বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কিংবা বাংলা কবিতার ইতিহাস নিয়ে কথা বলতে গেলে তার নামটি চলে আসে। তিনি বাঙালি, বাংলাদেশি বা বাংলাভাষী নন। বলছি অ্যালেন গিন্সবার্গের কথা। পুরো নাম আরউইন অ্যালেন গিন্সবার্গ। মার্কিন কবি, লেখক ও গীতিকার। ছিলেন বিট জেনারেশনের নেতৃত্বস্থানীয়। অ্যালেন গিন্সবার্গ ১৯২৬ সালের ৩ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে এক ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম লুইস গিন্সবার্গ এবং মায়ের নাম নওমি লিভারগ্যান্ড গিন্সবার্গ। তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান। শৈশবে বেড়ে ওঠেন প্যাটারসন এলাকায়।
কৈশোর থেকেই তিনি ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় রাজনৈতিক ইস্যু যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, শ্রমিকের অধিকার নিয়ে পত্র লিখতে শুরু করেন। ‘প্যাটারসন মর্নিং কল’ পত্রিকায় তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে থাকা অবস্থাতেই গিন্সবার্গ ওয়াল্ট হুইটম্যানের সাহিত্যকর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯৪৩ সালে তিনি ইস্টসাইড হাই স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েট হন। ইয়ং ম্যান হিব্রু অ্যাসোসিয়েশন স্কলারশিপ পেয়ে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে প্রবেশ করার আগে কিছুদিনের জন্য মন্টক্লেয়ার স্টেট কলেজে ভর্তি হন।
কলম্বিয়ায় পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য গিন্সবার্গ ১৯৪৫ সালে মার্চেন মেরিনে যোগ দেন। এ সময় তিনি কলম্বিয়া রিভিউসহ কয়েকটি পত্রিকায় কন্ট্রিবিউটর হিসেবে কাজ করেন এবং বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন। কলম্বিয়ায় প্রথম বর্ষে পড়ার সময় গিন্সবার্গের সঙ্গে লুইসিয়েন কারের সাক্ষাৎ হয়। তিনিই গিন্সবার্গের সঙ্গে ভবিষ্যতের বিট লেখক জ্যাক কেরোয়াক, উইলিয়াম এস বুরোস এবং জন ক্লেলন হোমস-সহ অনেকের পরিচয় করিয়ে দেন। ১৯৪৮ সালে কলম্বিয়া ত্যাগ করার পর তিনি প্রচুর ভ্রমণ করেন। এ সময় তিনি ক্যাফেটেরিয়ার ফ্লোর পরিষ্কার করার কাজ থেকে শুরু করে বাজার গবেষকের কাজও করেন।
‘হাওল অ্যান্ড আদার পোয়েমস’ গিন্সবার্গের প্রথম প্রকাশিত বই। ১৯৫৬ সালে বইটি প্রকাশিত হয়। এই বইয়ের কবিতায় তিনি বলতে চেয়েছেন, তার সময়ের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা ধ্বংস হয়ে গেছে। এই বই তাকে বিপুল পরিচিতি এনে দেয়।
সমালোচক জেমস এল. ডিকে বলেছেন, ‘হাওল-এ উত্তেজনার চাবুক চালিয়েছেন।’ কোনো কোনো সমালোচক এই বইয়ের কবিতাকে গভীরভাবে ইতিবাচক বলেছেন। রিচার্ড এবারহার্ট ‘হাওল’কে শক্তিশালী কাজ হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, যান্ত্রিক সভ্যতা, যা আমাদের আত্মাকে হত্যা করে, তার বিরুদ্ধে এটি একটি চিৎকার। ভালোবাসাই এর নেপথ্যে ইতিবাচক শক্তি জুগিয়েছে। তবে ‘হাওল’ তাকে খ্যাতির পাশাপাশি কিছু অখ্যাতিও দিয়েছে। ১৯৫৭ সালের ২৫ মার্চ ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করা হাওল-এর ৫২০ কপি বই অশ্লীলতার দাবি তুলে কাস্টমসের কর্মকর্তারা জব্দ করেন। জুন মাসে সিটি লাইট বুকস্টোরের ম্যানেজার সিং মুরাওকে সানফ্রান্সিসকোর পুলিশ এই বই বিক্রির দায়ে গ্রেফতার এবং জেলে প্রেরণ করে।
১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় কাব্য ‘ক্যাডিশ অ্যান্ড আদার পোয়েমস’। এই বইটিও তার খ্যাতি আরও বাড়িয়ে দেয়। একই বছর তার আরও একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয় ‘এম্পটি মিরর : আর্লি পোয়েমস’ শিরোনামে। ‘হাওল’ এবং ‘ক্যাডিশ’-এর কবিতাগুলো একই আঙ্গিকে রচিত।
গিন্সবার্গ তার সব সৃষ্টিকর্মকে আত্মজৈবনিক বলেই অভিহিত করেছেন। তবে ‘হাওল’ শুধু তারই আত্মজীবনী, তা নয়, এখানে বিট জেনারেশনেরও ইতিহাস বলা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে গিন্সবার্গ আরও বলেন, ‘হাওল’-এর একটি বড় অংশ লেখা হয়েছে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত মায়ের প্রতি আবেগ থেকে। ধারণা করা হয়, ‘ক্যাডিশ’-এর উৎসভূমিও মায়ের প্রতি ভালোবাসা।
হাওল-এ গিন্সবার্গের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা বন্ধুদের কথাও বলা হয়েছে। কবিতার শুরুতেই বলা হয়েছে, আমি দেখেছি, আমার প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ প্রতিভাগুলো পাগলামিতে ধ্বংস হয়ে গেছে।’
অ্যালেন গিন্সবার্গ ষাটের দশকে ভারতে আসেন। তখন তার সঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মলয় রায় চৌধুরীসহ অনেক কবি সাহিত্যিকের সঙ্গে পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হয়। অ্যালেন গিন্সবার্গের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পরই সুনীলদের কৃত্তিবাসের পালাবদল শুরু হয়। কৃত্তিবাসের কবিরা অ্যালেন গিন্সবার্গের সান্নিধ্যে এসে বিটদের কাব্যচেতনা নিজেদের কবিতায় ধারণ করেন। বিটদের কাব্যচেতনার প্রভাব ষাটের দশকে বাংলাদেশেও এসে পড়ে। বিট জেনারেশনের প্রভাব বা হাংরি জেনারেশনের অনুসরণে বাংলাদেশেও স্যাড জেনারেশন গড়ে ওঠে। স্যাড জেনারেশন নামে পত্রিকাও প্রকাশিত হয়।
১৯৭১ সালে অ্যালেন গিন্সবার্গ আবারও কলকাতায় আসেন। এ সময় তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলো ঘুরে দেখেন। আমরা জানি যে, পাকিস্তানি হানাদার পশু নির্মমভাবে বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে কোটি বাঙালি প্রাণ বাঁচানোর জন্য ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন। অ্যালেন গিন্সবার্গ শরণার্থী শিবিরে বাঙালিদের অবস্থা দেখার জন্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। তখন বন্যা এবং ভারী বৃষ্টিপাতে রাস্তাঘাট ডুবে গিয়েছিল। দমদম পেরোতেই অ্যালেনের চোখে পড়ল রাস্তার ধারে সারি সারি ছাউনি। শরণার্থীদের। তারা খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছে। বনগাঁর মুখে এসে গাড়ি থেমে গেল। রাস্তা ডুবে যাওয়ায় গাড়ি এগুবে না। নৌকায় করে সুনীল এবং গিন্সবার্গ বনগাঁ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের যশোর সীমান্তে এসে পৌঁছেন। শিবিরে শরণার্থীদের দুর্দশা দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি দীর্ঘ একটি কবিতা রচনা করেন, ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’।
নাসির আলী মামুনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অ্যালেন গিন্সবার্গ বলেন, ‘শরণার্থী শিবির ঘুরে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল আমার। অক্টোবরে নিউইয়র্কে ফিরে গেলাম। প্রতিদিনই ভাবতে থাকি, বাংলাদেশের জন্য আমি কী করতে পারি। হঠাৎ মাথায় এলো, আমি কবিতা লিখতে তো পারি! লিখেও প্রতিবাদ করা যায়। কদিন ঘরে থেকে লিখলাম দীর্ঘ কবিতা, ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’।
কবিতাটি লেখার পরই তা শোনানোর জন্য ছুটে যান জন লেননের কাছে এবং তা পাঠ করে শোনান। একই বছর ২০ নভেম্বর জর্জ চার্চে ‘বাংলাদেশের জন্য মার্কিনিরা’ শীর্ষক কবিতা পাঠের আসরে এই কবিতা আবৃত্তি করেন। দর্শকদের সারিতে সেদিন বব ডিলানও উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে বব ডিলান এই কবিতায় সুরারোপ করেন। কবিতাটি ১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। যদিও সম্পূর্ণ কবিতাটি ছাপা হয়নি। ছাপা হয়েছিল মাত্র অর্ধেক। পুরো কবিতাটি পাওয়া যাবে অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘দ্য ফল অব আমেরিকা’ গ্রন্থে। বইটি ১৯৭২ সালের ১ জুন প্রকাশিত হয়। ১৯৭৩ সালে এই বইয়ের জন্য তিনি ‘ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করেন।
‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতায় যুদ্ধের নির্মম চিত্র এঁকেছেন। পাকিস্তানি বোমারু বিমানের আঘাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া মানুষের ঘরবাড়ি, ছিন্নভিন্ন মানুষের দেহ, পায়ে হেঁটে, গরুর গাড়িতে করে বাঁচার উদ্দেশ্যে মানুষের কলকাতা যাত্রা, খোলা আকাশের নিচে রাতযাপন, অনাহার, অসুস্থ মানুষের কথা বিশেষ করে শরণার্থী শিবিরে শত শত শিশুর মারা যাওয়ার কথা এই কবিতায় তুলে ধরেছেন। মানুষগুলো সেদিন এতটাই অসহায় ছিল যে, নালিশ জানানোর মতো কেউ ছিল না তাদের সামনে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্ব জনমত গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখায় অ্যালেন গিন্সবার্গকে বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালে ‘ফ্রেন্ডস অব লিবারেশন ওয়ার’ সম্মাননা (মরণোত্তর) প্রদান করেন।
অ্যালেন গিন্সবার্গ জোরালো স্বৈরতন্ত্র, অর্থনৈতিক বস্তুবাদ এবং যৌন নিপীড়নের বিরোধিতা করেছেন। প্রাচ্যের ধর্মের প্রতি তার ছিল উদার দৃষ্টিভঙ্গি। বৌদ্ধধর্ম এবং কৃষ্ণবাদের প্রতি তার আগ্রহ ছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমেরিকা গিয়ে দলবলসহ অ্যালেন গিন্সবার্গকে ভাঙাসুরে ‘হরেকৃষ্ণ’ গান গাইতে দেখেছেন। শুধু তা-ই নয়, স্বামী প্রভুপাদকে প্রথম মন্দির করার জন্য অর্থ, উপকরণ ছাড়াও নানাভাবে সাহায্য করেছেন।
অ্যালেন গিন্সবার্গের উল্লেখযোগ্য অন্যান্য সাহিত্যকীর্তি হলো-‘প্লানেট নিউজ’, ‘ইন্ডিয়ান জার্নালস’, ‘আয়রন হর্স’, ‘সাদা কাফনের কবিতা : ১৯৮০-১৯৮৫’, ‘নলুমিনিটেড পোয়েমস’, ‘সিলেক্টেড পোয়েমস : ১৯৪৭-১৯৯৫’ প্রভৃতি।
অ্যালেন গিন্সবার্গ ষাটের দশক থেকেই রোগে ভুগতে থাকেন। সত্তরের দশকে তিনি দুবার স্ট্রোক করেন। সত্তর বছর বয়সে হেপাটাইটিস জটিলতার কারণে অ্যালেন লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হন। ১৯৯৭ সালের ৫ এপ্রিল নিউইয়র্ক সিটিতে তিনি মারা যান।
সময়ের আলো/আরএস/