ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে যাচ্ছে নওগাঁর ‘প্যারা সন্দেশ’
প্রকাশ: শনিবার, ৩০ মার্চ, ২০২৪, ৫:০৫ এএম  (ভিজিট : ৬৭৮)
ধান ও আমের উদ্বৃত্ত জেলা নওগাঁ। তবে এ জেলায় শুধু ধান ও আম চাষ হয়, এমনটি নয়। প্রচুর শাকসবজিরও চাষ হয়ে থাকে। মিষ্টির জন্যও খ্যাতি আছে এ জেলার। অতিথি আপ্যায়নে মিষ্টান্ন উল্লেখযোগ্য পদ হিসেবেই বিবেচনায় রাখে বাঙালি। পাতের শেষ খাবার হিসেবে থাকে বিভিন্ন স্বাদের মিষ্টি। এর মধ্যে অন্যতম একটি মিষ্টি নওগাঁর ‘প্যারা সন্দেশ’। শত বছরের সুখ্যাতি আছে ঐতিহ্যবাহী এ সন্দেশের। উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা নওগাঁর এ মিষ্টির সুনাম এখন দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও। 

প্যারা সন্দেশ যারা তৈরি করেন তারা সুস্পষ্টভাবে বলতে পারেননি ঠিক কখন নওগাঁর ‘প্যারা’ সন্দেশের প্রচলন শুরু। তবে ধারণা করা হয়, প্রায় শত বছর আগে নওগাঁয় প্যারা সন্দেশ তৈরি শুরু। নওগাঁ শহরের কালীতলা এলাকার শ্রীশ্রী বুড়াকালী মাতা মন্দিরের পাশে ভোগের প্রয়োজনে শত বছর আগে দোকানে এ সন্দেশ তৈরি হতো। এ দোকানগুলোকে বলে ভোগের দোকান। এ সন্দেশ পূজারিরা বিভিন্ন পূজামণ্ডপের দেবদেবীর উপাসনার জন্য মন্দিরে ভোগ দিতেন। বর্তমানেও এ ভোগের প্রচলন আছে।

শ্রীশ্রী বুড়াকালী মাতা মন্দিরের প্রধান গেটসংলগ্ন ‘মা নওগাঁ প্যারা সন্দেশ’-এর দোকান। ওই দোকান থেকে প্রতিদিন সকালে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সর্বনিম্ন ৩০-৫০ টাকায় প্যারা সন্দেশ কিনে মন্দিরে ভোগ দেন। এ দোকানে ৩৯০ টাকা এবং শহরের মিষ্টিপট্টিসহ অন্যান্য দোকানে ৪০০ টাকা কেজি দরে এ সন্দেশ বিক্রি হয়।

প্যারা সন্দেশ এখন বাড়িতে অতিথি আপ্যায়ন, আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া মর্যাদার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সন্দেশ মিষ্টির জগতে অনেক বড় একটি জায়গা দখল করে নিয়েছে। এর স্বাদ আর পুষ্টিগুণ এখন মানুষের মুখে মুখে।

কালীতলা মহল্লার বাসিন্দা গৌতুম কুমার বলেন, নওগাঁয় বর্তমানে বেশ কয়েকজন প্যারা সন্দেশ তৈরি করেন। তবে সৈকত দাসের দোকানের প্যারা সন্দেশের খ্যাতি শুধু জেলায় নয়, দেশ ও দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। প্রায় শত বছর ধরে এ প্যারা সন্দেশের কদর চলে আসছে। এখন ভারত, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, আমেরিকাসহ বেশ কয়েকটি দেশের ক্রেতারা প্যারা সন্দেশ নিয়ে যাচ্ছেন।

শহরের ঘোষপাড়া মহল্লার বাসিন্দা মিতালী রায় বলেন, প্রতিদিন সকালে দেবীর আরাধনায় মিষ্টির প্রয়োজন হয়। মিষ্টি হিসেবে মন্দিরে ভোগ দেওয়ার জন্য সৈকতদের দোকানের প্যারা সন্দেশ নিয়ে থাকি। দোকানের মালিকানা বিভিন্ন সময় পরিবর্তন হলেও তাদের দোকানের প্যারা সন্দেশের স্বাদ ও মান সেই আগের মতোই আছে। 

জনশ্রুতি আছে, ভারতের বিহারের কোনো এক নবাবের মিষ্টি তৈরির কারিগর ছিলেন মহেন্দ্রী দাস। নবাব এক যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হওয়ার পর ওই ব্যক্তি নওগাঁয় এসে শহরের কালীতলায় বসবাস শুরু করেন। জীবিকার তাগিদে তিনি ‘প্যারা’ সন্দেশ তৈরি করে বিভিন্ন মন্দিরে বিক্রি করতেন। পরে সেখানেই ছোট্ট একটা মিষ্টির দোকান খুলে বসেন।

তখন কালীতলা এলাকায় জনবসতি ছিল না বললেই চলে। মহেন্দ্রীর পর তার ছেলে ধীরেন্দ্রনাথ দাস দোকানের দায়িত্ব পান। তখন বিমল মোহন্ত নামে মিষ্টি তৈরির এক কারিগরের হাতের স্পর্শে ‘প্যারা’ সন্দেশের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।

ধীরেন্দ্রনাথ দাস প্রায় ৩০ বছর ব্যবসার পর দোকানটি সুরেশ চন্দ্র মোহন্তের কাছে বিক্রি করে অন্যত্র চলে যান। এরপর সুরেশ চন্দ্র মোহন্ত দোকানে নতুন মিষ্টির কারিগর নারায়ণ চন্দ্রকে আনেন। কারিগর নারায়ণ চন্দ্র প্যারা সন্দেশ তৈরি শুরু করেন। আবারও ওই দোকানের মালিকানা পরিবর্তন হয়। বর্তমানে দোকানের মালিক সৈকত দাস। তিনিই এখন প্যারা সন্দেশ তৈরি করছেন। বর্তমানে নওগাঁ শহরে বেশ কয়েকটি দোকানে অন্যান্য মিষ্টির পাশাপাশি প্যারা সন্দেশ তৈরি করছে। এর মধ্যে ‘প্যারা’ সন্দেশের সুনাম চারদিক ছড়িয়ে পড়েছে।

শ্রীশ্রী বুড়াকালী মাতা মন্দিরের সেবায়ী মহাদেব মজুমদার বলেন, আমরা যতটুকু জানি মন্দির সৃষ্টির পর প্যারা সন্দেশের আগমন হয়। দেবীর আরাধনায় ভোগের জন্য মিষ্টান্নের প্রয়োজন হয়। মন্দিরের পাশে দোকান হওয়ায় সহজেই পূজারিরা সেখান থেকে ভোগ কিনে থাকেন।

কালীতলা মহল্লার বাসিন্দা সাগর কুমার বলেন, নওগাঁয় বেশ কয়েকটি প্যারা সন্দেশের দোকান হয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে তার মধ্যে মন্দিরের পাশের দোকান ‘মা প্যারা সন্দেশ’টি বেস্ট। ভোগের পাশাপাশি বাড়িতে খাবারের জন্য প্যারা সন্দেশ এখান থেকে কেনা হয়। 

কথা হয় শহরের কালীতলার বিখ্যাত মা প্যারা সন্দেশের স্বত্বাধিকারী সৈকত দাসের সঙ্গে। তিনি সময়ের আলোকে বলেন, বিভিন্ন জনের হাতবদল হয়ে প্রায় ৩৫ বছর ধরে প্যারা সন্দেশের ব্যবসা করেন আমার বাবা বৈদ্য রতন দাস। বর্তমানে দোকানটি আমি পরিচালনা করছি। 

এই মিষ্টি ব্যবাসয়ী আরও বলেন, ‘প্যারা’ সন্দেশ তৈরির প্রথম ধাপে তরল দুধের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে জ্বাল করে তৈরি করা হয় ক্ষীর। ক্ষীর যখন হাতায় জড়িয়ে আসে তখন উষ্ণ ক্ষীর দুহাতের তালু দিয়ে রোল করে সামান্য চাপ দিলেই তৈরি হয়ে যায় হালকা খয়েরি রঙের প্যারা সন্দেশ। তৈরি পদ্ধতি খুব সহজ। প্রতিটি প্যারা সন্দেশ প্রায় আধা ইঞ্চি চওড়া ও দুই ইঞ্চি লম্বা করা হয়। প্রতি কেজিতে ৬০ থেকে ৬৫টি প্যারা সন্দেশ পাওয়া যায়। এক কেজি প্যারা সন্দেশ তৈরি করতে দরকার হয় প্রায় ৪ লিটার তরল দুধ। দুধ আর চিনি ছাড়া অন্য কোনো উপকরণ না থাকায় এ সন্দেশ স্বাভাবিকভাবে রাখা যায় ১০ থেকে ১৫ দিন। আর কৃত্রিম উপায়ে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে এ সন্দেশ ভালো রাখা যায়। প্রতি কেজিতে দুধ, চিনি, মসলাসহ সব মিলে খরচ পড়ে ৩৫০-৩৬০ টাকার মতো। আর বিক্রি করা হয় ৪০০ টাকা কেজিতে। 

বগুড়া থেকে প্যারা সন্দেশ কিনতে আসা কবির হোসেন বলেন, শহরের কালীতলা মহল্লার সৈকতের প্যারা সন্দেশের খ্যাতির কথা অনেক শুনেছি। কয়েক বার এখন থেকে প্যারা সন্দেশ কিনে বগুড়াতে নিয়ে গেছি। মালিকানা পরিবর্তন হলেও স্বাদ ও মান ঠিক আগের মতোই আছে।

শহরের হক মিষ্টান্ন ভান্ডারের ম্যানেজার নূর ইসলাম বলেন, শুধু পূজা, ঈদই নয়, অন্যান্য সময়ও আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় প্যারা সন্দেশ। এ ছাড়া ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশে আত্মীয়-স্বজন এখানকার ‘প্যারা’ সন্দেশ নিয়ে যান।

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close