ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

সোনালি আঁশে আলেয়ার দিনবদল
প্রকাশ: বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ৮:০৩ এএম  (ভিজিট : ২৪৬)
ফরিদপুরের আলেয়া বেগম। নব্বই দশকে স্কুলের গণ্ডি শেষ করার আগেই সংসারে ঢুকে পড়েন আলেয়া বেগম। এসএসসির ফরম ফিলআপ করার পরে পালিয়ে নিজের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করে পুরোপুরি সংসারী হয়ে ওঠেন তিনি। কিন্তু তখনো মাথায় ছিল পড়াশোনার ঝোঁক। শ্বশুরবাড়ির আপত্তির মুখেও বিভিন্ন জায়গায় টিউশনি করে তিনি এসএসসি পাস করেন। বিয়ের বছর ঘুরতেই কোলজুড়ে আসে মেয়ে। খরচ বেড়ে যাওয়ায় বেকার বরের সংসারে অভাব ভর করতে শুরু করে। ফলে বাধ্য হয়েই পড়াশোনার ইতি টানতে হয় তাকে। তাই জীবন নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেন। স্থির করেন ভালোমতো টিকে থাকতে প্রয়োজন নিজস্ব পরিচিতি ও আর্থিক সচ্ছলতা। এমন চিন্তা থেকে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই ১৯৯৩ সালে যুব উন্নয়ন অধিদফতর থেকে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালনের ওপর ৩ মাসের প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে যুব উন্নয়ন থেকে ২৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ১টি গাভি ও কিছু হাঁস-মুরগি দিয়ে খামার শুরু করেন। 

এরপরই শ্বশুরবাড়ির চাপের মুখে পড়েন আলেয়া বেগম। সংসার বাদ দিয়ে খামার করার ব্যাপারটি কোনোভাবেই মানতে পারছিলেন না তারা। খামারের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। তবে বর ফয়জুল হক মিটুল তার স্ত্রীর প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। দুজনে মিলে সেই খামারে হারিকেন জ্বালিয়ে হাঁস-মুরগি পালন করতে থাকেন। এর কিছুদিন পর একটি এনজিওর মাধ্যমে হস্তশিল্পের কাজে প্রশিক্ষণ নেন। পরে যুব উন্নয়ন থেকে ব্লক, বাটিক ও সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করেন হাতের তৈরি পণ্যের ব্যবসা। একাই তৈরি করতে থাকেন নকশি কাঁথা, থ্রিপিচ, ওয়ান পিচসহ নানা পোশাক। সেই পোশাক বিক্রির জন্য ১৯৯৭ সালে তিনি স্থানীয় হেলিপোর্ট বাজারে একটি দোকান নেন। সেখানেও আসে শ্বশুরবাড়ির বাধা। তাই স্বামীর হাতে দোকানের ভার তুলে দিয়ে এলাকার অসহায় ২০ নারীকে নিয়ে মাসিক ১০ টাকা করে সঞ্চয়ের মাধ্যমে একটি সমিতি গঠন করেন। যেখানে আলেয়া বেগম এই ২০ জন অসহায় নারীকে বিনামূল্যে বাটিক-ব্লক ও সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলেন কারখানা। এভাবে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে আলেয়া বেগমের ব্যবসার পরিধি। একই সঙ্গে তার হাত ধরে অসংখ্য নারীর জীবনে অর্থনৈতিক পরিবর্তন আসতে শুরু করে। 

আলেয়া বেগমের প্রতিষ্ঠানের নাম আলেয়া হ্যান্ডিক্রাফট। সমাজসেবা অধিদফতর, মহিলা বিষয়ক অধিদফতর এবং বিসিক শিল্পে তালিকাভুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে সময়ের পরিক্রমায় একজন সাধারণ নারী থেকে আলেয়া বেগম হয়ে ওঠেন নারী উদ্যোক্তা। বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রজেক্টের মাধ্যমে এখন তিনি গোপালগঞ্জ, কুমিল্লা, কুষ্টিয়া, খুলনা, রাজবাড়ীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। আর বিভিন্ন জেলায় প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে পাটপণ্যের চাহিদা দেখে সেই পাটপণ্যের ওপর আগ্রহ বাড়তে থাকে তার। পরে পাটপণ্যের ওপর প্রশিক্ষণ নেন। হাতের তৈরি পণ্য নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকায় ২০১৫ সালে নিজ প্রতিষ্ঠানে শুরু করেন পাটজাত পণ্যের নতুন উইং। 

বর্তমানে আলেয়া বেগমের কারখানায় একশ থেকে দেড়শ নারী পাটপণ্যের ওপর কাজ করেন। যাদের মধ্যে ৪ জনকে তিনি মাসিক বেতনে এবং বাকি নারীকর্মীদের পণ্যভিত্তিক পারিশ্রমিক দিয়ে থাকেন। হাতে তৈরি এসব পণ্যে মাস শেষে আলেয়া বেগমের আয় ৭০-৮০ হাজার টাকা। পাটপণ্য বেশি লাভজনক হওয়ায় ধীরে ধীরে পোশাক তৈরির কাজ ছেড়ে দেন তিনি। 

আলেয়া বেগম বলেন, পাট নিয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়াই ছিল আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। এই সুযোগ না পেলে পাটের সঙ্গে এত ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হতে পারতাম না। আর সফল উদ্যোক্তা হওয়াও সম্ভব হতো না। পাটের কারণেই আমার এত সুনাম ছড়িয়েছে।

ফরিদপুরের গোয়ালচামট এলাকায় আলেয়া বেগমের কারখানা। করোনার আগে সেখানে বিভিন্ন শিফটে একশ থেকে দেড়শ কর্মচারী কাজ করতেন। তবে করোনা ভাইরাসের ছোবলে সেসব এখন শুধুই গল্প। তবে করোনার ভয়াবহতা কাটিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করে ঋণ পরিশোধ করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তিনি। বর্তমানে আলেয়া বেগমের কারখানায় পাটের তৈরি ব্যাগ, জানালার পর্দা, বেড কভার, কুশন কভার, সোফা কভার, টেবিল রানার, ওয়াল ম্যাট, টিস্যু বক্স, পেন হোল্ডার, ফুলদানি, টেবিল ম্যাট, ডোর বেল, লেডিস পার্টস, হাতপাখা, ড্রিম ক্যাচারসহ শতাধিক পণ্য তৈরি করা হয়।

নিজ আগ্রহে ফরিদপুর জেলাসহ সারা দেশে পাটজাত পণ্যের প্রসারে কাজ করে যাচ্ছেন আলেয়া বেগম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার নাম ছড়িয়েছে, মিলেছে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতিও। জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা, বিভাগীয় পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ জয়িতা, জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ যুব পুরস্কার, সমবায় পুরস্কারসহ নানা ধরনের পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। চলতি বছর পাট ও বস্ত্র মেলায় অংশ নিয়ে সর্বাধিক পাটপণ্য নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসেন তিনি। পাটপণ্যের প্রসারে আমৃত্যু এভাবেই কাজ করে যেতে চান বলে জানান এই উদ্যমী নারী উদ্যোক্তা। 

সময়ের আলো/জেডআই




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close