ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

আইন না মেনে কৃষিজমিতে স্বাস্থ্যের হাসপাতাল
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২ এপ্রিল, ২০২৪, ৫:০৪ এএম আপডেট: ০২.০৪.২০২৪ ২:১৩ পিএম  (ভিজিট : ৬০৫)
কৃষিজমি সুরক্ষা আইনে সুস্পষ্ট বলা আছে, ‘দুই বা তিন ফসলি জমি সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য কোনো অবস্থাতেই অধিগ্রহণ করা যাবে না।’ এ আইন অমান্য করে ফসলি জমিতে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ।

পরিকল্পনা কমিশন ও জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, হবিগঞ্জ ও মাগুরায় পৃথক দুটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণের জন্য ৫৫ একর কৃষিজমি অধিগ্রহণ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে হবিগঞ্জে ৩০ একর জমিতে বছরে ১ হাজার ৩৫০ মণ বোরো ধান উৎপাদন হয় আর মাগুরায় ২৫ একর জমিতে ধান উৎপাদন হয় ১ হাজার ৬৪৫ মণ।

‘লাল’ তালিকাভুক্ত হলেও পরিবেশ অধিদফতর থেকে নেওয়া হয়নি কোনো ধরনের ছাড়পত্র। বিষয়টিতে আপত্তি জানিয়ে অন্য কোনো স্থানে মেডিকেল কলেজ স্থাপনের পরামর্শ দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। আর এমন সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী বলে মন্তব্য করেছেন পরিবেশবিদরা। তারা বলছেন, প্রতিটি দেশের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা গুরুত্বপূর্ণ। এটি নিশ্চিতে উৎপাদন ঠিক রাখতে হয়। গত এক যুগে বাংলাদেশে ১৭ লাখ ৫৪ হাজার ২৯৪ একর কৃষিজমি কমেছে। এভাবে কৃষিজমি কমতে থাকলে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হবে।

হবিগঞ্জ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং নার্সিং কলেজ : হবিগঞ্জের সদর উপজেলায় ৩০ একর ভূমি অধিগ্রহণ করে করা হচ্ছে মেডিকেল, নার্সিং কলেজ এবং হাসপাতাল। এর মধ্যে প্রায় ৫ একর জমি খাল ও বিল। বাকি ২৫ একর দুই ফসলি জমি। এগুলো রাস্তা থেকে ১৫ ফুট পর্যন্ত গভীর। জমি অধিগ্রহণে ব্যয় হবে প্রায় ৯১ কোটি টাকা। উন্নয়নে ব্যয় হবে প্রায় ৪২ কোটি টাকা। অর্থাৎ ভূমি অধিগ্রহণের প্রায় অর্ধেক অর্থ ভূমি উন্নয়নে যাবে। এভাবে কৃষিজমি ও খাল-বিল ভরাট করে হাসপাতাল নির্মাণে আপত্তি জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। সেই সঙ্গে কমিশনের পক্ষ থেকে ওই স্থানের পরিবর্তে বিকল্প কোনো স্থানে হাসপাতাল নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে।

ওই জমিতে কি পরিমাণ ফসল উৎপাদন হয় জানতে চাইলে জেলা কৃষি কর্মকর্তা নুরে আলম সিদ্দিকী সময়ের আলোকে বলেন, ‘দুর্লভপুর গ্রামের পাশের যে ৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, ওই জমিতে প্রতি বছর বোরো ধান চাষ করা হয়। প্রতি একর জমিতে গড়ে ৪৫ মণ ধান উৎপাদন হয়। সে হিসেবে ৩০ একর জমিতে বছরে ১ হাজার ৩৫০ মণ বোরো ধান উৎপাদন হয়।’

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্প বাস্তবায়ন সময় ধরা হয়েছে ১ জুলাই ২০২৩ থেকে ৩০ জুন ২০২৬। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬০১ কোটি ২৪ লাখ টাকা। যার পুরোটাই সরকার বহন করবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে। তবে সদস্যদের স্বাক্ষর পাওয়া যায়নি বলে পরিকল্পনা কমিশন জানিয়েছে।

প্রকল্পটি যে এলাকায় করা হচ্ছে সেটি ‘লাল শ্রেণিভুক্ত’। এ শ্রেণির প্রকল্পের ক্ষেত্রে আবশ্যিকভাবে আইইই (ইনিশিয়াল এনভায়রনমেন্টাল এক্সামিনিশন), ইআইএ (এনভায়রনমেন্টাল ইমপেক্ট অ্যাসেসমেন্ট) ও ইএমপি (এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট প্লান) করতে হবে। কিন্তু পরিবেশ অধিদফতর থেকে ছাড়পত্র নেওয়া হয়নি।

মাগুরা মেডিকেল কলেজ : মাগুরা-নড়াইল হাইওয়ের পাশে দুই ফসলি ও নিচু জমিতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ ‘মাগুরা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং নাসিং কলেজ স্থাপন’ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৪৭০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা।

পরিকল্পনা কমিশন বলছে, প্রকল্পটি লাল শ্রেণিভুক্ত হওয়ায় আইইই, ইআইএ ও ইএমপি করতে হবে। কিন্তু পরিবেশ অধিদফতর থেকে ছাড়পত্র নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া এক্সিট প্ল্যানও যথাযথ হয়নি। সম্ভাব্য সমীক্ষা প্রতিবেদন বিষয়ে উদ্যোগী বিভাগের কোনো পত্র নেই এবং প্রণয়নকারীদেরও স্বাক্ষর নেই। আর্থিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ যথাযথ হয়নি। পরিকল্পনা বিভাগ থেকে জারি করা পরিপত্রের আলোকে ফিজিক্যাল কন্টিজেন্সি ও প্রাইস কন্টিজেন্সি যথাযথভাবে হয়নি যা সংশোধন করা প্রয়োজন।

মাগুরা জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্প এলাকার প্রতি একর জমিতে ধান উৎপাদন হয় ৬৫ মণ। সে হিসেবে ২৫ একর জমিতে ধান উৎপাদন হয় ১ হাজার ৬৪৫ মণ।

আইনে যা বলা আছে : কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইনের (খসড়া) ৪ এর ১ এর ‘ক’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কৃষিজমি এক ফসলি বা একাধিক ফসলি যাই হোক, তা কৃষিজমি হিসেবেই ব্যবহার করতে হইবে। ‘খ’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো কৃষিজমি নষ্ট করে আবাসন বাড়িঘর, শিল্প-কারখানা, ইটের ভাটা বা অন্য কোনো অকৃষি স্থাপনা কোনোভাবেই নির্মাণ করা যাবে না। অনূর্বর, অকৃষি জমিতে আবাসন, বাড়িঘর, শিল্প-কারখানা প্রভৃতি স্থাপন করা যাবে। ‘ছ’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, দুই বা তিন ফসলি জমি সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য কোনো অবস্থাতেই অধিগ্রহণ করা যাবে না।

কি বলছে মন্ত্রণালয় ও বিশেষজ্ঞরা : পরিবেশবিদ ও বিশিষ্ট নদী বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত সময়ের আলোকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বারবার বলে আসছেন ফসলি জমিতে স্থাপনা করা যাবে না। সেখানে সরকারি কর্মকর্তারা বারবার একই কাজ করছে। যেখানে একজন রাষ্ট্রপ্রধানের নির্দেশনা মানা হয় না, সেখানে দুঃখিত হওয়া ছাড়া কিছু বলার নেই। প্রধানমন্ত্রী আইনের ভিত্তিতে কথা বলেছেন, তারা এটিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে।’

জল ও ফসলি জমির ক্ষতি করে কোনো প্রকল্প গ্রহণ না করতে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বছর ডিসেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘উন্নয়ন প্রকল্প করেন; কিন্তু প্রকৃতি ও পরিবেশের কোনো প্রকার ক্ষতি করে উন্নয়ন কাজ নয়। কোনোমতেই পরিবেশকে ডিস্টার্ব করা যাবে না।’

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন সময়ের আলোকে বলেন, ‘আমার কাছে এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের কোনো আপত্তি আসেনি। যখন আসবে তখন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

এক যুগে কৃষিজমি কমেছে ১৭ লাখ ৫৪ হাজার ২৯৪ একর : কৃষি শুমারি-২০২০ প্রকাশিত হয়েছিল ২০২২ সালে। তাতে বলা হয়, ২০০৮ সালে দেশে কৃষিজমি ছিল ২ কোটি ২ লাখ ৩৫ হাজার ৩৬৫ একর। কিন্তু ২০২০ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৮৪ লাখ ৮১ হাজার ৭১ একর। অর্থাৎ ১২ বছরে দেশে কৃষিজমি কমেছে ১৭ লাখ ৫৪ হাজার ২৯৪ একর।

সময়ের আলো/আরএস/ 





https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close