হারিয়ে যাচ্ছে চলনবিলের জৌলুস। চলনবিল অধ্যুষিত পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ এলাকার নদ-নদীগুলো নাব্য সংকটের কারণে দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে। পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, নাটোরের গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম এবং সিংড়া, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, রায়গঞ্জ ও উল্লাপাড়ার আংশিক এলাকা নিয়ে গঠিত বাংলাদেশের বৃহৎ বিল চলনবিল।
চলনবিল এলাকার অধিকাংশ নদ-নদীই দীর্ঘদিন খনন করা হয়নি। ফলে প্রতি বছর মাঘ-ফাল্গুন মাস আসতে না আসতেই শুকিয়ে যায় এ এলাকার নদ-নদী, খাল-বিল। এতে ব্যাহত হয় সেচ ব্যবস্থা। পাশাপাশি নানা প্রজাতির দেশি মাছও কমে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী এ বিল থেকে। ব্যবসা-বাণিজ্যেও পড়ছে এর প্রভাব। অধিকাংশ নদী শুকিয়ে যাওয়ায় মাঘের শুরুতেই বন্ধ হয়ে গেছে নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা। জলপথে পণ্য পরিবহন খরচ কম হলেও জলপথ ব্যবহার উপযোগী না থাকায় অধিক খরচে স্থলপথে পণ্য পরিবহন করতে হয় ব্যবসায়ীদের।
অধ্যক্ষ আবদুল হামিদ রচিত চলনবিলের ইতিকথা গ্রন্থ থেকে জানা যায়, জলপাইগুড়ির পাহাড় থেকে উৎপন্ন হওয়া আত্রাই ও গুর নদী রাজশাহীতে এসে কয়েকটি শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর একটি শাখা কয়রাবাড়ী, নন্দনালী ও আত্রাই হয়ে আত্রাই ঘাটের এক মাইল নিম্নস্থল হতে ‘গুড়’ নামে সিংড়া, একান্ন বিঘা, যোগেন্দ্রনগর ও কালাকান্দরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাঁচকৈড় ত্রিমোহনায় নন্দ কুজার সঙ্গে মিশেছে। এদের মিলিত স্রোত গুমানী নামে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে নূরনগরে বড়াল নদীর সঙ্গে মিশেছে। ১৭৮৭ সালে তিস্তার সঙ্গে আত্রাই নদীর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এটি জলপাইগুড়ির উত্তর পশ্চিম সীমান্ত থেকে দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ, নিমগাছী তাড়াশ এবং চাটমোহরের হান্ডিয়াল হয়ে অষ্টমনীষার কাছে বড়াল নদীতে মিশেছে। ১৩০৪ সালে ভূমিকম্পে নদীটির কয়েক জায়গা মরে যায়। করতোয়ার নিম্নাংশ আত্রাই ও ফুলঝোড় নামে পরিচিত।
বড়াল নদী পদ্মার চারঘাট মোহনা থেকে নাটোরের বাগাতিপাড়া এবং বড়াইগ্রাম হয়ে চাটমোহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নূরনগরে গুমানীর সঙ্গে মিশে বড়াল নামেই ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর-বাঘাবাড়ী হয়ে হুরাসাগরের সঙ্গে মিশে নাকালিয়া এলাকায় গিয়ে যমুনার সঙ্গে মিশেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিও নদীটি স্রোতস্বিনী থাকলেও একেবারে শেষের দিকে রাজশাহী থেকে নূরনগর পর্যন্ত নদীটির অনেক স্থানে ক্রসবাঁধ দেওয়া হয়। মাছ চাষের নামে নদীটি লিজ দেওয়া হতো। লিজগ্রহীতারা নদীকে খণ্ড খণ্ড করে ভাগ করে মাছ চাষ করত। পরে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে নদীটি আর লিজ দেওয়া হবে না। অনেক দিন ধরে লিজ দেওয়া বন্ধ থাকলেও আবার এ নদী লিজ দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে। বড়াল নদী উদ্ধারে বড়াল রক্ষা কমিটির দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসার ফলশ্রুতিতে চাটমোহর নতুন বাজার, বোঁথর ঘাট ও রামনগরের ঘাটের তিনটি ক্রসবাঁধ অপসারণ করা হলেও এখনও পদ্মার সঙ্গে যমুনার সংযোগ ঘটানো সম্ভব হয়নি। নূরনগর থেকে বাঘাবাড়ী পর্যন্ত বর্ষায় কিছুদিনের জন্য প্রাণ ফিরে পায় নদীটি। চেঁচুয়া নদী ধারাবারিষার দক্ষিণ পাশ দিয়ে চতরার বিল, জোড়দহ, আফরার বিল, খলিশাগাড়ি বিল ও কিনু সরকারের ধর হয়ে চরসেনগ্রামের পশ্চিমে গুমানী নদীর সঙ্গে মিশেছে। এ নদীও প্রায় অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে।
দক্ষিণ চলনবিলের বড়াইগ্রামের চিনাডাঙ্গা বিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাটমোহরের মূলগ্রাম ফৈলজানা হয়ে ফরিদপুরের ডেমরার কাছে চিকনাই নদী বড়াল নদীতে মিশেছে। ডেমরা এলাকায় সøুইসগেট থাকায় ফরিদপুর থেকে নদীটি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বর্ষা মৌসুমে মাস চারেক এ নদীতে পানি থাকলেও বাকি আট মাস পানিশূন্য থাকে নদীটি।
এগুলো ছাড়াও বানগঙ্গা, তুলশী নদী এবং ভাদাই নদীসহ চলনবিলের অন্তত ১৪টি নদী এবং প্রায় ২০০ খাল বিল-খাড়ির বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত করুণ। চাটমোহরের ছাইকোলা গ্রামের হাসিনুর রহমান উজ্জ্বল জানান, এ এলাকার মানুষ একসময় নৌকায় বিভিন্ন হাটবাজারে যেত। নৌপথ বন্ধ হওয়ায় এখন ক্রেতারা তাদের পণ্য নৌকায় হাটে নিতে পারেন না। আবার হাটবাজার থেকে পণ্য কিনে নৌপথে বাড়ি ফিরতে পারেন না। নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মৎস্যজীবী। অনেক মৎস্যজীবী ইতিমধ্যেই পেশা পরিবর্তন করেছেন। একসময় নদী থেকে কৃষক অগভীর নলকূপের সাহায্যে বোরো ক্ষেতে পানি সেচ দিতে পারলেও এখন আর তা পারেন না। উপরন্তু পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাওয়ায় অগভীর পাম্প মালিকরা মৌসুমের শুরুতেই তাদের সেচ পাম্প সমতল থেকে অন্তত ১০ ফিট নিচে স্থাপন করতে বাধ্য হন।
আত্রাইসহ দুয়েকটি নদী খনন করা হলেও শুরু থেকেই খনন কাজে অনিয়ম হওয়ায় চলনবিলের মানুষ খুব একটা উপকার পান না। খননের নামে এ নদীর মাটি এবং বালি বিক্রির মহোৎসব শুরু হয়। অনেক স্থানে নদীর মাটি সরিয়ে না নিয়ে নদীর মধ্যেই রাখা হয়। বর্ষায় সেসব মাটি ফের নদীর তলদেশে চলে যায়। ফলে নাব্য সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না।
চাটমোহর সরকারি কলেজের ভূগোল বিষয়ের বিভাগীয় প্রধান ড. এসএম মুক্তি মাহমুদ জানান, ভৌগোলিকভাবে এ এলাকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো নদীর জীবনচক্রের শেষ পর্যায়ে অর্থাৎ বার্ধক্য অবস্থায় পরিণত হয়েছে। চলনবিল এলাকার নদীর তলদেশের ঢালের পরিমাণ কম, নদীর প্রবহমান পানির পরিমাণ কম, স্রোতের বেগও কম। উৎসস্থান থেকে নদীগুলোর দূরত্ব অধিক হওয়ায়, পানির সঙ্গে প্রবাহিত মৃত্তিকা কণা, বালুকণা, নূড়ি কণা এবং অন্যান্য ময়লা আবর্জনার পরিমাণ বেশি ও নদীর তলদেশে তা সঞ্চয়নের পরিমাণ অধিক হওয়ায় ক্রমেই নদী উপত্যকার পানির ধারণক্ষমতা কমে আসছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে নদীগুলো শুকিয়ে যায়। এতে উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের খাদ্যশৃঙ্খল ব্যাহত হয়। মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন ও ফসল উৎপাদনসহ পানিসংশ্লিষ্ট অন্যান্য সব কার্যক্রম ব্যাহত হয়। ফলে বিপর্যয় ঘটছে পরিবেশেরও।
সময়ের আলো/আরএস/