ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

জীবিকার যুদ্ধে টিকে থাকা নৃ-গোষ্ঠী নারীরা!
প্রকাশ: সোমবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০২৪, ৯:৪৭ পিএম  (ভিজিট : ৫৩৬)
শ্রাবণের নুয়ে পড়া স্বচ্ছ আকাশের সামিয়ানায় এ যেন দিগন্ত জোরা সবুজের শায়িত সমারোহ। কোন সুদূর থেকে ভেসে আসছে যেন এক মরমী সুর, কে গায় এতটা দরদ নিয়ে। যখন বড্ড আহত ধরণীর প্রাচীন এই ফুসফুস পাতা ঝড়া মধুপুরের শাল বন। তবুও শালের জীর্ণ পাতারা ঝরে পড়ে, নতুন পত্র পল্লবীতে প্রস্ফুটিত পুষ্পে সুভাষিত হয় অরণ্য।

এমন সুবাস হৃদয়ে বহন করেই পাহাড়ি পিচ গলা পথ ধরে হাটতে লাগলাম। খানিকটা এগুতেই আঁকড়ে পড়ে দুইপাশে বনাঞ্চল ঘেঁষা মধুপুর উপজেলার শোলাকুড়ি ইউনিয়নের আমতলীর তিন ফসলি বিস্তৃত জমি। খরতাপে পুড়ছে জমিগুলো বৃষ্টির দেখা না থাকায় এখনো অনাবাদী। রোদে পুড়ে কাজ শেষে দলবদ্ধ হয়ে বাড়ি  ফিরছে গারো কোচ নারীরা। পরিবারের সন্তানদের লালন পালন, সংস্কৃতি রক্ষা, কৃষিকাজ থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে নারীর রয়েছে অসামান্য অবদান। তবে জমির খাজনা দিতে না পারায় উচ্ছেদ আতঙ্কেই যেন দিন কাটে তাদের। পিছিয়ে আছে গ্রামীণ অর্থনীতিও। তবুও জীবিকার তাগিদে জীবন সংগ্রাম থেমে নেই তাদের।  

মধুপুরের পীরগাছা গ্রামের চলার পথে থমকে যেতে হয় রাস্তার পাশে খটখট আওয়াজ শুনে। চোখে পড়ে নকরেক'নি জুমাং তাঁত শিল্পের সাইনবোর্ডে। ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, একদল নারী কাঠের তাঁত মেশিনের সাহায্যে নিপুণ হাতে বুনে যাচ্ছে শাড়ি, গামছা ও ওরনাসহ বাহারি পণ্য..চোখের পাতায় তাদের আগামী দিনের অব্যক্ত স্বপ্নের দিগন্ত আকা।

ফ্রান্সিলা নকরেক নামে একজন নারী উদ্যোক্তা ২০০২ সালে গড়ে তুলেন এই তাঁত শিল্পটি। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় স্বামীর একার পক্ষে সংসারের খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হয় বলে নিজেই কিছু একটা করবার প্রত্যয় নিয়ে পথ চলতে থাকে। ঢাকায় বছর খানেক সময় ধরে তাঁতের মাধ্যমে পোশাক বুননের প্রশিক্ষণ নেন। সেখানে কাজ শিখে ফিরে আসেন নিজ গ্রামে, গ্রাম হত দরিদ্র অল্পশিক্ষিত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নারীদের নিয়ে গড়ে তুলে এই তাত শিল্পটি। প্রথমে ৩০ জন নারীকে নিজে  প্রশিক্ষণ দিয়ে তার তাঁত শিল্পে কাজে লাগান, পরে শ্রমিক সংখ্যা আরো বাড়লেও করোনায় পোশাকের অর্ডার কমে যাওয়ায় একরকম বন্ধ রাখতে হয় কারখানা। কোথা থেকে কোন সহযোগী না পাওয়ায় হাল ছেড়ে দেন ফ্রান্সিলা নকরেক। পরে অল্প কিছু পুঁজি জড়ো করে আবারও নিজ উদ্যোগে চালু করেন তার তাঁতের কারখানা।

আগে শ্রমিকের সংখ্যা বেশি থাকলেও এখন ১০ জন নারী কাজের সুযোগ পাচ্ছেন তার তাঁতে। পণ্যের ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্যেও সরকারি ঋণ সুবিধা না পাওয়া এবং সুতার দাম বৃদ্ধির কারণে ব্যবসাটাকেও এগিয়ে নিতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তাকে। প্রতিবছর এই কারখানা থেকে পোশাক বিক্রি দাঁড়ায় ৮ থেকে ১০ লক্ষ টাকা, যদিও করোনার আগে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা বিক্রি হত। শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রি পিস,গামছা, ওড়না, গারো নারীদের দকমান্দা শাড়ির চাহিদা রয়েছে তার কারখানায়। তাঁত মেশিনের কোন যন্ত্রপাতি নষ্ট হলে তা নিজেই মেরামত করতে পারেন তিনি।

কারখানার বিষয়ে ফ্রান্সিলা নকরেক জানান, আমাদের আদিবাসী নারীদের সংগ্রামের জীবন। সংসারের একটু বাড়তি অর্থের জন্যই নিজে তাঁতের কাজ শুরু করি। আমরা কোন ব্যাংক ঋণ সুবিধা না পাওয়ায় ব্যবসায় উন্নতি করতে পারছি না। সহজ শর্তে সুদ মুক্ত বা স্বল্প সুদে লোন পেলে আমার তাঁত শিল্পটাকে বড় করার পাশাপাশি অনেক নারীর কর্মসংস্থান করতে পারতাম।  

নকরেক'নি জুমাং তাঁত শিল্পে কাজ করা প্রমিলা, অনিতা, বিউটি সাংমাসহ বেশ কয়েকজন জানায়, ফ্রান্সিলা দিদির কারখানায় কাজ করে আমরা প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা রোজগার করতে পারি, এই টাকা দিয়ে আমাদের সংসার সন্তানদের লেখাপড়া খরচ চলে। তবে পুঁজির ব্যবস্থা হলে কারখানাটি আরও বড় হওয়ার পাশাপাশি অনেক শ্রমিকরা কাজ করার সুযোগ পেতাম।

মধুপুরের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর দিন অধিকার স্বার্থরক্ষা এবং ভূমির অধিকার নিয়ে কাজ করা আদিবাসী নেতা জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক বলেন, মধুপুরে গারো কোচ সম্প্রদায় মিলিয়ে প্রায় ৩০ হাজার আদিবাসীদের বসবাস। দীর্ঘদিন ধরে এই জনপদের মানুষ ভূমি সমস্যায় ভুগছে, ভূমির খাজনা দিতে না পারায় বন বিভাগের উচ্ছেদ আতঙ্ক পিছু ছাড়ছে না তাদের। অন্যদিকে জমির কাগজপত্র না দেখাতে পারায় ব্যাংক লোন সুবিধা থেকেও বঞ্চিত তারা। যার ফলে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এখানকার অর্থনৈতিক জীবন যাত্রা। বিশেষ করে অনেক নারী উদ্যোক্তারাই অর্থের অভাবে তারা তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো দাঁড় করাতে পারছে না। ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্প গুলো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে তাদের বিনা সুদে লোনের ব্যবস্থা করে দিলে আদিবাসী নারী সমাজ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি উদ্যোক্তা বাড়বে।

মধুপুরে নকরেক'নি জুমাং তাঁত শিল্প ছাড়াও বাশ-বেত, কৃষি কাজসহ ছোট ছোট ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে আদিবাসী নারীরা।

সময়ের আলো/আরআই


আরও সংবাদ   বিষয়:  জীবিকার যুদ্ধ   ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নারী   তাঁত শিল্প   ময়মনসিংহ   




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close