ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

মরে যাচ্ছে খাল-বিল নদী
আনোয়ারায় স্লুইস গেট পরিচালনায় পাউবো-বিএডিসি সমন্বয়হীনতা
প্রকাশ: সোমবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, ১:৪৫ পিএম  (ভিজিট : ৯৮২)
চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায় ৩১টি স্লুইসগেট পরিচালনায় সমন্বয়হীনতায় বিরুপ প্রভাব পড়েছে কৃষি আবাদে। উপজেলার বিভিন্ন খাল ও নদীর মুখে ৩১টি স্লুইসগেট নির্মাণ করলেও এসব স্লুইসগেট পরিচালনার কোন জনবল নাই বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)'র। দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রবেশপথ আনোয়ারা একটি সাগর- নদী খাল বেষ্টিত উপজেলা।

এই উপজেলার উত্তরের কিছু অংশ রয়েছে নোয়া খাল পূর্বেতে রয়েছে মুরালী খাল। আর এই দুই খালের সংযুক্তি হচ্ছে কর্ণফুলী নদী। আর দক্ষিণে চাঁনখালী খাল আর সাঙ্গু  নদী। পশ্চিমে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। নদী সাগর এবং খাল বেষ্টিত এই উপজেলাটি কৃষি উৎপাদন মূলত ধান চাষ। উপজেলার বটতলী ও হাইলধর ফকিরার চর সবজির কিছু জায়গা উর্বর ভূমি  হলেও মূলত এখানকার কৃষকদের ধান চাষটায় কৃষির মূল উপাদান। এখানকার অধিকাংশ  জমি গুলোতে দুই ফসলি আর কিছু জমি রয়েছে যেখানে তিন ফসলি চাষাবাদ হয়।

দেখা যাচ্ছে এই ধান চাষের বোরোর সেচ ব্যবস্থা আমন মৌসুমের বর্ষার পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য  ১১টি ইউনিয়নের মধ্যে ৩১টি স্লুইসগেট নির্মাণ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। তবে এসব স্লুইসগেট নির্মানে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)র অনিয়ম ও বাংলাশে কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)র উদাসীনতায় মরে যাচ্ছে উপজেলার অসংখ্য খাল-বিল নদী। যার বিরুপ প্রভাব পড়েছে আমন ও বোরো উৎপানের লক্ষমাত্রায়। উপজেলা কৃষি অধিদপ্তর সূত্র জানায় আনোয়ারায় তিন ফসলি মোট ৯হাজার ৪শ ৭০ হেক্টর চাষাবাদের জমি রয়েছে।   

উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, আনোয়ারায় নদী রয়েছে ১টি (সাঙ্গু) যার আনোয়ারা অংশে দৈর্ঘ্য ১০ কিলোমিটার।  খাল রয়েছে ৪টি যার মধ্যে রয়েছে চাঁনখালী, ইছামতি, মুরালী ও পারকি খাল। এসব খালের মোট আয়তন দৈর্ঘ্য ১৭৭.৩১ হেক্টর। পশ্চিমাংশে ১০ কি. মি রয়েছে সমুদ্র উপকূল। আর এসব নদী খালের অসংখ্য শাখা প্রশাখা রয়েছে। স্লুইসগেট  নির্মাণে পাউবোর অনিয়মের কারণে  ইতিমধ্যে উপজেলার বেশ কয়েকটি স্লুইসগেট  পানির নীচে তলিয়ে গেছে। নষ্ট হয়ে গেছে ৮টি স্লুইসগেট। এছাড়াও বিএডিসির উদাসীনতায় বন্ধ রয়েছে বেশ কয়েকটি। যার ফলে অন্তত উপজেলার ৩০টি ছোট খালের মৃত্যু হয়েছে। অসংখ্য চাষাবাদের জমি এখন মরুভূমিতে রূপান্তর হয়েছে।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, আনোয়ারা উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে স্লুইসগেট রয়েছে ৩১টি। সরেজমিন ঘুরে  এসব স্লুইসগেটের মধ্য বর্তমান নষ্ট হয়ে আছে ৮টি। ৩১টি স্লুইসগেটের মধ্যে নষ্ট ও চালু আছে এমন স্লুইসগেট হলো ১নং বৈরাগ ইউনিয়নে  শাহাদাত নগর খালে একটি । ২নং বারশত ইউনিয়নের বুড়িরজাল খালে একটি যেটি চালু রয়েছে পারকি বাজারে দক্ষিণে একটি বোয়ালিয়া বেড়িবাঁধ জোদ্দের হাটে উত্তর পাশে ১টি। এই দুটি স্লুইসগেট নষ্ট আর ৩টি স্লুইসগেটের সংযুক্তি হচ্ছে পারকি খাল। এছাড়াও  উত্তর পরুয়াপাড়া ও মাদ্রাসা সংলগ্ন দুইটি রয়েছে।

এই দুইটির সংযুক্তি হচ্ছে সাপমারা খাল। ৩নং রায়য়পুর ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডে সাপমারা খালে দুইটি নজুমিয়া খালে একটি হাড়িয়া পাড়া খালে একটি। এসব স্লুইসগেটের সংযুক্তি হচ্ছে শঙ্খ নদী। ৫নং বরুমছড়া ইউনিয়নের শঙ্খ নদীর মুখে একটি। এছাড়াও শঙ্খ নদীর উপর রয়েছে এলিভেটেড রবার ড্রাম। ৬নং বারখাইন ইউনিয়নের তৈলারদ্বীপে খালে একটি। এসব স্লুইসগেট সংযুক্তি হচ্ছে ভরা শঙ্খ খাল। ৮নং চাতরী ইউনিয়ন মহাতরপাড়া কুমারী খালে একটি মহাতরপাড়া পূর্ব পাশে কৈইয়া খালে একটি। এই দুইটি স্লুইসগেট সংযুক্তি হচ্ছে মুরালী খাল। সবচেয়ে বেশি স্লুইসগেট রয়েছে পূর্বের দুই ইউনিয়ন পরৈকোড়া ও হাইলধরে। পরৈকোড়া ইউনিয়ন কেয়াগড় একটি নোয়া রাস্তার মাথা দুটি কোদালে খালে একটি। এসব স্লুইসগেট সংযুক্তি হচ্ছে ইছামতি খাল।

এছাড়াও বাতুয়া পাড়া একটি বাইগ্যাখালী খালে একটি  টাংঙা পোল একটি স্লুইসগেট রয়েছে। এসব স্লুইসগেট সংযুক্তি হচ্ছে মুরালী খাল। এছাড়াও এই ইউনিয়নে আরো রয়েছে  বেল্যে পাড়া খালে মুখে একটি বেল্যে কুল খালে  একটি  নতুন রাস্তার মাথায় একটি। যেগুলোর সংযুক্তি হচ্ছে চাঁনখালী নদী। আর হাইলধর ইউনিয়নের চাঁনখালী  নদীর মুখে একটি দক্ষিণ ইছাখালী মাজারের পাশে একটি  কুনির বিল ও হেটিখাইন মাঝামাঝি একটি। এসব স্লুইসগেট সংযুক্তি হচ্ছে চাঁনখালী ও শঙ্খনদী। ১১নং জুঁইদন্ডী ইউনিয়নের  ১ ও ৩নং পূর্ব জুঁইদন্ডী দুইটি  ও শঙ্খ নদীর মুখে একটি। এসব স্লুইসগেট সংযুক্তি হচ্ছে সাপমারা খাল ও ভরা শঙ্খ নদী।

পাউবো এসব স্লুইসগেট নির্মাণ করলেও এসব স্লুইসগেট পরিচালনা দায়িত্ব রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)'র। তবে পরিচালনার দায়িত্বের বিষয়ে অস্বীকার করছে বিএডিসি। বিএডিসি বলছে এই কাজ পাউবোর আমাদের নয়। এদিকে আনোয়ারায় বিএডিসির  কাজ থাকলেও তাদের নাই কোন কার্যক্রম। এমনকি তাদের নেই এখানে কোন লোকবল। ফলে তারা খানিক বলছে তাদের জনবল  সংকট না হয় কৃষি কিংবা পাউবোর উপর দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে নানা অজুহাত।

এদিকে চাষাবাদে পানি নিয়ে কৃষি আবাদ উৎপাদনে লক্ষমাত্রা নিয়ে কৃষি অধিদপ্তর বিপাকে পড়লেও পাউবো আর বিএডিসির সমন্বয়হীনতার কারণে কৃষিতে পড়ছে বিরূপ প্রভাব। বছর বছর কমে আসছে চাষাবাদ। শুকনা মৌসুমে সেচের জন্য কৃষকরা করছে হাহাকার। অন্য দিকে বর্ষার এলেই  আমন ডুবছে এক মৌসুমে তিন বার।  ফলে এসবে মূল ক্ষতি হচ্ছে চাষাবাদে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উপজেলার অন্তত ১০ হাজার কৃষক।

এসব স্লুইসগেট পরিচালনার দায়িত্ব বিএডিসির হলেও ৩১টি স্লুইসগেট পরিচালনা করছে স্থানীয় জনপ্রতিধি, কৃষক কিংবা কৃষি অধিদপ্তর । এর মধ্যে চাঁনখালী নদীর মুখে একটা পরিচালনা করছে স্থানীয় ইউপি সদস্য। মহতরপাড়া পশ্চিম পাশে কুমারখালী স্লুইসগেট পরিচালনায় অস্থায়ী একজন কৃষক। বাকী স্লুইসগেট গুলো খানিক স্থানীয় কৃষক না হয় কৃষি অধিদপ্তর বাধ্য হয়ে বোরো মৌসুমে খোলা বন্ধ করার দায়িত্ব পালন করে থাকে।

বিএডিসি ও পাউবোর এমন সমন্বয়হীনতার কারণে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ৩০টি খালের মৃত্যু হয়েছে এমনটাই বলছে কৃষির সাথে সংশ্লিষ্টরা। মরে যাওয়া খালের মধ্যে বড় খাল হচ্ছে শোলকাটা খাল, কান্দুরিয়া খাল (কালাবিবির দিঘি), সাপমারা খাল (বারশত রাযপুর বটতলী), মালঘর খাল, বারখাইন খাল, ইছামতি খাল। এদিকে এসব খালে পানি চলাচল না থাকায় সংযুক্তি বিলে কৃষি আবাদও আর হচ্ছে না।

এদিকে অনিয়ম হওয়া স্লুইসগেট গুলোর মধ্যে রয়েছে বাকখাইন, ইছাখালীসহ বেশ কয়েকটি। একটি স্লুইসগেটের মাধ্যমে দুই উপজেলাকে সংযুক্ত করেছে বাকখাইন ও কৈখাইন নামে দুইটি গ্রাম। ২০২১সালে  ইছামতি খালের শাখা দক্ষিণ বাকখাইন নোয়ারাস্তা কান্দুরিয়া খালের উপর নির্মিত হওয়া স্লুইসগেটটিতে হয় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি। যার ফলে বছর না যেতেই খালের ভিতর তলিয়ে যায় স্লুইসগেটসহ ১০০ মিটারের বেড়িবাঁধ। ২০২১ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করে উপজেলার চাতরী ইউনিয়নের বাকখাইন কান্দুরিয়া খালের স্লুইসগেট। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স রহমান ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেন। কাজে অনিয়মের কারণে এক বছরের মাথায় স্লুইসগেটটি বেড়িবাঁধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তলিয়ে যায়।

এই স্লুইসগেট পূর্বে দিকে আরেকটি স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়েছে। এখানেও হয়েছে ব্যাপক অনিয়ম। যে কোন সময় এটি ও তলিয়ে যেতে পারে পানির নীচে। অপরদিকে হাইলধর ইউনিয়নের দক্ষিণ ইছাখালী ফকিরহাট এলাকায় ৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্লুইসগেটের কাজ অসম্পন্ন রেখে পালিয়ে যায় আলম অ্যান্ড ব্রাদার্স নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, স্লুইসগেট নির্মাণে ত্রুটি ও প্রভাবশালীদের মৎস্য ফাঁড় ব্যবসার কারণে বেড়িবাঁধ তলিয়ে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। এছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি স্লুইসগেট নির্মাণে পাউবোর বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।

এসব স্লুইসগেট পরিচালনা  ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজের অনিয়ম  নিয়ে কথা বলতে চট্টগ্রাম পাউবোর নির্বাহী প্রকোশলী শওকত ইবনে শহীদ, আনোয়ারার দায়িত্ব উপ-বিভাগীয়  প্রকোশলী অনুপম দাশকে একাধিকবার মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলেও ফোন রিসিভ না করায় কথা বলা সম্ভব হয়নি।

জানা যায়, আনোযারায় কোন বিএডিসি কর্মকর্তা না থাকলেও চন্দনাইশ উপজেলার আজমানুর নামের একজন কর্মকর্তা আনোয়ারার দায়িত্ব পালন করে থাকে। এবিষয়ে উপসহকারী প্রকোশলী (ক্ষুদ্রচেস) বিএডিসি আজমানুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি আমাদের কাজ নয় এটি পাউবোর কাজ। এসব পরিচালনায় পাউবোর একটি কমিটি থাকে তারা এটি পরিচালনা করে থাকে। আমাদের যে যেগুলো রয়েছে সেগুলো আমরা পরিচালনা করে থাকি। তার মধ্যে উপজেলার বরুমছড়া ভরা শঙ্খ খালে এলিভেটেড ড্যামটি আমরা পরিচালনা করে থাকি।

এব্যাপারে আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইশতিয়াক ইমন বলেন, এগুলো যারা নির্মাণ করে  তারা সেগুলো পরিচালনা করে তাকে। আপনি তাদের সাথে আলাপ করতে পারেন। না হয় পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীর সাথে আলাপ করতে পারেন।


সময়ের আলো/এএ/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close