ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

বইমেলায় বিদায়ের সুর
প্রকাশ: শুক্রবার, ১ মার্চ, ২০২৪, ১:৫৮ এএম  (ভিজিট : ৮৭০)
বইমেলায় বাজছে বিদায়ের সুর। আগামীকাল পর্দা নামছে দীর্ঘ এক মাস ধরে চলা প্রাণের বইমেলার। বইপ্রেমীদের মনে তাই বিষাদের মেঘ। এভাবে ঘুরে ঘুরে বই কেনার জন্য, প্রিয় লেখকের সঙ্গে দেখা করার জন্যে অপেক্ষায় থাকবে সুদীর্ঘ একটি বছর। প্রতিদিন বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোর প্রচারিত সংবাদে থাকবে না বইয়ের খবর, হবে না বই নিয়ে আলাদা করে অনুষ্ঠান। পত্রিকার পাতা থেকেও এক বছরের জন্যে হারিয়ে যাবে প্রতিদিন ছাপা হওয়া বইয়ের রঙিন প্রচ্ছদপট। শিশুচত্বর মা-বাবার হাত ধরে শিশুদের পদচারণায় সজীব-সবুজ হয়ে উঠবে না। সিসিমপুরের শো দেখে শিশুরা উৎফুল্ল হবে না দীর্ঘ একটি বছর। বইমেলা শেষ হচ্ছে।

লেখক-পাঠকের আড্ডা, লেখকের সঙ্গে লেখকের আড্ডা বইমেলা উপচে নিকটবর্তী মন্দিরে গিয়ে জমবে না আর। এক মাস আরও দুই দিনের দীর্ঘ বইমেলা। এই বইমেলা নিয়েও নানান জনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। তবে তার আগে একটি কথা না বললেই নয়। ঢাকা শহরের বিশেষ করে উত্তরার বইপ্রেমীদের কাছে মেট্রোরেল এবার আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল। যেখানে এক-দুই কিলো পথ পাড়ি দিতে জ্যামে বসে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা, মেট্রোরেলের কল্যাণে উত্তরা থেকে মাত্র পনেরো মিনিটেই এসে নামা যেত বইমেলার গেটে। মেট্রোরেল বলা যায় এবারের বইমেলাকে দিয়েছে নতুন এক মাত্রা।

দুনিয়াজুড়েই এখন কন্টেন্ট ক্রিয়েটের হুজুগ লেগেছে। তার ব্যতিক্রম নয় বাংলাদেশ। তার থেকে বাদ পড়েনি বইমেলাও। মাসজুড়েই বইমেলায় ছিল এই কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের ভিড়। টিকটকারদের আনাগোনা। অনেকেই এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছেন বইমেলা তাদের নেই। বদলে যাওয়াই যেখানে পৃথিবীর নিয়ম, সেখানে বদলের হাওয়া বইমেলাতেও লাগবে, তাতে অবাক হওয়ার কী আছে! মেলা এই সবকিছুকে ধারণ করেই হবে। সব ধরনের মানুষের, পাঠকের আগমনেই মেলা সুন্দর হয়ে উঠবে। একজন টিকটকার, কন্টেন্ট ক্রিয়েটরের বই নিয়ে কন্টেন্ট তৈরি করাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখতে হবে। আমরা প্রযুক্তির স্রোতে ভেসে যাওয়া এসব শ্রেণির লোকদের সমালোচনা করি বইয়ের প্রতি আগ্রহ নেই দেখে। এদিকে আবার তারা যখন তাদের মতো করে মেলায় আসে, সেটা নিয়েও আমাদের গাত্রদাহ। আমরাও কট্টরপন্থিদের মতো বেঁধে দিতে চাই মেলার নিয়মকানুন। বিষয়গুলোর প্রতি একবার দৃষ্টি দেওয়া দরকার। আমরা কী বলছি আর কী করছি। বইমেলা হবে সবার জন্য উন্মুক্ত। কেউ বই কিনতে আসবে, কেউ আসবে দেখতে আবার কেউ ঘুরতে আসবে। মনে রাখতে হবে এই তিন শ্রেণিই কিন্তু বইয়ের কাছেই আসছে। সেটা আজ না হোক, একদিন না একদিন সুফল বয়ে আনবেই। এবারের বইমেলায় আলোচিত বা সমালোচিত ব্যক্তি, যারা নিয়মিত লেখক নয়, তাদের বই নিয়ে বেশ হাইপ উঠেছে। ইতিবাকের চেয়ে নেতিবাচক আলোচনাই বেশি হয়েছে। অনেকে এসব ব্যক্তির বই প্রকাশ করায় প্রকাশকদের ধুয়ে দিয়েছেন। 

মনে রাখতে হবে, একজন প্রকাশকের যেমন ভালো সাহিত্যের প্রতি দায় আছে, তেমনি তিনিও দিনশেষে একজন ব্যবসায়ী। একটি ভালো বই প্রকাশ করার জন্য তাকে বাজারকাটতি দশটি বই প্রকাশ করতেই হবে। নইলে তিনি ভালো বই প্রকাশ করবেন কীভাবে? পৃথিবীর সব দেশেই লিটারারি ফিকশনের পাশাপাশি পাল্প ফিকশন প্রকাশিত হয়। আমাদের দেশে জনপ্রিয় ব্যক্তিদের যেসব বই প্রকাশিত হয়, অনেকে বলতে পারেন, সেগুলো কোনো জনরাতেই পড়ে না। মানা গেল। কিন্তু একজন প্রকাশক সেই বইগুলো কেন প্রকাশ করেন? তিনি নিশ্চয়ই নিজের অর্থের শ্রাদ্ধ করার জন্য এসব বই প্রকাশ করেন না। এসব হাইপ তোলা বই বিক্রি হয় বলেই প্রকাশিত হয়। ক্রেতাদের টানা যায় বলেই প্রকাশকরা আলোচিত বা সমালোচিত বই করার জন্য হন্যে হয়ে ছোটেন। এখন দোষের তীরটা কার দিকে ঘোরানো, সেটি লক্ষ রাখতে হবে।

বইমেলায় চিরায়ত বইয়ের পাশাপাশি সিনিয়র লেখকদের বই এবং কিছু কিছু তরুণ লেখকের বই ভালো বিক্রি হয়েছে। দিন বদলের যে হাওয়া সেটা বইমেলার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। একসময় যাদের লেখা পত্রপত্রিকায় নিয়মিত ছাপা হতো, টেলিভিশনে যাদের নাম দেখা যেত, বইমেলায় তাদের বই-ই বিক্রি হতো বেশি। কিন্তু এখন আর সেই দিন নেই। প্ল্যাটফর্ম বদলে গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অত্যন্ত শক্তিশালী এখন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে যারা পাঠকের যত কাছে পৌঁছাতে পেরেছেন, তাদের বই তত বেশি বিক্রি হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, যারা বলেছেন, হুমায়ূন আহমেদের পর বই বিক্রিতে ধস নামবে, তাদের ধারণাও অমূলক প্রমাণিত হয়েছে। প্রতিনিয়ত প্রকাশনীর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, লেখকের সংখ্যাও তেমনি বাড়ছে। এদের মধ্যে অনেকেই এক বা দুটি বই প্রকাশ করে হারিয়ে যাচ্ছেন। কেউ লিখে যাচ্ছেন অবিরাম, অবিরত। এই লেখকের সংখ্যাধিক্যকেও অনেকে বাঁকা চোখে দেখেন। কিন্তু এটাও ইতিবাচক দিক আমাদের সমাজের জন্যে। অগ্রজ লেখকদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই, সমাজে ব্যর্থ সাহিত্যিকের সংখ্যা যত বাড়বে, সমাজ তত উন্নত হবে। কেননা, এসব ব্যর্থ লেখক যখন সমাজের নানান স্তরে ছড়িয়ে পড়বে, সেই সব জায়গায় ধীরে ধীরে অনিয়ম দুর্নীতি কমে আসবে। তবে যারা লিখতে এসেছেন, তাদের জন্য বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ প্রবন্ধের কথাগুলো এখনও প্রযোজ্য। আমাদের দেশের পাঠকদের রুচি এখনও উন্নত হয়নি। তাই টাকার জন্যে বা যশের জন্য লিখতে গেলে উৎকৃষ্ট সাহিত্য রচনা করা আমাদের দেশে এখনও সম্ভব হবে না।

পরিশেষে দুটি কথা বলে লেখা শেষ করছি। প্রথম কথা, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদাকে ধন্যবাদ বইমেলাকে আরও দুই দিন দীর্ঘায়িত করার জন্য। কেননা এতে প্রকাশকসহ বইপ্রেমীরা খুশি হয়েছেন। দ্বিতীয়ত বইমেলাকে স্থানান্তরিত করার যে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে, তা থেকে বিরত থাকা। অমর একুশে বইমেলা এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই রাখা হোক, নইলে স্টলের আয়তন ছোট করে বাংলা একাডেমিসহ সামনের রাস্তায় স্থানান্তর করা হোক। প্রয়োজনে ছয় মাস পরে অন্য কোথাও আন্তর্জাতিক মানের বইমেলা করা হোক। কিন্তু অমর একুশে বইমেলা যেন দূরে কোথাও চলে না যায়। মনে রাখতে হবে, এই বইমেলার সঙ্গে আমাদের চেতনা এবং স্থানের মাহাত্ম্যও জড়িত আছে।

সময়ের আলো/আরএস/ 





https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close