ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

তীব্র শীত ও কুয়াশা কৃষিতে ক্ষতির আশঙ্কা
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০২৪, ১:৫০ এএম  (ভিজিট : ৬৮৮)
তীব্র শীত ও কুয়াশার কারণে ফসলের ক্ষতি বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, কয়েক দিনের তীব্র শীতে ধান চাষের জন্য প্রস্তুত করা বীজতলায় অনেক চারা নষ্ট হয়ে গেছে। শীতের সঙ্গে দীর্ঘ সময়জুড়ে কুয়াশা থাকার কারণে ফসলের গাছে ছত্রাকজনিত রোগের আক্রমণও বেড়েছে। দেশজুড়ে শৈত্যপ্রবাহ ও ঘন কুয়াশায় সবচেয়ে বেশি চিন্তায় পড়েছেন বোরো ধান চাষিরা। এমন পরিস্থিতিতে কোথাও কোথাও বৃষ্টির আভাস কৃষকদের আরও আতঙ্কিত করে তুলেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, জানুয়ারিতে বোরো ধান ছাড়াও আলু, ডাল, ভুট্টা, তৈলবীজ জাতীয় ফসলসহ বিভিন্ন ধরনের শাকসবজির চাষ হয়। প্রচ- শীত ও ঘন কুয়াশায় বেশি ক্ষতি হচ্ছে বোরো ধানের বীজতলার। কারণ ঠান্ডায় মাটিতে যে ‘ফিউজারিয়াম প্যাথোজেন’ থাকে-অঙ্কুর গজানোর পরপরই এর আক্রমণ হলে বীজ গজায় না। বোরোর পাশাপাশি রবিশস্যের মধ্যে শাকসবজি, পেঁয়াজ, ডালসহ অন্যান্য ফসলের ক্ষতি ও পোকার আক্রমণ হচ্ছে। সরিষার ফুল ঝরে পড়ছে। শৈত্যপ্রবাহ আরও কয়েক দিন চলতে থাকলে কৃষকদের দুশ্চিন্তা আরও বাড়বে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, চলতি বছর ১ লাখ ৯৮ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করা হয়েছে। সবজি আবাদ করা হয়েছে ১ লাখ ৫৯ হাজার হেক্টর জমিতে। এ ছাড়া সাড়ে চার লাখ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ কোটি ১৬ লাখ টন। এর মধ্যে উচ্চ ফলনশীল আলু আবাদ হয়েছে ৩ লাখ ৯৩ হাজার হেক্টর জমিতে। আর স্থানীয় আলু আবাদ হয়েছে ৫৬ হাজার ৫০৫ হেক্টরে। তীব্র শীত ও কুয়াশার মধ্যে বৃষ্টি হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে আলু, পেঁয়াজ ও শীতকালীন সবজি চাষিদের।
চলতি রবি মৌসুমে গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলায় আলুসহ ব্যাপক পরিমাণ শাকসবজি আবাদ করা হয়েছে। শুরু হয়েছে ইরি-বোরো চারা রোপণের কাজ। তবে শৈত্যপ্রবাহ ও কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ার প্রভাবে রবিশস্যের ক্ষতির আশঙ্কায় কৃষকদের কপালে পড়েছে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। স্বপ্নের এ ফসল রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা করছেন তারা। গত দুই সপ্তাহ ধরে প্রচণ্ড শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে ফসলে রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। তারা জানান, কয়েক দিনের টানা ঘন কুয়াশার কারণে আলু ক্ষেতে মড়ক দেখা দিয়েছে। এতে আলু উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে। সংক্রমণ ঠেকাতে না পারলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এ ফসল রক্ষায় কৃষি বিভাগের তেমন কোনো সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ কৃষকদের।

উপজেলার ধাপেরহাট ইউনিয়নের নিজপাড়া গ্রামের কৃষক ফারুক মিয়া বলেন, অধিক লাভের আশায় তিনি এ বছর ৫০ শতক জমিতে আলু চাষ করেছেন। বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা ছিল তবে গত কয়েক দিনের ঘন কুয়াশায় ক্ষেতে পোকামাকড় আক্রমণসহ গাছে পচন রোগ দেখা দিয়েছে। তাই কীটনাশকের দোকানির পরামর্শে ওষুধ স্প্রে করছেন। সাদুল্লাপুর উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা রুহুল আমিন বলেন, শৈত্যপ্রবাহে কৃষকের রবিশস্যের ক্ষতি যাতে না হয়, সে ব্যাপারে তাদের সার্বক্ষণিক পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে আলু ক্ষেতে সংক্রমণ ঠেকাতে মেনকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে দুই গ্রাম হারে সাতদিন পরপর স্প্রে করা এবং জমিতে সেচ দেওয়া বন্ধ করতে বলা হচ্ছে।

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে শীত ও ঘন কুয়াশায় নষ্ট হচ্ছে লাউ, করলা, মিষ্টি কুমড়া, আলু, শাকসবজিসহ বিভিন্ন রবি ফসল। ফসল রক্ষায় সার ও কীটনাশক ব্যবহার করেও কোনো সুফল না পাওয়ায় দুশ্চিন্তা আর হতাশায় দিন কাটছে কৃষকদের। তবে কৃষি অফিস বলছে, বৈরী আবহাওয়ায় রবি ফসল রক্ষায় প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। দৌলতপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় এবার আলু, লাউ, বেগুন, মরিচ, করলাসহ বিভিন্ন রবি ফসল চাষ করেছেন কৃষক। তীব্র শীতের সঙ্গে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মতো ঘন কুয়াশায় কৃষকের স্বপ্নের ফসল নষ্ট হচ্ছে। ফসল বাঁচাতে কয়েক দফা কীটনাশক প্রয়োগ করেও মিলছে না প্রতিকার। কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, এ বছর উপজেলায় চলতি রবি মৌসুমে ১ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে আলু এবং ১ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে শীতকালীন শাকসবজির চাষ হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, মৌসুমে ধানের ন্যায্যমূল্য পেলেও এবার আশার আলো নিয়ে জমিতে আলুসহ বিভিন্ন রবিশস্য চাষ করা হয়েছিল। কিন্তু বৈরী আবহাওয়ায় তা নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। আলুর পাতা কুচকে যাওয়াসহ দেখা দিয়েছে পচনজনিত রোগ। এ অবস্থায় কৃষি অফিসের কারও কোনো পরামর্শ কিংবা সাহায্য পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ কৃষকদের।

উপজেলার শীতলাইপাড়া কৃষক আকবর আলী জানান, ঘন কুয়াশায় লাগানো লালশাক, লাউ, বেগুন, করলা পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কোনো প্রতিকার মিলছে না। শীতে আলু গাছ মরে যাওয়ায় চিন্তিত তারা।

দৌলতপুর উপজেলা কৃষি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান বলেন, কৃষি কর্মকর্তারা চাইলেও সব ক্ষেতে যেতে পারবে না। কৃষকদের মাঝে মোবাইল নম্বর দেওয়া আছে। তারা চাইলে আমাদের কাছ থেকে কৃষি বিষয়ে যেকোনো পরামর্শ নিতে পারবেন। এ ছাড়াও আমরা কৃষকদের মধ্যে পরামর্শপত্রের লিফলেট বিতরণ করছি।

কুড়িগ্রাম সদরের ভোগডাঙার কৃষক আনিছুর রহমান বলেন, বোরো আবাদের জন্য বীজতলার চারার পরিণত বয়স হলেও প্রচুর ঠান্ডা ও কুয়াশার কারণে তা রোপণ করতে পারছেন না। এদিকে বীজতলাও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে প্লাস্টিক দিয়ে বীজতলা ঢেকে রেখেছেন। কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক বিপ্লব কুমার মোহন্ত বলেন, জেলায় সাড়ে ছয় হাজার হেক্টর জমিতে বীজতলা রয়েছে। ঘন কুয়াশা ও তীব্র ঠান্ডায় কৃষকদের বোরো আবাদে বিলম্বিত হচ্ছে।

এ বিষয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. বেলাল হোসেন বলেন, তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশা চলমান থাকলে শীতকালীন শাকসবজি ও রোরো ধানের বীজতলা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে বোরো ধানের চারার জন্য বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। অতিরিক্ত ঠান্ডায় চারা অনেক সময় ঝলসে মরে যায়। তাই চারা রাতে পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা এবং দিনে পলিথিন সরিয়ে রাখতে হবে। তিনি বলেন, তীব্র শীত ও কুয়াশায় বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি, আলু, টমেটো, বেগুন নষ্ট হতে পারে।

তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, দেশে তীব্র শীত ও কুয়াশায় ফসলের যাতে কোনো ধরনের ক্ষতি না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা হচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রতিটি জেলায় মাঠ কর্মকর্তারা কৃষকদের সহযোগিতা শুরু করেছেন। ফসলের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে ফসল রক্ষার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের আওতাধীন কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. মো. শাহ কামাল খান জানিয়েছেন, ফসল রক্ষায় অধিদফতর থেকে বেশ কিছু জরুরি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে কুয়াশা ও শীতের এ অবস্থায় বোরো ধানের বীজতলায় ৩-৫ সেন্টিমিটার পানি ধরে রাখতে হবে, ঠান্ডার প্রকোপ থেকে রক্ষা এবং চারার স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য বীজতলা রাতে স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা এবং বীজতলা থেকে পানি সকালে বের করে দিয়ে আবার নতুন পানি দিতে হবে। প্রতিদিন সকালে চারার ওপর জমা হওয়া শিশির ঝরিয়ে না দিলে আবহাওয়ার বর্তমান পরিস্থিতিতে আলুর নাবিধসা রোগের আক্রমণ হতে পারে। এটি প্রতিরোধের জন্য অনুমোদিত মাত্রায় ম্যানকোজেব গোত্রের ছত্রাকনাশক ৭-১০ দিন পরপর স্প্রে করতে বলা হয়েছে। তিনি জানান, তীব্র শীত ও কুয়াশার কারণে সরিষায় অলটারনারিয়া ব্লাইট রোগ দেখা দিতে পারে। এ রোগ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনুমোদিত মাত্রায় ইপ্রোডিয়ন গোত্রের ছত্রাকনাশক ১০-১২ দিন পরপর ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে। ঠান্ডাজনিত ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষার জন্য ফল গাছে নিয়মিত হালকা সেচ দেওয়ার পাশাপাশি কচি ফল গাছ ঠান্ডা হাওয়া থেকে রক্ষার জন্য খড় বা পলিথিন শিট দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। এ ছাড়া গম ক্ষেতে সেচ দেওয়া থেকে বিরত থাকা এবং জমিতে যেন পানি জমে না থাকে সেদিকে লক্ষ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইংয়ের অতিরিক্ত পরিচালক মো. ছাইফুল আলম বলেন, শীতের তীব্রতা আরও দুই সপ্তাহ থাকলে ঝুঁকি বেড়ে যাবে। এ কারণে ঠান্ডাজনিত সমস্যাটা মাথায় রেখেই মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। 

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন সাদুল্লাপুর (গাইবান্ধা) প্রতিনিধি শামীম সরদার ও দৌলতপুর (কুষ্টিয়া) প্রতিনিধি মো. জিয়াউর রহমান)।

সময়ের আলো/জেডআই




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close