পবিত্র মাহে রমজান আল্লাহর সঙ্গে বান্দার একাত্মতা ও প্রেম বিনিময়ের সর্বোত্তম সময়। পবিত্র কুরআনের শব্দ হচ্ছে ‘রামাজান’। আরবি ‘রামজুন’ শব্দ হতে রমাদান বা রমজান শব্দের উৎপত্তি। রামজুন শব্দের অর্থ জ্বালিয়ে দেওয়া বা পুড়িয়ে দেওয়া। সর্বপ্রথম যখন এ মাসের নাম রাখা হয়েছিল তখন প্রচণ্ড গরম ছিল। এ জন্য লোকেরা এর নাম রেখেছে রমজান, অর্থ ঝলসে দেওয়া। তবে গবেষক আলেমগণ বলেন, এ মাসকে রমজান এ উদ্দেশ্যে বলা হয় যে, পবিত্র রমজান মাসে আল্লাহ তায়ালা নিজ মেহেরবানিতে মুমিনদের গুনাহগুলোকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ভস্ম করে দেন। মানুষ যেন এক নবজীবন লাভ করে।
এ মাসকে সংযমের মাসও বলা হয়। সংযম অর্থ বিরত থাকা, পরিহার করা। এ মাসে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও জৈবিক চাহিদা থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি সব অশ্লীলতা পরিহার করা ফরজ। রোজাদারকে অধিক সংযমের পরিচয় দিতে হয়। এমনকি ইফতারের সময় খাবার সামনে নিয়ে বসে থাকলেও নির্ধারিত সময়ের পূর্বে রোজাদার ইফতার করতে পারে না। অথচ তাকে কেউ নিষেধ করে না, বরং সে কেবল আল্লাহর ভয়েই এমন সংযম অবলম্বন করে। আর রমজানের মূল শিক্ষাই হলো আল্লাহভীতি অর্জন করা। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘হে ইমানদারগণ, তোমাদের জন্য রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের জন্য; যাতে তোমরা আল্লাহভীতি অর্জন করতে পারো।’ (সুরা বাকারা : ১৮৩)
রোজার বিধান ফরজ হওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো মানুষকে সংযমী বানানো। খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা, কথাবার্তা, কর্মতৎপরতাসহ ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে সংযমী হওয়ার মহান বার্তা নিয়ে মুসলিম পরিবারে রমজানের আগমন ঘটে। কিন্তু এই মাস এলে প্রকৃত অর্থে কি আমরা সংযমী হতে পারি? মানুষের প্রথম জৈবিক চাহিদা হলো ক্ষুধা বা খাবারের প্রয়োজন এবং দ্বিতীয় প্রধান চাহিদা হলো যৌনপিপাসা। এই দুটি চাহিদাকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ত্যাগ করার নামই রোজা। রোজা পালন উপলক্ষে সংযমী হওয়ার নেপথ্যে এই দুটি চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করা আবশ্যক। কিন্তু এই নিয়ন্ত্রণ কি আমাদের মধ্যে লক্ষ করা যায়? উল্টো দেখা যায়, অন্য মাসের তুলনায় রমজানে খাওয়ার বাজেট বৃদ্ধি পায়। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, রমজানে গ্যাস্ট্রিকসহ পেটের সমস্যার ওষুধ তুলনামূলক বেশি বিক্রি হয়। কারণ কী? কারণ হলো, এ মাসে মানুষের ভাজাপোড়া ও তৈলাক্ত খাবারের মাত্রা অন্য এগারো মাসের তুলনায় তিনগুণ বৃদ্ধি পায়। নিশ্চয় এটা কোনো সংযমের চিত্র নয়।
আমরা যদি প্রকৃত অর্থেই মাহে রমজানের শিক্ষা অন্তরে ধারণ করতে পারি তা হলে সংযমের অনুশীলন হবে, অভাবী-অনাহারির দুঃখ-কষ্ট বুঝতে সক্ষম হব। সংযম-সাধনার এ মাসে ক্ষুধা ও পিপাসার প্রকৃত অনুভূতির মাধ্যমে বিত্তবান-সচ্ছল রোজাদার মানুষ দরিদ্র ও অভাবী মানুষের না খেয়ে থাকার কষ্ট বুঝতে সক্ষম হন। এ উপলব্ধির আবেশেই বিত্তশালী ব্যক্তি সহানুভূতি ও সহমর্মিতা নিয়ে অন্যের পাশে দাঁড়ানোর স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণা বোধ করেন। রাসুল (সা.) রমজানকে ‘শাহরুল মুওয়াসাত’ তথা সহমর্মিতা-সহানুভূতির মাস বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর এ সহমর্মিতার ক্ষেত্র শুধু আর্থিক সহযোগিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং আর্থিক সাহায্যের পাশাপাশি অপর মুসলমান ভাইয়ের সঙ্গে সর্বোত্তম বিনম্র আচরণ, সদুপদেশ প্রদান, তার জন্য প্রভুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করায় সবই সহমর্মিতার মধ্যে গণ্য। এ বিষয়টির অপরিহার্যতা ফুটে উঠেছে নুমান ইবনে বাশির (রা.) বর্ণিত সুন্দর একটি হাদিসে। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুমিনদের একে অপরের প্রতি সম্প্রীতি, দয়া ও মায়া-মমতার উদাহরণ একটি দেহের মতো। যখন দেহের কোনো অঙ্গ ব্যথা পায়, তখন তার জন্য পুরো শরীরই অনিদ্রা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়।’ (বোখারি : ৬০১১)
আমি নিজকে যতটুকু ভালোবাসি, নিজ দেহের যত্ন নিই যতটুকু, যতটুকু নিজের পরিচর্যা করি, অবহেলা করি না, তেমনি অন্যের প্রতিও অবহেলা দেখানো যাবে না। মানুষের প্রতি দয়াশীল হতে হবে, মন উজাড় করে মানুষকে ভালোবাসতে হবে। পরিপূর্ণ সহানুভূতি আর হৃদ্যতার দ্বারা মানবসেবায় নিজেদের এগিয়ে আসতে হবে। রমজান মাসের সহমর্মিতার এই শুভ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ আমরা যদি বছরব্যাপী অনুশীলন করি, তবেই মানবসমাজে আর দেখা যাবে না কোনোরকম অসাম্য ও শ্রেণিবৈষম্য। দূর হয়ে যাবে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশান্তি-হানাহানি। তাই মাহে রমজানে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষা নিয়ে আমরা সামনের জীবন পরিচালনা করি। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
সময়ের আলো/আরএস/