ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

খালি কন্টেইনারের ভাগাড় ২১ প্রাইভেট আইসিডি
প্রকাশ: রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৪:৫০ এএম  (ভিজিট : ২৮৪)
খালি কন্টেইনারের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে চট্টগ্রামের ২১টি প্রাইভেট আইসিডি (ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো)। শনিবার আইসিডিগুলোতে খালি কন্টেইনার ছিল ৪১ হাজার (প্রতিটি ২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে)। করোনার পর থেকে আইসিডিগুলোতে কন্টেইনার হ্যান্ডেল ২৫ শতাংশ কমে গেছে। বিশ্বমন্দা ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কমে গেছে হ্যান্ডেলের পরিমাণ। আইসিডিগুলোতে কন্টেইনার ধারণক্ষমতা ৬৫ হাজার। শনিবার প্রাইভেট আইসিডিগুলোতে পণ্যভর্তি কন্টেইনার ছিল ৫৫ হাজার ৪২০টি। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি হলো খালি কন্টেইনার। ডিপোগুলোতে হ্যান্ডেল কমলেও লাইসেন্স পেয়েছে নতুন আরও দুটি প্রাইভেট আইসিডি। 
অন্যদিকে আইসিডিগুলোতে এখনও গড়ে উঠেনি নিজস্ব অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা। আর্থিক অসংগতির কারণ তুলে ধরে আইসিডিগুলোতে স্থাপন হচ্ছে না ব্যয়বহুল স্ক্যানার মেশিনও। সব মিলিয়ে প্রাইভেট আইসিডিগুলো সংকটময় সময় পার করছে বলে মনে করেন বন্দর সংশ্লিষ্টরা।

চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর অব্যাহত চাপ কমাতে চট্টগ্রাম বন্দর এলাকার আশপাশে আইসিডি গড়ে তোলা হয়। উদ্দেশ্য ছিল আমদানি ও রফতানি পণ্যের বড় অংশ বন্দরের বাইরে হ্যান্ডেল করা। চট্টগ্রাম বন্দরের আশপাশে একে একে আইসিডির সংখ্যা ১৯টিতে গিয়ে পৌঁছে। ১৯৮৫ সালে বেসরকারি উদ্যোগে প্রথম আইসিডি স্থাপিত হয়েছিল। ১৯৯৮ সালে এনবিআরের এক অফিস আদেশের আওতায় আইসিডিগুলো তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। ২০১৬ সালে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে। নতুন নীতিমালায় পুরোনো আইসিডিগুলো বন্দর এলাকার বাইরে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশনা আছে কি নেই, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে বহুদিন ধরেই। তবে আইসিডিগুলো বন্দর এলাকার বাইরে সরিয়ে নিতে সুস্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা নেই বলে দাবি করেছেন আইসিডি মালিকরা।

এ ছাড়া গেল দুই বছরে আরও দুটি প্রাইভেট আইসিডি লাইসেন্স পেয়েছে। বর্তমানে আইসিডির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১টিতে। নতুন আইসিডিগুলোতে পণ্য হ্যান্ডেলও শুরু হয়েছে। তবে লাইসেন্সের শর্ত অনুযায়ী এসব আইসিডিতে হ্যান্ডেল হচ্ছে খালি কন্টেইনার। নির্ধারিত সময় পার হলে এসব আইসিডিতে পণ্যভর্তি আমদানি ও রফতানি কন্টেইনার হ্যান্ডেল করা যাবে। বর্তমানে ১৯ আইসিডিতে ৩৭ ধরনের আমদানি পণ্যের পাশাপাশি হ্যান্ডেল হচ্ছে বিপুল পরিমাণ রফতানি পণ্য। রফতানি পণ্যের প্রায় শতভাগ এবং আমদানি পণ্যের ২৫ শতাংশ আইসিডিগুলোর মাধ্যমে হ্যান্ডলিং হয়।

রফতানি পণ্যের কন্টেইনার কাভার্ডভ্যান ট্রেইলারে করে আইসিডি থেকে চলে যায় চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে। এরপর কন্টেইনারগুলো নির্ধারিত জাহাজে বোঝাই করা হয়। একইভাবে নির্ধারিত আমদানি পণ্যের কন্টেইনারগুলো জাহাজ থেকে নামানোর পর নিয়ে যাওয়া হয় প্রাইভেট আইসিডিতে। শুল্ককর পরিশোধের পর তা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ডেলিভারি নিয়ে যায়। আবার পণ্য খালাসের পর আমদানিকারকের গুদাম থেকে খালি কন্টেইনার নিয়ে আসা হয় আইসিডিতে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মোট ধারণক্ষমতার চেয়ে অন্তত ২৫ হাজারেরও বেশি কন্টেইনার রাখার ব্যবস্থা আছে আইসিডিগুলোতে। কিন্তু বর্তমানে ধারণক্ষমতার সমান কন্টেইনার নেই। বিশ্বমন্দা ও চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ আসা-যাওয়া কমে যাওয়ায় কন্টেইনার হ্যান্ডেল কমে গেছে। এনবিআরের শর্ত অনুযায়ী এখনও স্থাপন হয়নি পণ্য পরীক্ষার স্ক্যানার মেশিন। নেই আধুনিক অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থাও। ২০২২ সালের জুনে সীতাকুণ্ড এলাকার বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বিপুল প্রাণহানির পর অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বিভিন্ন স্তরে দাবি ওঠে। কিন্তু সেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর দুই বছর পার হতে চললেও কমেনি অগ্নিঝুঁকি। 

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আইসিডিগুলোতে রফতানি কন্টেইনার রাখার সক্ষমতা ১৫ হাজার। শনিবার ছিল ৭ হাজার ১২০টি। আমদানি কন্টেইনার রাখার ক্ষমতা ১২ হাজার। শনিবার ছিল ৭ হাজার ৩০০টি। বড় অংশজুড়েই পড়ে আছে খালি কন্টেইনার। সংখ্যায় তা ৪১ হাজারেরও বেশি। গেল দুই বছরে আরও দুটি প্রাইভেট আইসিডি লাইসেন্স পেয়েছে। নতুন লাইসেন্স পাওয়া একটি আইসিডি চট্টগ্রাম বন্দর এলাকার ২০ কিলোমিটারের মধ্যে। এটির নাম অ্যাঙ্করেজ কন্টেইনার ডিপো লিমিটেড। আরেকটি ২০ কিলোমিটারের চেয়ে কিছুটা দূরে। এটির নাম বে লিংক কন্টেইনার ডিপো লিমিটেড। দুটি ডিপোতে শুধু খালি কন্টেইনার হ্যান্ডেল হচ্ছে। ২১টি আইসিডিতে দৈনিক গড়ে কন্টেইনার হ্যান্ডেল হয় ৬ হাজার ৫০০টি। এর মধ্যে ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ আমদানি কন্টেইনার হ্যান্ডেল হয়। ডেলিভারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতিদিন ১ হাজার আমদানি কন্টেইনার ডেলিভারি হয়। প্রতিদিন খালি কন্টেইনার ডেলিভারি হয় ২ হাজার। 

প্রাইভেট আইসিডি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) সভাপতি নুরুল কাইয়ুম শনিবার সময়ের আলোকে বলেন, বিশ্বমন্দার এ সময় চরম দুর্দিন যাচ্ছে আইসিডিগুলোতে। আগে স্থাপন করা ১৯টি প্রাইভেট আইসিডিতে কন্টেইনার স্টোরেজ ক্যাপাসিটি ৬৫ হাজার (প্রতিটি ২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে)। বর্তমানে আইসিডিগুলোতে খালি কন্টেইনার আছে ৪১ হাজারেরও বেশি। কন্টেইনার আসা-যাওয়া বাড়বে মন্দা পরিস্থিতির উত্তরণ হলে। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। তাতে আইসিডিগুলোতে বাড়েনি কন্টেইনার হ্যান্ডেল। 

আইসিডিগুলো বন্দর এলাকা থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে না কেন এ প্রশ্নে তিনি বলেন, একটি আইসিডি করতে এখন ৮০০ কোটি টাকা থেকে ১০০০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়। চাইলেই সরিয়ে নেওয়া যায় না। তা ছাড়া এনবিআরের এরকম কোনো নির্দেশনাও নেই।

স্ক্যানার বসানোর নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়েছে কি না এ প্রশ্নে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের এন্ট্রি পয়েন্টে স্ক্যানার আছে। সেখানে আমদানি-রফতানি পণ্য স্ক্যান করা হয়। আর কোনো স্ক্যানারের প্রয়োজন নেই। এই মুহূর্তে কোনো আইসিডিতে স্ক্যানার না থাকলেও কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তা ছাড়া একটি স্ক্যানার স্থাপন করা অনেক ব্যয়বহুল। বন্দরেই স্ক্যানার বেশি প্রয়োজন। জাহাজ থেকে কন্টেইনার নামানোর পরপরই স্ক্যান করা প্রয়োজন। সেই কন্টেইনার আইসিডিতে পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে যায়। এত দেরিতে কন্টেইনার স্ক্যান করালে স্ক্যানের আর গুরুত্ব থাকে না।

বিকডার সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন শিকদার সময়ের আলোকে বলেন, স্ক্যানার বসানো হয়নি কোনো আইসিডিতে। আইসিডিতে স্ক্যানার করার দরকার নেই। জাহাজ থেকে কন্টেইনার নামানোর পর এন্ট্রি পয়েন্টে স্ক্যানার করতে হয়। এ জন্য বন্দরেই স্ক্যান করতে হবে। বন্দর থেকে ২০-৩০ কিলোমিটার দূরে স্ক্যান করলে স্ক্যানারের প্রয়োজনীয়তাও থাকবে না। কারণ বন্দর থেকে আইসিডিতে নেওয়ার পথে কেউ নিষিদ্ধ পণ্য খুলে নিয়ে নিতে পারে। আবার আইসিডিতে স্ক্যান করা হলে কন্টেইনার বন্দরে নেওয়ার পথে কেউ নিষিদ্ধ পণ্য ঢুকিয়ে দিতে পারে। তাই বন্দরেই স্ক্যানের ওপর জোর দিতে হবে।

নতুন দুটি আইসিডি লাইসেন্স পেয়ে কার্যক্রম শুরু করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, লাইসেন্স পাওয়া আইসিডিতে পণ্য হ্যান্ডেল শুরু হয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সামগ্রিক বিশ্বমন্দা পরিস্থিতির জন্য জাহাজ আসছে কম। তাই হ্যান্ডেল হচ্ছে কম। এতে আইসিডিগুলো পড়েছে আর্থিক ক্ষতির মুখে। গত দেড় বছর ধরে আইসিডিতে কন্টেইনার হ্যান্ডেল ২৫ শতাংশ কম হচ্ছে মন্দার কারণে।

চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ সময়ের আলোকে বলেন, বন্দর এলাকা থেকে আইসিডি দূরে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে। বাস্তবতার আলোকে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি। মূলত আমরা বন্দর ব্যবহারকারীরা যানজটসহ ভোগান্তি এড়াতে প্রাইভেট আইসিডি বন্দর এলাকা থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার পক্ষে ছিলাম।

চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক খাইরুল আলম সুজন সময়ের আলোকে বলেন, আমদানি আগের চেয়ে কমেছে। এ কারণে কন্টেইনার হ্যান্ডেলে ভাটা পড়েছে। তবে প্রাইভেট আইসিডিতে পড়ে থাকা বেশিরভাগ কন্টেইনার ২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বড় অংশ রফতানি হয় তৈরি পোশাক। তৈরি পোশাক ৪০ ফুট দীর্ঘ কন্টেইনারে ভর্তি করা হয়। আর বিদেশ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি হয় ২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে কন্টেইনারে। ২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে কন্টেইনারের চাহিদা কম। ৪০ ফুট দৈর্ঘ্যরে কন্টেইনারের চাহিদা বেশি। আমদানি কম, পাশাপাশি চাহিদাও কম-এ দুই কারণে কন্টেইনারের ভাগাড় হয়ে পড়েছে প্রাইভেট আইসিডি।

অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি
২০২২ সালের ৫ জুন রাতে চট্টগ্রাম নগরী থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে সোনাইছড়ি ইউনিয়নের কেশবপুর গ্রামে বিএম ডিপো নামে কন্টেইনার টার্মিনালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ডিপোতে রাখা রাসায়নিকের কন্টেইনারে বিকট বিস্ফোরণ থেকে ঘটা অগ্নিকাণ্ডে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এই বিপুল ক্ষতির পর ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত রিপোর্টসহ বিভিন্ন তদন্ত রিপোর্টে আইসিডিগুলোতে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুপারিশ করা হয়। সেই সুপারিশ এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। এতে অগ্নিঝুঁকিও কমেনি ডিপোগুলোতে।

এ বিষয়ে চেম্বারের পরিচালক খাইরুল আলম সুজন বলেন, বিএম কন্টেইনার ডিপোতে অনেক ধরনের নিরাপত্তা নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়েছে। সঙ্গে অগ্নিনিরাপত্তাও যথাযথভাবে করা হয়েছে। অন্য আইসিডিগুলোতে এখনও অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা এত জোরদার হয়নি। হয়তো তারা নিরাপত্তা জোরদারের কাজ করে যাচ্ছে।

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close