ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

এবার থানায় হামলা
প্রকাশ: শুক্রবার, ৫ এপ্রিল, ২০২৪, ২:১৮ এএম  (ভিজিট : ৫৬৪)
বান্দরবানের থানচি উপজেলার বাজারে প্রচণ্ড গোলাগুলির খবর পাওয়া গেছে। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সশস্ত্র সংগঠনের সঙ্গে পুলিশ ও বিজিবির এ গোলাগুলি চলছিল। থানচি থানার দিকে গুলি করে করে অগ্রসর হচ্ছিল সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। এ সময় বাজারে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন থানচি উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোহাম্মদ মামুন। 

এদিকে শান্তি কমিটি প্রতিষ্ঠার কথা বলে বান্দরবানে রুমা ও থানচিতে ১৭ ঘণ্টার ব্যবধানে তিনটি ব্যাংকে সশস্ত্র ডাকাতির ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে সরকার। গত মঙ্গলবার রাতে ও বুধবার দিনদুপুরে ৩ ব্যাংকের টাকা লুটের সময় ভারী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ)। মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে এ দুটি ভয়ানক সন্ত্রাসী ঘটনার পর দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। এরই মধ্যে সেনাবাহিনী, বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশের একাধিক টিমের সমন্বয়ে যৌথবাহিনী দুর্গম পাহাড়ে অভিযানে নেমেছে। 

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কেএনএফের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ত্রিদেশীয় এই বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কেএনএফকে সম্পূর্ণ নির্মূল না করা পর্যন্ত অভিযান চলবে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলে বিচ্ছিন্নতাবাদী কেএনএফ কয়েক দফা বৈঠক করে। তারা গোপনে চলতি বছরের ১৮ মার্চ থংপং আশ্রমপাড়ায় ঝুম ঘরে গোপন বৈঠক করে। ওই বৈঠকে সশস্ত্র অবস্থায় অন্তত ৩০ জনের একটি দলে কেএনএফের শীর্ষস্থানীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক চলে প্রায় ২ ঘণ্টা। বৈঠক থেকে ব্যাংকে হামলার ছক তৈরি করা হয়। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন গ্রামবাসী জানায়, আগে থেকে কয়েকজন পাহাড়ি এ গ্রামের আশপাশে ছদ্মবেশে ছিলেন। তারা আশপাশের গ্রামে ভাড়া বাসা নিয়ে অবস্থান করছিলেন। 

এদিকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর সোনালী ব্যাংকের রুমা শাখার ব্যবস্থাপক (ম্যানেজার) নেজাম উদ্দীকে উদ্ধার করেছে র‌্যাব। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সময়ের আলোকে বলেন, সোনালী ব্যাংকের রুমা শাখার ম্যানেজার নেজাম উদ্দীনকে মুক্তির বিষয়ে কেএনএফের সঙ্গে যোগাযোগ করেন র‌্যাব সদস্যরা। পরে র‌্যাবের মধ্যস্ততায় নেজাম উদ্দীনকে ফিরিয়ে আনা হয়। বর্তমানে নেজাম ভালো আছেন, সুস্থ আছেন। তাকে উদ্ধারে সব ধরনের কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। এদিকে ঘটনার পরপরই সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক অবস্থানে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বুধবার মধ্যরাতে পুলিশ সদর দফতর থেকে এই নির্দেশ দেওয়া হয়। 

অপরদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সোশ্যাল মিডিয়ায় পর্যটন শিল্প, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধের কঠোর হুমকি দিয়েছে। তাদের সাংগঠনিক সোশ্যাল মিডিয়া পেজের মাধ্যমে এ হুমকি দেয়। সরকারের উদ্দেশে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে পাঠানো হুঁশিয়ারিতে উল্লেখ করা হয়েছে, পাহাড়-পর্বত আমাদের, এ জঙ্গল আমাদের, আমাদের পূর্ব-পুরুষদের সম্পত্তি রক্ষার দায়িত্ব আমাদের। কেএনএফের দাবি মেনে না নিলে এ পাহাড়ে কোনো পর্যটনশিল্প গড়ে উঠতে পারবে না। হবে না কোনো বন-জঙ্গল নিধনের (কাঠ, বাঁশসহ বননির্ভর ব্যবসা) পরিকল্পনাও। বন্ধ হবে রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সব প্রশাসনিক কার্যক্রম। বুধবার সন্ধ্যা ৭টায় এ হুঁশিয়ারিসংবলিত পোস্ট করে তাদের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে।

এরপর হুঁশিয়ারির পর বুধবার থেকে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলার সব বাণিজ্যিক ব্যাংক ও অফিস পাড়ায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।

ব্যাংক লুটের সময় ৪০ জনকে জিম্মি করে অস্ত্রধারীরা
স্থানীয় পুলিশ জানায়, বান্দরবানের থানচিতে দুটি ব্যাংক থেকে টাকা লুট করার সময় বাধা দিতে যাচ্ছিলেন থানচি থানার ওসিসহ পুলিশের একটি দল। এ সময় পুলিশকে লক্ষ্য করে দুই দফা গুলি চালায় কেএনএফ সদস্যরা। তারা ব্যাংক কর্মকর্তা, বিজিবির ২ সদস্য, ৯ জন পুলিশ সদস্য ও ব্যাংকে আসা লোকজনসহ অন্তত ৪০ জনকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে। পুলিশ গুলি চালালে জিম্মিদের গুলি করার হুমকি দেওয়া হয়। ঘটনাস্থলে জিম্মিদশায় থাকা প্রত্যক্ষদর্শী ৪০ জন বলেন, পুলিশ ধৈর্যের পরিচয় না দিলে ব্যাপক রক্তপাত হতো। লাশের পর লাশ পড়ত সেখানে। 

থানচি থানার ওসি জসীমউদ্দীন সময়ের আলোকে বলেন, ব্যাংক লুটের খবর পেয়ে থানা থেকে পুলিশ ফোর্স নিয়ে যখন যাচ্ছিলাম, তখন থানার প্রধান ফটকের সামনে থেকে পুলিশ সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যাই। একইসঙ্গে থানার পেছন দিক থেকেও গুলি করা হয়। পরে বিকল্প পথে পুলিশ ফোর্স নিয়ে ব্যাংকের সামনে যখন যাই, ততক্ষণে অস্ত্রধারীরা টাকা নিয়ে চলে যায়।

তিনি বলেন, আমরা জানতে পারি দুটি ব্যাংকের ভেতরে ব্যাংক কর্মকর্তা, টাকা তুলতে আসা দুই বিজিবি সদস্য, পুলিশ সদস্য, ব্যাংকের গ্রাহকসহ ৪০ জনকে জিম্মি করে রেখেছে অস্ত্রধারীরা। এসব লোককে বাঁচাতে পুলিশ যথেষ্ট ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে।

ওসি আরও বলেন, আমরা জানতে পারি, বুধবার ঘটনাস্থলে তিনটি চাঁদের গাড়ি ছাড়াও ঘটনাস্থল থেকে একটু দূরে শাজাহান পাড়ায় অস্ত্রধারীদের ৪০ জনের আরেকটি দল ছিল।

র‌্যাবের ব্রিফিং : র‌্যাব সদর দফতরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, বান্দরবানের রুমা উপজেলায় সোনালী ব্যাংকে ডাকাতির ঘটনা ঘটে রাত সোয়া ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে। ধারণা করা হচ্ছে সন্ত্রাসী সংগঠন কেএনএফ এ হামলা চালায়। হামলার সময়ে বিদ্যুৎ ছিল না। আমরা এ বিষয়টি তদন্ত করছি। যতটা জেনেছি, হামলায় শতাধিক ব্যক্তি অংশগ্রহণ করে। বৃহস্পতিবার বিকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে নিজ কক্ষে এ কথা বলেন তিনি।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, কেএনএফের রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রম চালানোর বিষয়টি সর্বপ্রথম র‌্যাব সামনে এনেছে। এ কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) টাকার বিনিময়ে জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারকীয়াকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আশ্রয়, অস্ত্র সরবরাহ ও  প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল। এ প্রশিক্ষণের জন্য তারা তিন বছর মেয়াদি চুক্তি করেছিল। সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় র‌্যাব দীর্ঘ একটি অভিযান চালায়। অভিযানে ট্রেনিং সেন্টার শনাক্ত, বিপুল পরিমাণ অস্ত্রসহ শতাধিক জঙ্গি সংগঠনের সদস্য ও কুকি-চিনের ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। 

তিনি আরও বলেন, আমাদের অভিযানের ফলে অনেকটা কোণঠাসা ছিল। সম্প্রতি শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। তাদের সঙ্গে শান্তি আলোচনা চলছিল। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কুকি-চিনের বিরুদ্ধে অভিযান বন্ধ রাখে। এ আলোচনা চলমান অবস্থায় গত ২ এপ্রিল শতাধিক কেএনএফ সদস্য সোনালী ব্যাংকে হামলা চালায়।

খন্দকার আল মঈন বলেন, হামলাকারীরা বাংলাদেশ পুলিশের ১০টি অস্ত্র ও আনসারের ৪টি অস্ত্র লুট করে। ব্যাংকের ম্যানেজার নেজাম উদ্দিন ভল্টের চাবি না দেওয়ায় তাকেও অপহরণ করে নিয়ে যায়। এর পরের দিন তারা থানচিতে আরও দুটি ব্যাংকে হামলা চালিয়েছে। ব্যাংক দুটি থেকে ভল্টের চাবি নিতে না পারলেও ব্যাংকে থাকা গ্রাহকের বেশ কিছু টাকা নিয়ে যায়।

শান্তির কমিটি সংলাপ বন্ধের ঘোষণা : বৃহস্পতিবার সকালে জেলা পরিষদের হলরুমে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি আহ্বায়ক ও জেলা পরিষদে চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা। তিনি বলেন, পার্বত্য জেলা বান্দরবানে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের কিছু বিপথগামী সদস্যকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে এবং পাহাড়ে চলমান সংঘাত বন্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কেএনএফের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির ভার্চুয়াল ও সরাসরি বৈঠক চলে আসছিল। এর মধ্যেই গত ২ এপ্রিল রুমা উপজেলায় সশস্ত্র সন্ত্রাসী কেএনএফ পবিত্র রমজান মাসে তারাবির নামাজিদের ওপর বর্বরোচিত হামলা, সরকারি কর্মকর্তা ও পথচারীদের জিম্মি করে হামলা, অর্থ লুটের উদ্দেশে সোনালী ব্যাংকে হামলা, ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণ, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর ১৪টি অস্ত্র লুট করে নেওয়া এবং বুধবার থানচি উপজেলায় ৪০ জনকে জিম্মি করে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ ও দুটি ব্যাংক লুট করার মতো হীন কর্মকাণ্ড ঘটায়। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে কেএনএফ শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সঙ্গে সংলাপ করার সব ধরনের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। আগামীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির পক্ষে সংলাপ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির পক্ষ থেকে এ কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে।

শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির আহ্বায়ক আরও বলেন, সাম্প্রতিক ঘটনায় আমরা শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি তীব্রভাবে মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ। এ ঘটনায় শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির চলমান সব ধরনের প্রচেষ্টা পদানত ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তিনি বলেন, এমন ঘটনা তৈরি হবে আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল। দুই পক্ষ সমঝোতা স্বাক্ষর মধ্য দিয়ে খুব সুন্দরভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ এমন কার্যকলাপ তাদের (কেএনএফ) পেছনে কোনো সংগঠন বা অন্য দেশের ইন্ধনদাতা আছে কি না তা খতিয়ে দেখা হবে।

থানচি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ মামুন জানান, থানচি উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও থানচি বাজারে প্রচণ্ড গোলাগুলি হচ্ছে। সশস্ত্র সংগঠনের সঙ্গে পুলিশ ও বিজিবির প্রচণ্ড গোলাগুলি চলছে। 
রতন নামে থানচি বাজারের এক ব্যবসায়ী জানান, রাত সাড়ে ৮টা থেকে গোলাগুলি হচ্ছে। বাজার এলাকার লোকজন চরম নিরাপত্তাহীনতায় আছে।

থানচি বাজার কমিটির সভাপতি ও থানচি উপজেলার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান খামলাই ম্রো জানান, থানচি এলাকায় এখন বিদ্যুৎ নেই। ঘোর অন্ধকারের মধ্যে বাজার এলাকায় প্রচণ্ড গোলাগুলি হচ্ছে। সন্ত্রাসীরা গুলি করতে করতে থানচি থানার দিকে অগ্রসর হচ্ছে বলে জানান তিনি।

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close