টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার আয়তনের প্রায় অর্ধেকই হচ্ছে পাহাড়ি অঞ্চল। অঞ্চলটি মধুপুর ও ভাওয়াল গড়ের একটি অংশ। ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে ছোটবড় অসংখ্য টিলা রয়েছে এখানে। গত ১৫ বছর প্রায় এক তৃতীয়াংশ টিলা কেটে ফেলা হয়েছে। আর টিলার অধিকাংশ মাটি গিলে খেয়েছে ইটের ভাটা। নিচু জমি ভরাট কাজেও টিলা অবদান রেখে চলেছে। লাল মাটির এ ধরনের টিলা কাটা আইনে নিষিদ্ধ। বছরের নভেম্বর থেকে মার্চ মাস। শুষ্ক মৌসুমের এ চার মাস পাহাড়ের বুকে খননযন্ত্র ভেকু এবং মাটি বহনের ট্রাকের তাণ্ডব চলে। অসাধু মাটি ব্যবসায়ীদের কালো হাতের থাবায় টিলা পরিণত হচ্ছে সমতল ভূমিতে। তবে স্থানীয় প্রশাসনের দাবী পাহাড় কাটা বন্ধে তারা তৎপর রয়েছেন।
প্রকৃতির বড় এক আশীর্বাদের নাম পাহাড়। উপজেলার পাহাড়ি এ অঞ্চলের অধিকাংশ জমিই খাস। ছোটবড় টিলাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বন। এ বনভূমির পরিমাণ ২৫ হাজার ৭১১ একর। মাটির রং লালচে। প্রতি রাতেই লাল মাটির বুকে কালো হাতের থাবা পড়ে। টিলা কাটার নিষিদ্ধ যজ্ঞের উৎসব চলে। চলে প্রতিযোগিতা। দিনের বেলায় দেখা মেলে এর ধ্বংসলীলার ভয়াবহ চিত্র। স্থানীয়দের আশঙ্কা এভাবে চলতে থাকলে টিলা নামক শব্দটা অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বিলুপ্ত হয় যাবে এ এলাকার মানুষের অভিধান থেকে। ভারসাম্য হারাচ্ছে পরিবেশ, হুমকিতে জীববৈচিত্র।
ঘাটাইল উপজেলা সদর থেকে ঘাটাইল-সাগরদীঘি সড়ক সংলগ্ন লেংড়াবাজার নামক স্থানের দূরত্ব প্রায় ছয় কিলোমিটার। সরেজমিনে দেখা যায়, এখানে টিলা কাটা প্রায় শেষের পথে। খননযন্ত্র ভেকুর উপস্থিতি থাকলেও মানুষের দেখা মেলেনি।
স্থানীয়রা জানায়, মাটি ব্যবসায়ীরা নির্ভয়ে টানা চার রাত টিলা কেটেছে। তবে কারা এ কাজের সঙ্গে জড়িত ভয়ে মুখ খুলছেন না কেউ। সন্ধানপুর ইউনিয়নের শিমুলতলা এলাকায় সবচেয়ে বেশি পাহাড় কাটা হয়েছে। এলাকাবাসী জানায়, এ কাজে জড়িত ঘাটাইল ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য মো. মিলন মিয়া। মিলনের সঙ্গে নাকি আরও কয়েকজন জড়িত আছেন, তাদের নাম জানতে পারেননি স্থানীয়রা।
মিলনের ব্যবহৃত ফোনে কল করা হলে রিং বাজলেও তিনি রিসিভ করেননি।
সাগরদীঘি ইউনিয়নে সাগরদীঘি বাজারের দক্ষিণ পাশে টিলা কাটার কথা স্বীকার করেন হারুন মিয়া। তবে কয়েকদিন ধরে নাকি বন্ধ আছে।
স্থানীয়রা জানায়, ওই ইউনিয়নের পাগারিয়া এলাকায় প্রতি রাতেই মাটি কাটা হচ্ছে। আর এ কাজের সঙ্গে নাকি জড়িত হারুন মিয়া। তবে হারুনের দাবী ওই স্থানে মাটি কাটেন সখীপুর উপজেলার এক লোক।
এলাকাবাসীর ভাষ্য, জালালপুর এলাকায়ও মাটি কাটার সঙ্গে জড়িত ওই হারুন। তবে সাগরদীঘি ইউনিয়নের কোথাও পাহাড় কাটা হচ্ছে কিনা এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানান ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাওলানা মো. হাবিবুল্লাহ বাহার। লক্ষিন্দর ইউনিয়নের বাসাবাইদ এলাকায় টিলা কাটেন ভুট্টো নামে একজন। স্থানীয়রা তাকে ভুট্টো নামেই চিনেন। আকন্দের বাইদ এলাকায় মাটি কাটেন আব্দুল কাদের ওরফে কানা কাদের। সানবান্দা সলিং এলাকায় লালমাটি ও টিলা কাটেন দুলাল মিয়া। এছাড়াও নতুন বাজার, সিদ্দিকালী, নছুরবাজার এলাকায় এ কাজর সঙ্গে জড়িত শামসুল হক চৌধুরী ও সিরাজুল। কাজলা এলাকায় কাটেন খলিল মিয়া। খাজনাগড়া ও বাঘারা এলাকায়ও কাটা হচ্ছে লাল মাটি। ওই এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে এ কাজে জড়িত হারুন ও সোহেল নামের দু’জন।
লক্ষিন্দর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান বলেন, টিলা কেটে পাহাড়টা ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। সন্ধ্যা হলেই পাহাড় কাটা শুরু হয়। প্রতি রাতেই শতশত গাড়ি মাটি কাটা হচ্ছে। মাটি কাটার হিড়িক পড়েছে। বাধা দিলে উল্টো মাটি ব্যবসায়ীরা আনন্দ মিছিল করে।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এলাকাবাসীর দেওয়া তথ্যমতে; রসুলপুর ইউনিয়নের জাঙ্গালিয়া এলাকায় টিলা কাটেন জাহাঙ্গীর হোসেন। তার সহযোগী হিসেবে আছেন সোহেল রানা, দুলাল ড্রাইভার ও ফরহাদ মিয়া। একই ইউনিয়নে কালারামপুর ঈদগাহ মাঠ সংলগ্ন স্থানে মাটি কাটছেন আরিফ হোসেন। এ কাজে তার সহযোগী মোস্তফা কামাল, সাব্বির হোসেন ও সানোয়ার হোসেন। এলাকাবাসীর ভাষ্যমতে, এরা সবাই দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়ি টিলা কাটার সঙ্গে জড়িত।
জানা যায়, এ বছর ইটভাটা ও নিচু জমি ভরাট কাজে মাটির অনেক চাহিদা। তাই এক হাই ট্রলি (ছোট ট্রাক) ভর্তি মাটি বর্তমান বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৫০০ টাকা থেকে দুই হাজার টাকায়। গত বছর যা বিক্রি হয়েছে এক হাজার ২০০ টাকায়।
ইটভাটা মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগামী মৌসুমে ইট তৈরির জন্য এ বছরেই মাটি কেটে স্তূপ করে রাখা হচ্ছে। শুধু পাহাড়ি লাল মাটি দিয়ে ইট হয়না। লাল মাটির সঙ্গে মেশানো হয় বালু। সঙ্গে প্রয়োগ করা হচ্ছে খৈল, টিএসপি ও ইউরিয়া সার।
বন বিভাগ ঘাটাইলের ধলাপাড়া রেঞ্জ কর্মকর্তা ওয়াদুদ রহমানকে বারবার ফোন করলে তিনি রিসিভ করেননি। ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও সারা মেলেনি।
টাঙ্গাইল পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ–পরিচালক জমীর উদ্দিন জানান, তাদের পক্ষ থেকে এ বছর পাহাড় কাটা বিষয়ে ঘাটাইলে কোনো অভিযান পরিচালিত হয়নি। তবে প্রমাণ পেলে এ কাজে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘পাহাড় কাটার ফলে ওই এলাকায় ভূমিকম্প বেশি হবে। বৃষ্টি হলে পাহাড় কাটার বাকী অংশ ভূমিধ্বসের সৃষ্টি হয়ে জানমালের ক্ষতি হবে। পরিবেশ তার ভারসাম্য হারাবে। পাহাড় কাটা বন্ধে অবশ্যই প্রশাসনকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।’
ঘাটাইল থানার ওসি মোহাম্মদ আবু ছালাম মিয়া বলেন, পাহাড় কাটা বন্ধে পুলিশের পক্ষ থেকে যতটুকু ব্যবস্থা নেওয়ার আমরা তা নিচ্ছি। এ কাজে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে প্রশাসনকে পুলিশের পক্ষ থেকে সহায়তা করা হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, সরজমিনে যেখানে পাহাড় কাটা হচ্ছে সেখানে গিয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
ঘাটাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরতিজা হাসান জানান, পাহাড় কাটা বন্ধে প্রতিদিনই অভিযান চলছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করা হচ্ছে।
সময়ের আলো/আরআই