ই-পেপার সোমবার ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪
সোমবার ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪
ই-পেপার

সোমবার ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪

খতনায় শিশু তাহমিদের মৃত্যু: বাসায় শোকের ছায়া স্বজনদের আহাজারি
প্রকাশ: শুক্রবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, ৮:৫৯ এএম  (ভিজিট : ৫৬৪)
আহনাফ তাহমিদের (১০) মৃত্যু হয়েছে রাজধানীর মালিবাগ চৌধুরী পাড়ায় জেএস ডায়াগনোস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে খতনা করতে গিয়ে। গত বুধবার রাতে কুমিল্লায় তাহমিদের মরদেহ দাফন শেষে ঢাকায় ফিরেছেন তার পরিবার। 

বৃহস্পতিবার সকালে তাহমিদকে চিনতেন এমন অনেক প্রতিবেশীই হাজির হন তাদের বাসায়। তারাও তাহমিদের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না। পরিবারের সবাই নিশ্চুপ হয়ে শুধু তার স্মৃতি স্মরণ করে কান্না করছেন। তাহমিদের পড়ার টেবিল, ছোটবেলার ছবি, জামা-কাপড়সহ সবকিছুই চোখের সামনে ভাসছে আর তাহমিদের কথা মনে করে সবাই আবেগরুদ্ধ হয়ে পড়ছে।

খিলগাঁওয়ের বাসায় সরেজমিন দেখা যায়, তাহমিদের মা খায়রুন নাহার চুমকি একটি রুমে অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছেন। পাশের রুমে তার বাবা ফখরুল আলম ছোট ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বসে আছেন। আর তাহমিদের রুমে শুয়ে আছেন তার নানি নাজনীন নাহার। প্রতিবেশীরা আসছেন, কথা বলছেন। তাহমিদ ছিল সবার প্রিয় মুখ। সবার পছন্দের ছিল সে। সবাই তার কথা মনে করে অনবরত চোখের পানি ফেলছেন।

খিলগাঁও এলাকার যে বাসায় তাহমিদরা থাকে সেটি তার নানা বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল হকের। তিন তলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় একটি ফ্ল্যাটে থাকেন তাহমিদের পরিবার। তাদের সঙ্গেই থাকেন তার নানি নাজনীন নাহার। আর পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন তাহমিদের বড় খালা রুমান নাহার রুমকি ও একমাত্র খালাতো বোন তাহমিন নেওয়াজ। সবাই একত্রে থাকায় তাহমিদের সঙ্গে তাদের সখ্য ছিল বেশি। লেখাপড়ায় একজন আরেকজনকে ছাড়িয়ে যেতে সবসময় প্রতিযোগিতা লেগেই থাকত।

তাহমিদের বাবা ফখরুল আলম সময়ের আলোকে বলেন, আমার এমন বিপদ হয়েছে মানুষের জন্য। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যার সঙ্গে দেখা হয়, সবাই বলত ছেলে বড় হয়ে যাচ্ছে, খতনা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। আর চিকিৎসক মোক্তাদিরের ছেলে মতিঝিল আইডিয়ালে পড়ে সে সুবাদে পরিচয়। খতনা করানোর আগের দুদিন তিনি খুবই আন্তরিক হয়ে যান। 

খতনা করার বিষয়ে কথা হলে বলেন, ‘তাহমিদ তো আমার ছেলেই, আপনি টেনশন করবেন না।’ ওদের দুই ভাইকে একসঙ্গে খতনা করিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু আমি বলি না, ছোট আয়মানকে পরে খতনা করাব। ছোট ছেলেকে ওদের কাছে খতনা করাতে দিলে ওকেও মেরে ফেলত।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, সাধারণত ছেলেদের ছোটখাটো কিছু হলেও ল্যাবএইড, পপুলারসহ বড় বড় সব হাসপাতাল ও চিকিৎসক দেখাতাম। তাদের পরামর্শ নেওয়া হতো। কিন্তু খতনা কি খেয়ালে এখানে করাতে নিয়ে গেলাম জানি না। আমার ছেলেকে নিজে হাতে করে মেরে ফেললাম। ওটিতে নেওয়ার সময় লুঙ্গি পরে ভেতরে যাওয়ার সময় ফিরে আসে তাহমিদ, কি যেন বলতে গিয়েও বলল না। চিকিৎসক মোক্তাদির ধমক দিয়ে ভেতরে চলে যেতে বলে। আমার ছেলের কথাটা যদি শুনতে পারতাম, তা হলেও হয়তো বাঁচাতে পারতাম।

তাহমিদের স্মৃতিচারণ করে ফখরুল বলছিলেন, তাহমিদ কোনো বাড়তি ঝামেলা করত না। ওর একটাই ঝামেলা কোথায় যাবে, কোন প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে। মাঝেমধ্যে বকতাম, এসব করলে পড়ালেখা হবে না। কিন্তু সে কনফিডেন্স দেখাত সবকিছু করলেও পড়ালেখায় ভালো করবে সে।

কান্না থামছে না মৃত তাহমিদের মা খায়রুন নাহার চুমকির। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, তাহমিদের পৃথিবী ওর মা। কিন্তু আজকে ও আমাকে রেখেই চলে গেল। ১০ বছরের একটি ছেলে তার মাকে যেভাবে সেবা করেছে, ভালোবাসা দিয়েছে এটা আর কারোর পক্ষে দেওয়া সম্ভব না। আমি ওর সেবা করতে পারিনি, ও আমার সেবা করেছে। মা ছাড়া কিছুই বুঝত না। ওর মা যদি রাতকে দিন বলত, আর দিনকে রাত ওর কাছেই সেটাই ঠিক। কেউ আমাকে কিছু বললে, তার ওপরে ক্ষেপে যেত। তাহমিদ পেটে আসার পর থেকে ওর জন্য ড্রেস থেকে শুরু করে যত জিনিস কিনেছি সব রয়েছে। এর জন্য আমি ডেনমার্ক থেকে চলে আসি দেশে। ওকে নিয়ে আমার স্বপ্নের কোনো শেষ ছিল না। পহেলা ফাগুনের অনুষ্ঠানে ঘুরতে বের হয়েছি। ওকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। খতনা করার দিন দুপুরে আমি বাইরে থাকায় ওরা ভাত খেয়েছে, পরে আমি এলে বলে আম্মু তোমার হাতের ভাতের মতো আজকে মজা লাগেনি। আমায় দুই লুকমা খাওয়ায় দিবা? পর আমি খাওয়ার সময় তাহমিদকে খাইয়ে দিয়েছি। বাসা থেকে রাতে বের হওয়ার সময় বলে আম্মু আমার খুব ক্ষুধা লাগছে, খতনা করালে কি খেতে পারব? তাকে সব খেতে পারবে বলে ওটিতে প্রবেশ করাই, আর আজকে আমি কি করে ওকে রেখে খাবার খাব। কেন তাহমিদকে খাওয়ালাম না বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোহাম্মদ এমাম হোসাইন সময়ের আলোকে বলেন, তাহমিদের এমন মৃত্যুতে আমরা আইডিয়াল পরিবার শোকাহত। গতকাল ওর জন্য স্কুলে দোয়ার আয়োজন করা হয়েছে। ছেলেটা ১৪ জানুয়ারির থেকে ক্লাস শুরু করেছে। দুই মাস না যেতেই তার মৃত্যুর সংবাদ এটা অত্যন্ত কষ্টের।

পলাতক ডাক্তারের বিষয় জানতে চাইলে হাতিরঝিল থানার ওসি শাহ মো. আওলাদ হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, খতনা শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অর্থোপেডিক সার্জন এবং জেএস হাসপাতালের মালিক এসএম মোক্তাদির ও বিএসএমএমইউ অবেদনবিদ্যা (অ্যানেসথেসিওলজি) বিভাগের চিকিৎসক মাহবুব মোরশেদকে গ্রেফতার করেছি। তাদের জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড দেওয়া হয়েছে। ওই ঘটনায় ঢামেক হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক ইশতিয়াক আজাদ পলাতক রয়েছে। তাকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে।

ওসি আরও বলেন, একটা শিশু হাসিমুখে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকল আর ফিরল লাশ হয়ে। এই মা-বাবাকে কী দিয়ে বুঝ দেবেন বলেন?

সময়ের আলো/জিকে




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close