আজ ঘড়ির কাঁটায় রাত ১২টা ১ মিনিট বাজার সঙ্গে সঙ্গে ‘থার্টিফার্স্ট নাইট’ উদযাপন শুরু হবে রাজধানীসহ সারা দেশে। অন্ধকার আকাশকে আলোকিত করতে উড়বে লাখ লাখ ফানুস। বিশেষ করে রাজধানীজুড়ে থাকবে ফানুস ওড়ানো, আতশবাজি ও পটকাবাজির উৎসব। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ উৎসব উদযাপনের পাশাপাশি রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ফানুসের আগুনে জ্বলতে পারে অনেক বাড়িঘর। যেমনটি হয়েছিল গত বছরের ‘থার্টিফার্স্ট নাইটে’। থার্টিফার্স্ট নাইটে রাজধানীসহ সারা দেশে দুই শতাধিক স্থানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ফানুষের আগুনে বাড়িঘর পুড়ে কনকনে শীতে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়েছে অনেকে। মুহুর্মুহু আতশবাজির শব্দে কেঁপে উঠছিল চার মাস বয়সি শিশু উমায়ের। পরদিন পহেলা জানুয়ারি হাসপাতালে ভর্তির কয়েক ঘণ্টা বাদেই মারা যায় ছোট্ট শিশু উমায়ের। গত থার্টিফার্স্ট নাইটে অতিষ্ঠ হয়ে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল করেছেন ২০০ জন। এর মধ্যে রাজধানী থেকেই ফোন করে অভিযোগ করেছেন ৬১ জন। থার্টিফার্স্টে আতশবাজি ফোটানো ও ফানুস ওড়ানো বন্ধ চেয়ে চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান কায়েস একটি রিট দায়ের করেন। রিটে নববর্ষ বা উৎসবে শহর এলাকায় ফানুস ওড়ানো পুরোপুরি নিষিদ্ধ চাওয়া হয়। সেই সঙ্গে থার্টিফার্স্টে আতশবাজির আতঙ্কে মারা যাওয়া শিশু উমায়েরের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশনাও চাওয়া হয়েছে।
তবে ২৮ জানুয়ারি ওই রিট খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। শুনানি শেষে এ আদেশ দেন বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান এবং বিচারপতি মাহমুদ হাসান তালুকদারের ডিভিশন বেঞ্চ।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও পরিবেশবিদসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আতশবাজি ও পটকাবাজি এখন উৎসবের বদলে আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠছে। নববর্ষ উদযাপনে আগেই এসব বিপজ্জনক পটকাবাজি নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে নগরবাসীর আতঙ্ক কমবে।
এদিকে আতশবাজি, পটকাবাজি এবং ফানুস ওড়ানোর বিরুদ্ধে রাজধানীজুড়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। আজ থেকেই কঠোর অবস্থানে থাকবে আইনশঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে আতশবাজি ও ফানুস ওড়ানো বন্ধে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। আর ফায়ার সার্ভিস বলছে, এবার বর্ষবরণে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে গাড়িসহ তাদের কর্মীরা অবস্থান নেবেন, যাতে অগ্নিকাণ্ডসহ যেকোনো অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি হলে তারা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারেন।
গতকাল শুক্রবার পুরান ঢাকার শাঁখারী বাজার, চকবাজার ও মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, উৎসবের আগেই যেন এক মিলনমেলা শুরু হয়েছে ফানুস ক্রেতা-বিক্রেতাদের। সবাই ব্যস্ত ফানুস বেচাকেনা নিয়ে। ছোট ছোট দোকানগুলোও সেজেছে নানা ধরনের ও রঙের ফানুসে। দোকানগুলোতে প্রকাশ্যে ফানুস বিক্রি করলেও আতশ ও পটকা বিক্রি করছে আড়ালে। এরই মধ্যে বিভিন্ন দোকানে ফানুসের মজুদ বাড়ানো হয়েছে। প্রকারভেদে পাইকারি দোকানগুলোতে দেখা গেছে, একেকটি ফানুসের মূল্য রাখা হচ্ছে ২২ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত। অনেকে আগামই তা কিনে নিয়ে যাচ্ছে।
মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের এক দোকানি জানান, নতুন বছর উদযাপনে প্রতি বছরই মানুষ ফানুস কিনে থাকে। আগে থেকে দোকানে থাকা ফানুস তিনি বিক্রি করছেন। নতুন করে আরও ১ হাজার ফানুস অর্ডার করেছেন। কোথা থেকে এসব ফানুস আসে জানতে চাইলে এই ব্যবসায়ী বলেন, কেরানীগঞ্জ বা চকবাজারে এগুলো পাইকারি বিক্রি হয়। সেখানে গিয়ে অর্ডার দিলে তারাই দোকানে দিয়ে যায়। এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তায় ফেরি করে ফানুস বিক্রি করতে দেখা গেছে। চলতি পথে অনেকে তা কিনছেও।
চকবাজারে ফানুসের পাইকারি ব্যবসায়ী আলামিন জানান, গত বছরের তুলনায় এবার ফানুসের চাহিদা বেশি। এক সপ্তাহ আগে থেকেই ফানুস কিনে নিয়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানের ক্রেতারা। তিনি বলেন, এবার কয়েক হাজার ফানুস বিক্রি করেছেন তিনি। আরেক দোকানদার মাসুম বলেন, আমরা পটকা বিক্রি করছি না এবার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আমাদের আগে থেকেই সতর্ক করে গেছে। তবুও অনেকে চড়া মূল্যে গোপনে পটকা, আতশ বিক্রি করছে। তিনি বলেন, আমরা ফানুস বিক্রি করেই সন্তুষ্ট। এই ফানুস বিক্রেতা আরও বলেন, আজ খুচরা কাস্টমারের চাপ যাবে বেশি। তাই স্টকে ফানুস রাখা হয়েছে পর্যাপ্ত।
সাগর বিশ্বাস নামে এক ক্রেতা মাসুমের দোকান থেকে ২৭ টাকা দরে ১০০টি ফানুস কিনে নেন। এত ফানুস কেন কিনলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা খুচরা বিক্রেতা। আগাম কিছু ফানুস কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম, সেগুলো বিক্রি প্রায় শেষ। ২৭ টাকা করে কিনে ৪০ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত একটি ফানুস বিক্রি করেন বলে জানান মাসুম।
ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের সিনিয়র স্টাফ অফিসার মো. শাহজাহান শিকদার বলেন, ফানুসের আগুনে গত বছর অনেক জায়গায় অগ্নিকাণ্ড ঘটে, যা অতীতের চেয়ে বেশি। তবে বর্ষবরণে ফানুস বন্ধে আমরা কোনো নির্দেশনা দিতে পারি না, কারণ সেই ক্ষমতা আমাদের নেই। এটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেখবে। আমরা যতটা পারছি এটাকে নিরুৎসাহিত করছি। তবে এবার গুরুত্ব বিবেচনা করে আমাদের গাড়ি ও ফায়ার ফাইটার বাইরে রাখব, যাতে আগুন বা যেকোনো দুর্ঘটনার খবরে দ্রুত ঘটনাস্থলে যেতে পারি।
ফায়ার সার্ভিস সূত্র বলছে, ফানুসের আগুন জীবন্ত। এ আগুনটা নিয়ন্ত্রণে থাকে না। ফলে এ আগুন যেকোনো ধরনের বড় বিপদের কারণ হতে পারে।
এবার ফানুস ওড়ানো বন্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা রাখা হবে জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক গত বৃহস্পতিবার সময়ের আলোকে বলেন, ‘এ বছর কোনোভাবেই রাজধানীতে ফানুস ওড়াতে দেওয়া হবে না। ফানুস ওড়ানো নিষেধ। এ ক্ষেত্রে আমরা কঠোর অবস্থানে থাকব। কেউ ফানুস ওড়াতে চাইলে রাজধানীর বাইরে ওড়াক।’
বিস্ফোরক পরিদফতরের প্রধান পরিদর্শক মো. নায়েব আলী সময়ের আলোকে বলেন, আতশবাজি ও ফানুস সম্পূর্ণ অবৈধ জিনিস। এটি বিভিন্ন সময় কালোবাজারির মাধ্যমে সংগ্রহ করে বিক্রি করা হয়। কারণ কোনো বিস্ফোরকই সরকারি অনুমোদন ছাড়া কেউ ব্যবহার করতে পারে না। আমরা যেসব বিস্ফোরকের অনুমোদন দিয়ে থাকি সেটি হলো মাইনিং সেক্টরের সরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন- পেট্রোবাংলা, বাপেক্স, বড়পুকুরিয়া, মধ্যপুকুরিয়া ও ইন্টারন্যাশনাল তেল কোম্পানি।
পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ফজলে রেজা সুমন সময়ের আলোকে বলেন, রাজধানী ঢাকা একটি ঘনবসতি এলাকা। এখানে এভাবে আগুন নিয়ে খেলা কোনোভাবেই কাম্য নয়। গত বছর রাতের ফানুসের মাধ্যমে অনেক জায়গায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। যেমন : বাসার ছাদে, বেলকুনির কাপড়ে, বৈদ্যুতিক তার ইত্যাদি জায়গায় আগুন লেগেছে। এর চেয়েও কিন্তু বড় ঘটনা ঘটতে পারত। কারণ আমাদের বস্তি ও বাড়িগুলো দাহ্যপদার্থ দিয়ে তৈরি করা। তিনি আরও বলেন, ফানুসের আগুন অনেকক্ষণ জ্বলে থাকে। কারণ ভেতরে যে মোমের মধ্যে ফ্যালিমিং থাকে সেটা আসলে অনেকক্ষণ জ্বলে। তাই এ জিনিসগুলো বন্ধ করা দরকার।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনে (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান সময়ের আলোকে বলেন, আতশবাজি ও পটকাবাজি পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ফানুসের আলোগুলো পাখিদের জন্য বিপজ্জনক। পাখিরা যখন রাতে ঘুমায়, তখনই ফানুসের আগুন বাড়িঘরসহ গাছ-গাছালিতেও পড়ে। এতে পাখিদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। তিনি আরও বলেন, আতশবাজি-পটকাবাজির শব্দে অনেক চড়ুইপাখির মৃত্যু হয়েছে। পাশাপাশি মৃত্যু হয়েছে কীটপতঙ্গেরও।