ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

মা মাটি এবং গন্তব্য!
প্রকাশ: শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ২:৪১ এএম  (ভিজিট : ৯৯৬)
শহরের যান্ত্রিক জীবনের অভ্যস্ততা অনেকটা স্বভাববিরুদ্ধ উপলব্ধি। যেখানটায় ইটপাথরের মিতালি এবং জাগতিকতাই সর্বস্ব। আধুনিকতার নানা উপকরণের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা, মন-মানসিকতায় বাস্তবতা এবং ব্যস্ততার অজুহাতে রসকষহীন প্রাণীতে রূপান্তর হওয়া যেন আদিখ্যেতা নয়। সময়ের স্রোতে সমাজ সংসার থেকে সামাজিকতা আবেগ ভালোবাসা দায়িত্ববোধ মমতা এবং জবাবদিহিতা যেন ঠুনকো হয়ে যাচ্ছে। এসব সমীকরণের মাঝেও মা এবং মাটি সবসময়ই প্রশান্তি সজীবতা আবেগ ভালোবাসা এবং আন্তরিকতার জয়ধ্বনির জিকির তোলে। যখন নানা ধরনের ঝুট-ঝামেলা অস্থিরতা এবং বিষণ্ণতায় অবসাদগ্রস্ত হয়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু হয়, তখন মা এবং মাটি নতুন করে বাঁচার রসদ জোগায়। এ যেন বিনি সুতোর টান। যেখানটায় মা এবং মাটির স্পর্শ সব যাতনা অসহায়ত্ব অভাব অনুযোগ অপ্রাপ্তি ক্ষণিকের তরে ভুলে গিয়ে স্বর্গীয় আভায় উচ্ছ্বসিত হই। এ সবই মিরাকল!

গ্রামের মেঠোপথ ধরে চলা অগ্রহায়ণে আমনের আগমনি বার্তা, পৌষের পিঠা পায়েস, শীতের সকালে স্নিগ্ধ রোদ, দিনভর আড্ডা, সরষে ফুলের সুশোভিত রূপ, পাটশাক, মায়ের হাতের রান্না, নির্ভেজাল বায়ু সেবন- এসব আজ অনেকটা অধরা। ছেলেবেলার এসব প্রাপ্তি আজও স্মৃতির পাতায় তৃপ্তির অনুভূতি জাগায়। গ্রামের মানুষের সহজ মনোভাব, পারস্পরিক বোঝাপড়া, মেলায় জনতার উপস্থিতি, ওয়াজ মাহফিলে দল বেঁধে যাওয়া, খেলার সাথি সবই মনে পড়ে।

আমার জনপদ, আমার অস্তিত্ব এবং ভালোবাসা। সময়ের বিবর্তনে আজ অনেক বয়স হয়েছে। চাইলেই অনেক কিছু করা যায়। তারপরও সবসময় না পাওয়ার বিষাদ। কেন? বাবার চাকরির সুবাদে যা খেয়েছি এবং দেখেছি এসব আজ স্বপ্ন। চাইলেও তা বাস্তবায়ন করা দুরূহ। সে সময় বর্ষা এবং শীতের আগমন হতো নিয়ম করে। বাড়ির পাশের জমিতে বর্ষার পানিতে দাবড়ানো কি চাইলে ফিরে পাওয়া যাবে? কই শিং চিতল ডিম দুধের কি দেখা মিলবে? এখনও মনে পড়ে বৈশাখ মাসে ঝড় বৃষ্টিতে পুকুর থেকে বেয়ে ওঠা কই মাছের লাফঝাঁপ। আম কাঁঠাল লিচু কলাসহ নানা ফল প্রতিবেশীসহ মিলেমিশে ভোগ করতাম। এ যেন অমলিন আনন্দ। আজও বাড়িতে গেলে দেখা যায় লেবুসহ নানা ফলে প্রতিবেশীর অধিকারের স্বীকৃতি। দেখে পুলকিত হই।

যেথায় মায়ের বাস, সে জায়গাটা আমার অনেক প্রিয়। মায়ের কথা সবসময় মনে হয়। যদিও সময় করে সবসময় খোঁজ নিতে পারি না। নিঃশ্বাস এবং প্রশ্বাসে উপস্থিতি অনুভব করি। এ যেন পরম সৌভাগ্য। মায়ের চাহনি আমাকে গ্রামে যেতে বেশি প্রলুব্ধ করে। যদিও সংসারের বেড়াজালে অনেক সময় সুযোগ হয়ে ওঠে না। তখন নিজেকে অপরাধী মনে হয়। যে সময় মায়ের পাশে থাকাটা ছিল কর্তব্য- তখনই কি না বেমালুম সংসার চাকরি জাগতিকতার মোহে আবিষ্ট। এসব আমার ভালো লাগে না। চাইলে কি নাট্যশালার অভিনয়ে ইস্তফা দেওয়া যাবে? মায়ের অবয়ব চাহনি ভালোবাসা এবং দোয়া সবসময়ই ঝড় তুফানে নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে। মাকে সবসময় মনে পড়ে অথচ মরীচিকার চাকচিক্যের মোহ এসবের বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ভাবি- এ ভবে আর কয়দিন বাঁচব? অথচ চাওয়া-পাওয়ার হিসাবে বিরতি নেই!

নেট দুনিয়ার বিস্তৃতি আধুনিক উপকরণের উপস্থিতি শিল্পায়নের অশুভ এবং অপরিকল্পিত থাবায় জনপদ আজ রক্তাক্ত। ভালোবাসার উঠোনে আজ মাদকের ছোবল হানাহানি এবং নিয়ত স্বার্থের দ্বন্দ্ব। এসব পীড়া দেয়। শিক্ষার সম্প্রসারণে আজ ঘরে ঘরে প্রত্যাশার আলো জ্বলছে। এসবে আনন্দ পাই। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আলোকিত সন্তানদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নানা আয়োজনে নিজেকে সম্পৃক্ত হওয়ার স্বপ্ন দেখি। প্রজন্ম আজ নানাভাবে আক্রান্ত। পরিবেশ-প্রতিবেশ যেখানটায় বড় বাধা। শিল্প ও পুঁজির প্রভাবে প্রকৃতির মলিন এবং ভগ্ন চাহনি সহ্য করা কঠিন।

ছোটবেলার গ্রামের সঙ্গে আজকের ছবির বেশ ফারাক। উন্নয়নের ছোঁয়ায় পায়ে হাঁটার রাস্তার বিলুপ্তি এবং রিকশা ভ্যানের আকাল। শব্দদূষণ বায়ুদূষণ এবং পানির অনিরাপদ উপস্থিতিতে ইতিমধ্যে হারিয়ে ফেলেছি শৈশবের নৌ চলাচলের স্বাভাবিক রাস্তা। আজ চোখে পড়ে না মাঝির দাঁড়টানা নৌকা বাওয়ার ছবি। দেশীয় প্রজাতির মাছ অনেকটাই হারিয়ে যেতে বসেছে। নানা রকমের অস্থিরতা পল্লীতেও জেঁকে বসেছে। ডিভাইসপ্রীতি প্রজন্মের মাঝে অন্তর্মুখী  স্বভাবের বিস্তৃতি ঘটাচ্ছে। দেখা হলে কথা বলতে চায় না। মানুষ কী করে কথা না বলে থাকতে পারে? মানুষ সামাজিক জীব- এ তকমা কি ভুলতে বসেছে? গন্তব্য কোথায়?

পেশাগত জীবনের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেও আজ হৃদয়ে হাহাকার এবং অতৃপ্তি। কেনই বা হবে না? যেখানটায় আমার পক্ষে মায়ের পাশে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। এ বয়সে একাকিত্ব! নানা আশঙ্কায় মায়ের কাছেই থাকার কথা। অথচ চাইলেই কি পারি? এ কেমন জীবন? লাভ এবং লোভ আমাকে টানে না। শহরের চাকচিক্য ভোগবিলাস পছন্দ হয় না। যেখানে মায়ামমতা গৌণ মেকি ভালোবাসাই প্রধান, সেখানটায় কি সবসময় থাকা যায়? আভিজাত্য এখানটায় বেশ শক্তিশালী। যা ধারণ এবং লালন কোনোটাই করতে পারি না। শহরের জীবনেও নানা উপকরণে নিজেকে বেমানান লাগে। তাহলে যাব কোথায়? চাইলেই কি জনপদে ফিরে যাওয়া যাবে? এ যেন বিশাল প্রশ্ন?

জীবন সংসারে এসবের সঙ্গে অভিযোজন করেই চলতে হবে। মায়ের দোয়া এবং ভালোবাসাকে উপজীব্য করে তৃপ্তির হাসি ঠোঁটে লাগাতে হবে। সময়ের স্রোতে অনেকে গত হলো। আর কয়দিন বাঁচব। নানাভাবে নিজেকে মেলে ধরে বাতাসের দায় মুক্তির পথ খুঁজতে হবে। এলাকার মানুষ যদি ভালো থাকে নিজেকে সুখী মনে হয়। প্রজন্মের সুখানুভূতি এবং ভালো খবরে বেশ প্রশান্তি পাই। সবসময় নিজেকে কাদামাটির অতীত মানুষ ভাবতেই ভালো লাগে। ভালো লাগতেই হবে! কেননা জীবিত অবস্থায় এ বাতাসের স্পর্শ প্রশান্তি আনে। শেষ বিদায়েও যাদের উপস্থিতি এবং দোয়া পরপারে রসদ জোগাবে, সেই মা মাটি এবং মানুষেরাই পরম আরাধ্য এবং স্বজন। জনপদের আলো বাতাস বিশুদ্ধ হোক,  ভালোবাসা ফিরে আসুক। সুন্দর এবং স্বপ্নিল জনপদের আকাক্সক্ষায়।

লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সময়ের আলো/জেডআই




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close