ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

ঈদের আনন্দ চিরকালের
প্রকাশ: শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ২:২১ এএম আপডেট: ২৯.০৩.২০২৪ ৮:২৩ এএম  (ভিজিট : ৫৮৯)
আজকাল রাজধানী ঢাকা ছেড়ে বাইরের কোনো শহরে ঈদ উদযাপন করা কঠিন হয়ে গেছে। জীবনযাপনের গতি-

প্রকৃতি আগের মতো নেই। প্রতি বছর ঈদ, পূজা-পার্বণের ছুটিতে ঢাকা ছেড়ে মানুষের দূর-দূরান্তে গমনাগমনের কারণে রাস্তায় যানবাহনের প্রচণ্ড চাপ বেড়ে যায়। ফলে বাড়ে সড়ক দুর্ঘটনা। সড়কে যাত্রীর ভিড় সামলাতে ও কিছু বাড়তি রোজগারের আশায় নামানো হয় বিস্তর বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন। সেসব যানবাহনের অনেকটারই মহাসড়কে চলাচলের অনুমতি থাকে না। অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে সড়কে দেখা যায় নানা রকম অনিয়ম, অব্যবস্থা। যাত্রীর অনুপাতে যানবাহনের সংখ্যা অপ্রতুল হওয়ায় গতিসীমার বাইরে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে বেশি ট্রিপ দেওয়ার অশুভ প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে চালক। ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল শুরু করে, রাস্তায় নামানো হয় লক্কড়ঝক্কড় মার্কা গাড়িতে রং মাখিয়ে। অদক্ষ চালক হাতে তুলে নেয় গাড়ির স্টিয়ারিং।

ঈদের আগে সড়ক সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও কর্মকর্তাদের মধ্যে সড়ক ব্যবস্থাপনায় যতটুকু নজরদারি থাকে ফিরতি যাত্রার সময় তা দেখা যায় না। আগে যেমন লঞ্চে চলে আরামে ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলের যেকোনো স্থানে যাওয়া যেত, সেই নৌযাত্রায় এখন অনেক ভিড়। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সড়কপথে যানবাহনের চাপ অনেক বেড়ে গেছে। দেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী নৌপথ পরিহার করে সড়কপথে তাদের গন্তব্যে যাত্রা করে। তবে তাতেও মেলেনি সড়ক দুর্ঘটনা থেকে মুক্তি।

ঈদের প্রসঙ্গ উঠতেই চলে আসে পুরো এক মাস সিয়াম সাধনা রমজানের কথা। রমজানের শুরুতেই এক মাসের জন্য ইফতারি, সেহরির খাবার-দাবারের সব বাজার সদাই অগ্রিম করে রাখার ব্যস্ততা বাড়তে থাকে। রমজানে অসাধু ব্যবসায়ীদের মূল্য বৃদ্ধির কারসাজির দিকে। প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে হবে তা যে দামেই হোক। ঘরে ঘরে ইফতারির বিপুল আয়োজন দেখে মনে হয় মানুষ বড় সুখে আছে। খেজুর, পিয়াজু, চপ, বেগুনি, ছোলা, রোস্টেড মোরগ, চিংড়ি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের ফলের প্লেটভর্তি বাহারি এতসব খাবার শেষে নুডুলস, হালিমজাতীয় ভারী খাবার শেষে মিষ্টান্ন, দই একবারে খেতে পারে! অথচ আমাদের ছেলেবেলায় ইফতারির আয়োজনে থাকত তোকমা কিংবা ইসবগুলের ভুসির শরবত। সঙ্গে কিছু শসা বা পেয়ারার মতো মৌসুমি ফল। চিড়া ভিজিয়ে মায়েরা সযত্নে তাতে নারকেল ও আখের গুড় মিশিয়ে রাখতেন ইফতারি শুরুর বেশ আগে। সঙ্গে থাকত ছোলা ও মুড়ি বড়জোর দুয়েকটা পিয়াজু। দেশের বাইরে অনেক জায়গায় চাকরি করার সুযোগ হয়েছে।

কোথাও ঈদে তেমন সাজসাজ রব দেখা যায়নি। শুধু ঈদের একটি দিন ছুটি ছাড়া সারা রমজান চলে গেছে বছরের অন্যসব মাসের মতো। ঈদের পরদিন থেকেই পুরো অফিস, সব স্বাভাবিক কাজকর্ম। রমজানের ইফতারি বা ঈদ উৎসব আয়োজনে কেনাকাটার বাহুল্য দেখিনি কোথাও। রমজান, ঈদ আসে, চলে যায় আর পাঁচটা স্বাভাবিক মাসের মতো। দাম বাড়ে না কোনো পণ্যের। সাদামাটা ঈদ উৎসব পালনেই যেন তাদের আনন্দ। শুধু আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করা কিংবা শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে পুরো ঈদ উৎসবের আয়োজন।

এ রকমই সাদামাটা ঈদ ছিল আমাদের ছেলেবেলায়। যখন খুব ছোট ছিলাম, মা-বাবার সঙ্গে ঈদ করতে যেতে হতো গ্রামের বাড়িতে। গ্রামের বাড়ি বলতে তখনকার জেলা শহরের জন্মভিটায়। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা দুটোই উদযাপিত হতো আনন্দমুখর পরিবেশে। ঈদের বেশ আগেই বাবা বাজার থেকে মোরগ, সেমাইসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে আনতেন। ছোট ভাইবোনদের জন্য সাদামাটা জামাকাপড়। শেষ রমজানে ঈদের চাঁদ দেখার জন্য শহরময় ধুম পড়ে যেত। সূর্য পশ্চিম গগনে এলিয়ে পড়তেই পাড়ার ছেলেরা বেরিয়ে পড়ত রাস্তায়। গাছের আড়াল থেকে উঁকি মেরে কে আগে চাঁদ দেখতে পায় এমন প্রতিযোগিতায় মেতে উঠত। চাঁদ দেখতে পেলে মায়েরা সবাইকে চিনি গুলে সরবত বানিয়ে খাওয়াতেন। চাঁদ দেখা গেলে মসজিদে আজান হতো। সকালে গোসল করে মা-বাবাকে সালাম করে ঈদের জামাতে নামাজ পড়ার একটা অদ্ভুত শিহরণ ছিল। নামাজ শেষে ফিরে এসে সবাই মা-বাবাসহ বড়দের পা ছুঁয়ে সালাম করার রেওয়াজ ছিল। মা-বাবারা মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করতেন, সন্তান যেন বড় হয়ে মানুষ হতে পারে। দুটো ঈদে মায়েরা যত্নের সঙ্গে সেমাই রান্না করতেন। গরুর খাঁটি দুধ দিয়ে সেমাই অথবা সরু চালের পায়েসের আলাদা স্বাদ ছিল। ঈদের নামাজ শেষে নতুন জামা পরে ছোটরা সেমাই খেয়ে পাড়াময় ঘুরে বেড়াত। দুপুর গড়াতেই মায়ের রান্না শেষ হয়ে যেত। এত ঝটপট রান্নায় তখনকার মায়েদের সঙ্গে অন্য কেউ কুলিয়ে উঠতে পারত না। দুপুরে মুরগির মাংস সঙ্গে খাঁটি ঘি দিয়ে রান্না করা পোলাও খেয়ে দিনের খাবার শেষ করা হতো। ছোট-বড় সবাই মিলে তখনকার দিনে আত্মীয়-স্বজনের বাসায় বেড়াতে যাওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। বাসার কাজের লোকরাও ঘরের ঈদ উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে যেত। মায়েরা সবাইকে এ দিনে অন্যসব মেহমানের মতো নিজ হাতে পরিবেশন করে খাওয়াতেন। 

পাড়া-পড়শীরাও বাসায় এসে ধুমধাম করে খাওয়ায় শামিল হতেন। ফকির, মিসকিনদের পেটভরে খাওয়ানো হতো ভালো ভালো খাবার। একটু বড় হলে বাবার অনুমতি নিয়ে বন্ধুদের বাসায় বেড়াতে যাওয়ার অনুমতি মিলত। সারা দিন কেটে যেত হৈ-হুল্লোড়ে। কে কতজনের বাসায় খেতে পেরেছে তা নিয়ে একটা প্রতিযোগিতা লেগে যেত। বন্ধু-বান্ধবের বাসায় নিজের বাসার মতোই পেট পুরে খেতে কোনো বাধা ছিল না। বন্ধু-বান্ধবের মা-বাবারাও অন্য ছেলেমেয়েদের পুত্র-কন্যাসম স্নেহ-আদরে ভরিয়ে দিতেন।

কর্মজীবনে ঈদ উপলক্ষে ঢাকা থেকে বউ-বাচ্চা নিয়ে মা-বাবার আকর্ষণে ছুটে যেতে হতো শহরের বাড়িতে। এমনকি দেশের বাইরে থেকেও ঈদের সময়টাকে বেছে নিতে হতো ছুটিতে দেশে আসার জন্য। মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন এমনকি বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ মিলত। সবার জন্য সাধ্যমতো জামাকাপড় কিনে আনা হতো। ঈদের দিনটিতে মা-বাবা তাদের সন্তানকে কাছে পেয়ে যে কী খুশি হতেন তা বলে শেষ করা যাবে না। বাসায় নানা পদের মাংস রান্না হতো। বাসায় বন্ধু-বান্ধব আসত। খেয়ে, গল্পগুজব করে চলে যেত। ছেলেমেয়েরা নিত্যনতুন সাজে সেজে ঘুরে বেড়াত ওদের বন্ধুদের ঘরে ঘরে। ফিরত অনেক রাত করে। এরপর কেটে গেছে অনেক বছর। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে, লেখাপড়া শিখেছে, ওদের সংসার ছেলেপুলে হয়েছে। মা-বাবা গত হয়েছেন অনেক আগে। এরপরেও মাঝেমধ্যে ঈদের ছুটিতে ছেলেদের নিয়ে আমার পৈতৃক ভিটায় ছুটে যেতাম। ব্যস্ত শহরের জাঁতাকলে পিষ্ট জীবনে খানিকটা সময়ের জন্য পুরোনো দিনের সব স্মৃতি ডানা মেলে দিত। ছড়ানো-ছিটানো বাংলো ধরনের বিশাল বাড়ির সামনের শ্যামল ঘাসের ওপর সবাই দিনভর ছোটাছুটি করত। পুকুরে মাছের ডুবসাঁতার দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেত।

ছেলেমেয়েরা মা-বাবার জন্য জামাকাপড় কিনে আনত। ছেলেমেয়েদের গায়ে নিত্যনতুন বাহারি সব জামা কাপড় দেখে বড্ড ভালো লাগত। দুপুরে রান্না শেষ হলে সবাই মিলেমিশে খাওয়া হতো। ছেলেরা ওদের স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সারা দিন বন্ধুদের বাসায় ঘুরে বেড়াত। বাসায় ছিল দিনভর ছেলেদের বন্ধু-বান্ধবের আসা-যাওয়া। সরগরম হয়ে উঠত সারা ঘর। ঈদ শেষে ছেলেমেয়েরা ফিরে যেত যে যার কর্মস্থলে। বুড়ো বয়সে এখন প্রায় সব ঈদই কাটে ঢাকায়। ছেলেদের হাতে একদম সময় নেই। বুড়োদের পক্ষে এখন আর একা কোনো উৎসব আয়োজন করা সম্ভব নয়। আজকাল বেশিরভাগ ঘরে ঈদের কেনাকাটা শুরু হয় রমজানের শুরু থেকে। পোশাক, জুতা, সাজগোজের জিনিসপত্রে ভরে যায় ঘর। এত জিনিসপত্র লাগে আজকালকার ছেলেমেয়েদের। গরু, খাসি আর মুরগির মাংসে দুটো ফ্রিজ ভরে রাখে ঈদের আগের থেকে। এত সব রান্না হয় ঈদের দিনে!

আজকাল মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বত্রই অর্থ উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ঈদ, পূজা-পার্বণের সময় সর্বস্তরের ব্যবসায়ীরা প্রচুর টাকার মালামাল বিক্রি করেন। অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে ওঠে। এ সময়ে রাতভর খোলা থাকে দোকানপাট। জামাকাপড়, পোশাক সামগ্রী থেকে শুরু করে তেল, মসলার বাজার চড়ে যায়। আজকাল ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। ঈদ উপলক্ষে সাধ্যমতো আর্থিক সহায়তা করে ওরা দরিদ্রদের। খাদ্যসামগ্রী অনাথ শিশুদের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে আনন্দ ভাগ করে নেয়। যারা সারা বছর খেতে পায় না তারা একদিন একটু ভালো কিছু খেয়ে তৃপ্ত হয় তাও মন্দ কি। মানুষ তার সম্পদের খানিকটা অসহায়দের মাঝে বিলিয়ে দেবে, রমজান এমন শিক্ষাই তো দেয়। তাতে দেশে সম্পদের সুষম বণ্টনের পরিধি বিস্তৃত হবে। অসম অর্থনীতির গ্রাস থেকে বেরিয়ে আনবে সমাজ। 

রমজান ও ঈদকে ঘিরে বর্তমানে বিত্তশীলদের এক মাসে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় তা বছরের বাকি ১১ মাসের খরচের প্রায় কাছাকাছি বলে মন্তব্য করেন অনেকে। রমজানে বা ঈদ আয়োজনের বাড়তি খরচ থেকে কিছু অর্থ বাঁচিয়ে তা গরিব-দুঃখী, নিরন্ন মানুষকে দুবেলা দুমুঠো খাবারের সংস্থান করে কিংবা অসুস্থ কাউকে চিকিৎসাসেবায় ব্যয়ের মাধ্যমে রমজানের সিয়াম সাধনার উদ্দেশ্য সফল হতে পারে। ঈদের একটি দিন আনন্দের হলেও রমজানের পুরো মাসটি তো সিয়াম সাধনার । কিন্তু এই সংযমের মাসে এবং ঈদের একটিমাত্র দিনের আনন্দ আয়োজনকে কেন্দ্র করে যে সাজসাজ রব, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাবার-দাবারের যে বাহুল্য সেখানে সংযমের স্থান কোথায়! তারপরও ঈদের আনন্দ চিরকালের।


অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close