ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

জনবল ও যন্ত্রপাতি সংকটে ধুঁকছে হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
প্রকাশ: শনিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৪, ৭:০২ এএম  (ভিজিট : ২৭৪)
চিকিৎসক ও নার্সের চরম সংকট। যে সংখ্যক চিকিৎসক থাকার কথা বর্তমানে তার পাঁচ ভাগের এক ভাগও নেই হাসপাতালটিতে। আর নার্স রয়েছেন সাত ভাগের এক ভাগ। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে রোগীদের রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনো সুযোগ নেই হাসপাতালটিতে। যে দুয়েকটি যন্ত্রপাতি রয়েছে সেগুলোও মান্ধাতা আমলের। এ পরিস্থিতিতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সেবা কার্যক্রম। প্রতিদিনই উপচেপড়া রোগীর চাপে হিমশিম খেতে হচ্ছে দায়িত্বরত স্বল্পসংখ্যক চিকিৎসক-নার্সকে। ফলে ব্যাহত হচ্ছে দ্বীপবাসীর চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম। এ সুযোগ নিচ্ছে বেসরকারি হাসাপাতল-ক্লিনিক ও দালালরা।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বর্তমানে একজন শিশু বিশেষজ্ঞ ছাড়া কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। বিধি মোতাবেক ৩১ চিকিৎসকের স্থলে ইউএইচওসহ মাত্র ১১ জন থাকলেও ৬ জনই প্রশিক্ষণে ও ছুটি নিয়ে হাতিয়ার বাইরে থাকায় বর্তমানে উপস্থিত মাত্র ৫ জন। 

অন্যদিকে ৪১ জন নার্সের স্থলে ২৮ জনের পদই শূন্য রয়েছে। কাগজে-কলমে ১৩ জন দেখালেও উপস্থিত রয়েছেন মাত্র ৬ জন। হাতিয়া ৫০ শয্যা হাসপাতালে প্রতিদিনই প্রায় শতাধিক রোগীকে সেবা দিতে মাত্র ৬ জন নার্সকে। ২৪ ঘণ্টা পালাক্রমে সেবা দিতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠছেন তারা। এ ছাড়া কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছেন না রোগীরা। ফলে সেবাপ্রার্থী মানুষের মাঝে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। 

একইভাবে ওয়ার্ডবয়, আয়া ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীর পদ খালি না থাকলেও তাদের অনেকে প্রেষণে হাতিয়ার বাইরে কাজ করছেন। ফলে হাসপাতালে সবসময় নোংরা পরিবেশ থাকে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ঘাটতি নিয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে সেবাপ্রার্থীদের। যদিও ওই কর্মচারীরা বেতন-ভাতা উত্তোলন করেন হাতিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে।

সাড়ে ৭ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত দ্বীপ উপজেলার একমাত্র চিকিৎসাকেন্দ্র এ হাসপাতাল। ১৯৯৮ সাল থেকে হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও কোনো ভবন না থাকায় শয্যাসংখ্যা একই রয়েছে। কেবল ৫০ জন রোগীর জন্য খাবার ও ওষুধপত্র সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে। অথচ এ হাসপাতালে প্রতিদিন রোগী ভর্তি থাকে শতাধিক। অনেক সময় রোগীদের করিডরে, চলাচলের পথে, ডাস্টবিন-সংলগ্ন খোলা জায়গায় অবস্থান নিয়ে চিকিৎসা নিতে দেখা যায়। দূরদূরান্তের সেবাপ্রত্যাশীরা যানবাহন ভাড়া দিয়ে কষ্ট করে এসেও কাক্সিক্ষত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

হাসপাতালটিতে রোগ নির্ণয় ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য যেসব যন্ত্রপাতি রয়েছে সেগুলোর দুয়েকটি ছাড়া সবগুলোই মান্ধাতা আমলের এনালগ সিস্টেমের। ডিজিটাল যুগে এসব যন্ত্রপাতি দিয়েই কোনো রকমে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ চালাতে হয় হাসপাতালটিতে। এসব যন্ত্রপাতি দিয়ে এখন অনেক পরীক্ষার ফলই সঠিকভাবে পাওয়া সম্ভব হয় না। দীর্ঘ ২০ বছর ধরেই বিকল অবস্থায় পড়ে আছে এক্স-রে মেশিনটি। কাজ করছে না আলট্রাসনোগ্রাম মেশিনটিও। এসব যন্ত্র বিকল থাকায় রোগীরা হাসপাতাল থেকে ভালো মানের চিকিৎসা নিতে পারছেন না। ফলে দিন দিন বাড়ছে রোগীদের ভোগান্তি। 

শুধু তাই নয়, দায়িত্বরত কয়েকজন সাব-এসিস্ট্যান্ট কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারের রয়েছে প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ল্যাবের ব্যবসা। তারা বেশির ভাগ রোগীকে দায়িত্বরত অবস্থায় তাদের সেসব প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ল্যাবে যেতে উৎসাহী করেন। এ ছাড়া রয়েছে দালালদের উপদ্রব। তারা অপকৌশলে রোগীদের প্রাইভেট মেডিকেল এবং ডায়াগনস্টিক ল্যাবে নিতে বাধ্য করে। এমনকি রোগীদের হাসপাতালে ভর্তিসহ চিকিৎসায়ও বিভিন্ন প্রতারণার আশ্রয় নেয়। অতিরিক্ত ফি দেওয়ার পাশাপাশি গ্রাম-গঞ্জ থেকে আসা অনেকে রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে অর্থকড়ি হাতিয়ে নেয়। এতে প্রতিনিয়তই প্রতারণার শিকার হচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। 

গত ৫ মার্চ সকালে উপজেলা হাসপাতালটিতে গিয়ে দেখা যায়, নারী, শিশু, বয়স্ক প্রচুর রোগীর চাপ। কয়েকটি বেডে দুজন করে রোগী বসে আছে। অনেকে আবার নিঝুমদ্বীপের মতো প্রত্যন্ত এলাকা থেকে এসে শয্যা না পেয়ে বিপর্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে। এক মাকে তার দেড় বছরের বাচ্চাকে নিয়ে মেঝেতে বিছানা পেতে সেবা নিতেও দেখা যায়।

বুড়িরচর ইউনিয়নের রহমত বাজার এলাকা থেকে আসা রোগী ইরাজ উদ্দিনের বাবা বলেন, ছেলেকে নিয়ে গত পরশু হাসপাতালে এলে ডাক্তার এক্সরেসহ কিছু পরীক্ষা করতে বলেন। রিপোর্টে নিউমোনিয়া শনাক্ত হলে ভর্তির করাতে বলেন। কিন্তু ভর্তি করাতে গিয়ে দেখা যায় ছিট খালি নেই। বিকল্প একটা সিটে রোগীকে নিয়ে ঘণ্টাখানেক বসে থাকার পরও কোনো নার্স আসেননি। এরও অনেকক্ষণ পর নার্স এসে ক্যানোলা করে ইনজেকশন পুশ করেন। কিন্তু বাথরুমের নোংরা পরিবেশ, দুর্গন্ধে দুদিনে আমার স্ত্রী নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। 

দায়িত্বরত নার্স ইনচার্জ মোহছেনা আক্তার তামান্না বলেন, দুয়েকদিন পরপরই রোগীর চাপ অনেক বেড়ে যায়। অনেক দিন থেকে আমাদের শয্যাসংখ্যার তিনগুণ রোগী ভর্তি করাতে হচ্ছে। অন্যদিকে রোটেশন ডিউটিতে স্টাফ নার্স থাকে মাত্র তিনজন। অধিকসংখ্যক রোগীর একত্রে সমানভাবে সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না। সেবা দিতে বিলম্ব হলে রোগীদের বকাঝকা শুনতে হয়, দুর্ব্যবহারও করে। আমাদের কিছুই করার থাকে না। 

এ প্রসঙ্গে হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সৌমেন সাহা জানান, শয্যা ও লোকবল বৃদ্ধির বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং সিভিল সার্জনসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমি সব অনিয়মের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। সম্প্রতি সার্বিক অনিয়মতান্ত্রিক কারণগুলোর বিষয়ে বিভাগীয় পরিচালককে অবহিত করা হলে তিনি সরেজমিন পরিদর্শন করে যাওয়ার পরও কোনো সুরাহা হয়নি।

হাসপাতালের অব্যবস্থাপনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রোগীর তুলনায় যে লোকবল রয়েছে তা যথেষ্ট নয়। গড়ে এখানে ৯০ থেকে ১০০ রোগী ভর্তি থাকে। কিন্তু সামান্য লোকবল দিয়ে রোগীদের সেবা দেওয়া খুবই কষ্টকর। হাসপাতালে এক্সরে, আল্ট্রাসনোগ্রাম, ইসিজিসহ বেশ কিছু প্যাথলজি পরীক্ষা না হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, পরীক্ষার জন্য যে সরঞ্জাম রয়েছে তা এনালগ হলেও বেশরি ভাগ সচল রয়েছে। তবে হাসপাতালে দালালদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে, অসাধু চক্রের জন্য অনেক কিছু করা সম্ভব হয় না। আমি এসব বিষয়ে কিছু করতে চাইলে বিভিন্নভাবে বাধার সম্মুখীন হচ্ছি। 

জেলা সিভিল সার্জন ডা. মাসুম ইফতেখার মোবাইল ফোনে হাসপাতালের সার্বিক বিষয়ে জানান, সব বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে গর্ভবতী মায়েদের সেবার লক্ষ্যে দুজন ডাক্তার দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালের এক্সরে মেশিনের বিষয়ে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নেব। আগামী সপ্তাহ থেকে এখানে আলট্রাসনোগ্রাম চালু হবে।

চতুর্থ শ্রেণির লোকবল ডেপুটেশনে থাকার বিষয়ে তিনি জানান, হাতিয়ার কোনো লোক যদি কোথাও এভাবে থেকে থাকে তাদের নিজ কর্মস্থলে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। দালালের দৌরাত্ম্য নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে জানান, ইউএইচওকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হবে।


সময়ের আলো/আরএস/ 





https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close