধারণ টিউবওয়েল। এগুলো জেলার ৫২টি ইউনিয়নে ৫২টি করে বরাদ্দ দেওয়া হয়।

বরেন্দ্র নাটোর জোনের উপসহকারী প্রকৌশলী আবদুল মতিন বলেন, জেলার হাতিয়ান্দহ ইউনিয়নের আচলকোট মৌজায় এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৩ সালের জুলাই মাসে স্থিতিশীল পানির গভীরতা ছিল ১২ ফুট ২ ইঞ্চি, ২০১৪ সালের জুলাই মাসে পানির গভীরতা নেমে দাঁড়ায় ১৩ ফুট ১ ইঞ্চিতে। অর্থাৎ প্রতি বছর প্রায় এক ফুট করে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। বিএডিসি নাটোর জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, জেলায় ২০০টি গভীর নলকূপ দিয়ে সেচের জন্য পানি উত্তোলন করা হয়। এসব নলকূপের প্রতিটির পেছনে ব্যয় হয়েছে ৩০-৩৫ লাখ টাকা করে। গত অর্থবছরে ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নাটোর জেলায় ৮০ কিলোমিটার ইউপিভিসি পাইপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ সেচ নালা নির্মাণের মাধ্যমে প্রায় ২ হাজার ৫৯০ হেক্টর জমিতে ভূ-উপরিস্থ পানি দিয়ে সেচ দেওয়া হবে।

তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে জেলার বাগাতিপাড়ার কালিকাপুর এলাকায় পানির স্তর ৩৩ ফুট নিচে নেমে গেছে। শ্যালো মেশিন মাটির ওপর থেকে ২৬ ফুট নিচ পর্যন্ত পানি তুলতে পারে। পানির স্তর অব্যাহত নিচে নামতে থাকলে একসময় শ্যালো টিউবওয়েলে পানি উঠবে না। সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার না করে বিকল্প উৎস ব্যবহার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সেচ কমিটির নীতিমালা মানার তাগিদ দেন তিনি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূগর্ভস্থ পানির বিকল্প ছাড়া এ অবস্থা থেকে উত্তরণের আর কোনো পথ নেই। ভূগর্ভস্থ পানির বিকল্প হিসেবে বৃষ্টির পানি ব্যবহার করে, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে, পুকুর, লেক বা নদী বৃদ্ধি করে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে হবে। অতিমাত্রায় পানি তুললে এই উৎসটি আর নবায়নযোগ্য থাকে না। তাই অতিমাত্রায় পানি তোলা বন্ধ করতে হবে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সিরাজগঞ্জ, নাটোর ও পাবনার চলনবিলের মধ্যে অবস্থিত ২০টির সব নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় এ অঞ্চলের মৎস্যজীবীরা বেকার হয়ে পড়েছেন। তাদের সরকার থেকে তেমন কোনো প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে না। তবে যেসব এলাকায় ইলিশের প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা নিষিদ্ধ সেসব এলাকায় সরকারিভাবে ৩০ হাজার টাকা মূল্যের বকনা বাছুর দেওয়া হচ্ছে।

ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে কৃষিজমিতে সেচ কার্যক্রম। এ ছাড়া যমুনা, পদ্মা, আত্রাই, গুমানী, বারনই, গোদাই, নন্দকুজা, হোজা, নাগর, ভদ্রাবতী, কাঁসাখালসহ সব নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় এসব নদী পারের হাজার হাজার মৎস্যজীবী বেকার হয়ে পড়েছেন। ভুক্তভোগীরা জানান, প্রতি বছর জানুয়ারি মাসে নদীর পানি কমে গেলেও নদীর কোলের পানি তেমন একটা কমে না। কিন্তু এ বছর জানুয়ারির শুরুতেই পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই সব জায়গায়ও পানি প্রায় শুকিয়ে গেছে। এ ছাড়া টানা প্রায় এক মাস ধরে তীব্র গরম, খরা, অনাবৃষ্টি, শুষ্ক ও বৈরী আবহাওয়া বিরাজ করার কারণে আরও বেশি সমস্যা হচ্ছে। এসব নদী পুনঃখনন করার দাবি এলাকাবাসীর। পুঠিমারী গ্রামের কৃষক মোক্তার আলী বলেন, গত বছর আমার সেচ বোরিংয়ে পানির স্তর ছিল ২৬ ফুট। এ বছর সেখানে পাইপের মধ্যে সুতা নামিয়ে দেখেন, পানির লেয়ার ৩৫ ফুট নিচে নেমে গেছে। চৈত্র মাস আসতে না আসতেই শ্যালো মেশিন ও মোটর পাম্পগুলোতে পানি পাওয়া যায় না। দুই দফায় মাটিতে ১০-১২ ফুট গর্ত করে পানির পাম্প নিচে দিয়ে বোরো জমিতে সেচ দিতে হচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ ও তেল খরচ বেশি হচ্ছে। নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, নাগর নদসহ আত্রাই, বারনই, নন্দকুজা, বড়াল, মুসাখাঁন, খলিশাডাঙ্গা, পচাবড়াল, গদাই, নাগর এবং পদ্মা নদীর কিছু অংশ শুকিয়ে যাওয়ার ফলে পানির সংকট দিন দিন প্রকট হচ্ছে। শুধু নাগর ও আত্রাই এবং পদ্মার কিছু অংশে পানি রয়েছে। নাটোর শহরের বাসিন্দা লেখক ও গবেষক খালিদ বিন বাচ্চু বলেন, এটি আমাদের জন্য অশনি সংকেত। এখনই প্রস্তুতি না নিলে আগামীতে সুপেয় পানির সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করবে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে খোলা জায়গা ও জলাধার কমে যাওয়া এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে অতিরিক্ত চাপের কারণে এ সংকট বলে আমি মনে করি।

সূত্র জানায়, বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। দৃশ্যত মরুকরণ প্রক্রিয়ার দিকে এগুচ্ছে এ অঞ্চলের সার্বিক আবহাওয়া যা এ অঞ্চলের কৃষিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। তবে রাজশাহীর তুলনায় নাটোর জেলায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর তুলনামূলকভাবে ভালো। খরা মৌসুমে রাজশাহীর নিকটবর্তী পবা উপজেলায় ১৯৮৫ সালে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ছিল গড়ে ২০ ফুট ৬ ইঞ্চি। ১৯৯৫ সালে ৩০ ফুটের নিচে ও ২০১০ সালে পানির স্তর নেমে দাঁড়ায় প্রায় ৬৬ ফুটে।

সময়ের আলো/আরএস/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close