ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

হস্তশিল্পে ঘুরল জান্নাতের ভাগ্যের চাকা
প্রকাশ: বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪, ৩:৪১ এএম  (ভিজিট : ৩৭২)
মোছা. শারমিন জান্নাত। জামালপুর পৌর শহরের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বেলটিয়া পলিশা পশ্চিমপাড়া এলাকার দরিদ্র সিএনজি চালক মো. শাহজামালের বড় মেয়ে। পরিবারের দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় জান্নাত। ছোট বেলা থেকেই জান্নাত বেড়ে উঠেছেন অভাব আর দরিদ্রতার মধ্য দিয়ে। ২০১৪ সালে বাবা-মার অভাবের সংসারে বেড়ে ওঠা শারমিনের বয়স যখন ১৪, ঠিক সেই সময়ই ঘটে অঘটন।

বাবা শাহজামাল ও মা মর্জিনা বেগম পাশের গ্রাম পৌর শহরের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের বামুনপাড়া এলাকার মোটরযান শ্রমিক মো. হাবিবুর রহমান অপলের ছেলে কাকনের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেয় তাকে। বিয়ের সময় শারমিন জান্নাত বেলটিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। পারিবারিকভাবে চুপিসারেই তার বিয়ে সেরে ফেলা হয়। কেননা তখনও যে জান্নাতের বিয়ের বয়স হয়নি। অল্প বয়সে বেকার স্বামীর ঘরে এসে কিশোরী মেয়েটি হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই সংসার সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না তার। এর ওপর অভাবের টানাপড়েনের সংসার। আয়-রোজগার তেমন না থাকায় অল্প বয়সি স্বামী কাকনও দিশাহারা হয়ে পড়েন। বরের স্বল্প আয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ছিল। কিন্তু জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে অপ্রতুল জ্ঞান থাকায় জান্নাতের যেন কিছুই করার ছিল না। অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে এভাবেই কাটতে থাকে জান্নাত-কাকনের দাম্পত্য জীবন। 

অভাবের সংসারে মেয়ের দুরবস্থা দেখে এগিয়ে আসেন জান্নাতের বাবা। কাকনকে কিছু একটা করার জন্য জান্নাতের বাবা শাহজামাল কিছু টাকা দেন। ওই টাকা থেকেই ১৫ হাজার টাকা নিয়ে হস্তশিল্পের ব্যবসা শুরু করেন জান্নাত। প্রথমে তিনি থান কাপড় কিনে ৮টি সুন্দর সালোয়ার-কামিজ তৈরি করে তা সহজেই বিক্রি করেন। এতে কিছু টাকা লাভ থাকে। পরবর্তী সময়ে ওই টাকা দিয়ে আবারও থান কাপড় কিনে জামা তৈরি করেন জান্নাত। পরে ওই সব তৈরি জামার ওপর বাহারি রঙের সুতা দিয়ে হাতের কাজ করে সহজেই তা বিক্রি করেন জান্নাত আর এভাবেই শুরু হয় তার হস্তশিল্পের ব্যবসা। এরই মধ্যে জন্ম নেয় তাদের প্রথম সন্তান অপূর্ব। সন্তানের নামানুসারে জান্নাত তার দোকানের নামকরণ করেন অপূর্ব হস্তশিল্প। 

ছেলে অপূর্বের জন্মদিনে আগত অতিথিদের কাছ থেকে ৬ হাজার টাকা উপহার পান জান্নাত। ওই উপহারের টাকা থেকে ৫ হাজার ৭০০ টাকা দিয়ে জান্নাত একটি সেলাই মেশিন কেনেন। সেই মেশিন দিয়েই এলাকার মহিলাদের সালোয়ার-কামিজ বানানোর কাজ শুরু করেন। এরই মধ্যে জান্নাত স্থানীয়দের মাধ্যমে জানতে পারেন যুব উন্নয়ন অধিদফতরের সেলাই প্রশিক্ষণের কথা। পরে তিনি শহরের বেলটিয়া এলাকায় যুব উন্নয়ন অধিদফতরের সেলাই প্রশিক্ষক মোছা. শামীমা বেগম মুনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ সময় ওই প্রশিক্ষক জান্নাতের কষ্টের কথা শুনে তাকে যুব উন্নয়নে সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্যবসা শুরুর পরামর্শ দেন। সে অনুযায়ী ২০২১ সালে জান্নাত যুব উন্নয়ন অধিদফতরে তিন মাসের সেলাই প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন করেন। প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় তাকে যুব উন্নয়ন অধিদফতরের ব্লক বাটিক, সেলাই ও পাটজাত পণ্য তৈরির ভ্রাম্যমাণ প্রশিক্ষক মোছা. ছাইদা বেগম শ্যামা অনেক সহযোগিতা করেন বলে জানান শারমিন জান্নাত। 

জানা যায়, জামালপুর যুব উন্নয়ন অধিদফতরের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক (বর্তমান সিলেট জেলার উপ-পরিচালক হিসেবে কর্মরত) মো. রফিকুল ইসলাম শামীম ওই সময় জান্নাতের কর্মদক্ষতা দেখে বেশ খুশি হন। প্রশিক্ষণ শেষে তিনিই জান্নাতকে যুব উন্নয়ন অধিদফতর থেকে সহজ ঋণ সুবিধায় ৬০ হাজার টাকা ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। সেখান থেকেই জান্নাত অপেক্ষাকৃত বড় পরিসরে তার ব্যবসা শুরু করেন। 
জেলা পুলিশ লাইন্সের প্রধান ফটকের পাশেই জান্নাতের অপূর্ব হস্তশিল্পের শোরুম। তার শোরুমে টেইলারিং ব্যবসার পাশাপাশি নানারকম পণ্যের সমাহার। জান্নাতের দোকানে মেয়েদের সব ধরনের পোশাক থেকে শুরু করে হস্তশিল্পের ওয়ান পিস, টু পিস, থ্রি পিস, চাদর, কাঁথা, কুশন-কভার, শাড়ি, লুঙ্গি, গজ কাপড়, কসমেটিকস ছাড়াও রয়েছে বাহারি সব পণ্য। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত চলে জান্নাতের দোকানে বেচাকেনা। 

শুরুতে জান্নাতের দোকানে ব্যবসায়িক পুঁজি ১৫ হাজার টাকা থাকলেও বর্তমানে তা বেড়ে ৪ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। এদিকে জীবনের এত কষ্টকর পথচলাও দমিয়ে রাখতে পারেনি জান্নাতের একাডেমিক পড়াশোনা। ২০১৫ সালে বেলটিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি আর ২০১৭ সালে শহরের জাহেদা সফির মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন উদ্যোক্তা জান্নাত। এত কিছুর পরেও গড়ে প্রতিদিন তার দোকানে এখন প্রায় ১২ হাজার টাকার বিভিন্ন পণ্য বিক্রি হয় বলে জানান জান্নাতের বর কাকন। বর্তমানে জান্নাতের দোকানে ৪০ জন স্থায়ী সেলাই কর্মী রয়েছে বলে জানা যায়। 

দোকানের নিয়মিত ক্রেতা, পাপিয়া, হ্যাপী, হিয়া, রিক্তা, রফিক হওলাদার বলেন, জান্নাতের দোকানের প্রতিটি পণ্যই খুব ভালো। আমাদের এখান থেকে মূল শহর অনেকটা দূরে হওয়ায় আমরা জান্নাতের দোকানের ওপরই নির্ভরশীল। পণ্যের মান ভালো হওয়ায় স্থানীয় অধিকাংশ নারী জান্নাতের দোকান থেকেই তাদের পোশাক তৈরি করে থাকেন।

যুব উন্নয়ন অধিদফতরের সেলাই প্রশিক্ষক মোছা. শামীমা বেগম মুন বলেন, জান্নাত মেধাবী উদ্যোক্তা। তিনি স্বল্পসময়ের ভেতরেই পোশাক তৈরির কলাকৌশল রপ্ত করতে সক্ষম হয়েছেন।

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close