ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

ক্ষমতার অঙ্ক আর ইজারা প্রথার প্রবল প্রতাপ
বাঁওড় পারের জেলেদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
প্রকাশ: বুধবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০২৪, ৪:১৭ এএম  (ভিজিট : ৫৫৬)
‘জাল যার জলা তার’ নীতি প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার বলুহর ইউনিয়নের বলুহর বাঁওড়সহ প্রায় সব বাঁওড়েই প্রবেশাধিকার হারিয়েছেন বাঁওড় পারের জেলেরা। ক্ষমতার অঙ্ক আর ইজারা প্রথার প্রবল প্রতাপে আজ দিশাহারা এই অঞ্চলের ছয়টি বাঁওড় পারের ২০ থেকে ২৫ হাজার মানুষ। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে একতরফাভাবে বলুহর বাঁওড় নিজেদের মতো ভোগদখল করে রেখেছে দখলকারীরা। এতে রাজস্ব আহরণে লোকসান গুনতে হচ্ছে সরকারকে।

রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় এবং দখলদারদের দুর্নীতির কারণে ভূমি মন্ত্রণালয় বলুহর বাঁওড়টি মৎস্য বিভাগের কাছে নবায়ন না করে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ২০২২ সালের ২০ মার্চ। এদিকে ৪০ বছরের প্রশ্নহীন বঞ্চনাকে প্রশ্ন করে আবারও জেগে উঠেছে বলুহর বাঁওড় পারের মানুষরা, ঠিক যেমন ঔপনিবেশকতার জুলুমের বিরুদ্ধে জেগেছিল নীল বিদ্রোহের সময়। প্রভাবশালীদের ইজারা বাতিল করে বাঁওড়ে নিজেদের অধিকারের দাবিতে সংগঠিত হয়েছেন বঞ্চিত জেলেরা। কিন্তু কেউ তাদের কথা শুনছে না। জনপ্রতিনিধি থেকে নাগরিক সমাজ কিংবা গণমাধ্যম সবাই এ ক্ষেত্রে বিস্ময়করভাবে নিশ্চুপ।

ক্ষুধা আর ক্ষোভ নিয়ে বাঁওড় থেকে জেলেরা পরিবার-পরিজন নিয়ে ঢাকায় গিয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে তপ্ত রাস্তায় নিজেদের অনিশ্চিত জীবনের টুকরোচিত্রও তুলে ধরেছিলেন গত বছরের মে মাসে। দেখে মনে হচ্ছিল, এ যেন এক টুকরো দলিত-মথিত ‘পদ্মা নদীর মাঝি’! খসখসে ত্বকের শিশু, উদভ্রান্ত চোখের তরুণ কিংবা বিবর্ণ পৌঢ়দের ছায়াগুলো প্রখর তাপে যেন চুরমার হয়ে যাচ্ছিল। যেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ কিংবা ‘তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত’ থেকে উঠে আসা শত বঞ্চনার ক্ষত নিয়ে খ-বিখ- মানুষরা এক হয়েছেন অস্তিস্ত¡ টিকিয়ে রাখার তাগিদে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সমস্যার সমাধান মেলেনি। মানুষগুলো আজ পেশা হারিয়ে দিগি^দিক জ্ঞানশূন্য। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবমান ঝিনাইদহ ও যশোর অঞ্চলের ছয়টি বাঁওড় পারের জেলে সম্প্রদায়ের হাজারো মানুষ। বাঁওড়ই ছিল তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। অন্যদিকে ইজারাদাররা বাঁওড়ে কৃত্রিম উপায়ে মাছের পোনা উৎপাদন ও সংরক্ষণ করায় দেশীয় প্রজাতির মাছ আজ বিলুপ্তির পথে। ২০২২ সালে ভূমি মন্ত্রণালয় জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে বাঁওড় ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে। একই বছর ইজারাদারদের বাঁওড় বুঝিয়ে দেওয়া হয়। বাঁওড় পারের জেলেদের অভিযোগ, মৎস্যজীবী না হয়েও বাঁওড় ইজারা পেয়েছেন অনেকে। এ কারণে বাঁওড় পারের মানুষরা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। 

ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক এসএম রফিকুল ইসলাম বলেন, ভূমি মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছিল। সেই সমঝোতা স্মারক বলেই এই বাঁওড়গুলো পরিচালনা করা হতো। বাংলা ১৪২৯ সালে ওই স্মারকের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেয় যে, স্মারকের মেয়াদ আরও বাড়ান হবে না। ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা ইজারা দেওয়ার জন্য দরপত্র আহ্বান করে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওই প্রক্রিয়া শেষে যারা দরপত্র অনুযায়ী বাঁওড় ইজারা নিয়েছেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আমরা তাদের হাতে দরপত্র বুঝিয়ে দিয়েছি। এর পরিপ্রেক্ষিতে যারা এতদিন বাঁওড়ের সুবিধা ভোগ করে আসছিলেন তারা সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। যারা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তারা একটি স্মারকলিপিও দিয়েছেন। সেই স্মারকলিপিতে নিজেদের হতাশা এবং কষ্টের কথা উল্লেখ করেছেন তারা। আমি তাদের সেই স্মারকলিপি সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠিয়ে দিয়েছি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে যে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে আমরা সেই আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সরেজমিন জয়দিয়া বাঁওড় পারে দেখা যায়, অনেক জেলে ও তাদের পরিবারের লোকজন দাঁড়িয়ে বাঁওড়ের দিকে শূন্য চোখে চেয়ে আছেন। এ সময় তাদের অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। জয়দিয়া বাঁওড় ও মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি শীতল কুমার হালদার বলেন, আর সংসার টানতে পারছি না। আমরা পথে বসে গেছি। আমার বাবা ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে এই বাঁওড় থেকে মাছ ধরে সংসার চালিয়ে আমাদের বড় করেছেন। আমরা বাঁওড় পারের জেলেরা এই কাজই শুধু শিখেছি। আগে বাঁওড়ে উৎপাদিত বড় মাছের ৪০ শতাংশসহ প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত রানী মাছ ধরলে তার পুরোটাই আমরা পেতাম। কিন্তু এখন রানী মাছ ধরা দূরের কথা, ইজারাদাররা আমাদের বাঁওড়ে নামতেই দেন না। আমাদের আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় নেই। জয়দিয়া বাঁওড়ের মৎস্যজীবীদের সাবেক দলপতি নিত্য হালদার বলেন, বাঁওড় ফিরে পেতে মৎস্যজীবীদের পক্ষ থেকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। মামলাটি হাইকোর্টে চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায় আছে।

যশোর বিল-বাঁওড় মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক আলফাজ উদ্দীন শেখ বলেন, ৪২ বছর এই বাঁওড়গুলো আমাদের আওতায় ছিল। বাঁওড় পারের জেলেদের আর্থ-সামাজিক মানোন্নয়নে কাজ করেছে প্রকল্পটি। বাঁওড়গুলো রাখার জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেও পারিনি। সেগুলো ভূমি মন্ত্রণালয় ইজারা দিয়েছে। আমাদের আর কিছুই করার নেই।

বলুহর বাঁওড় ম্যানেজার সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ইজারাদাররা বেশি মুনাফার লোভে কৃত্রিম উপায়ে মাছ চাষ করছেন। যখন-তখন মাছ ছাড়ছেন ও ধরছেন। এ কারণে দেশীয় মাছ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হতে বসেছে। এদিকে অভিযোগ অস্বীকার করে বলুহর বাঁওড় ইজারা পাওয়া কোটচাঁদপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি শীতল হালদার বলেন, আমার মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি কাউকে ইজারা পাইয়ে দেয়নি। আমরা সাব-লিজও দিইনি।

সময়ের আলো/আরএস/ 








https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close