ই-পেপার বুধবার ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪
বুধবার ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪
ই-পেপার

বুধবার ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪

ফিরে দেখা ২০২২ : ইউক্রেন এবং অন্যান্য গল্প
প্রকাশ: শনিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২, ৯:৪০ এএম আপডেট: ০১.০১.২০২৩ ৬:২৪ এএম  (ভিজিট : ৫২১)
২০২২-এর শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা। পৃথিবী বইছে ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষত। ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেশী দেশটির ওপর রাশিয়ার আক্রমণের মাধ্যমে এই যুদ্ধের সূচনা। ১০ মাস পেরিয়ে গেছে, এখনও যুদ্ধ শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। মারা গেছে হাজারো মানুষ- উভয় পক্ষের সৈন্য আর ইউক্রেনের সাধারণ জনতা। বিশাল সংখ্যক মানুষ আহত। উভয় পক্ষের যুদ্ধবন্দিদের সইতে হয়েছে নির্মম অত্যাচার।

সীমাহীন মৃত্যু আর দুর্ভোগের পাশাপাশি ধসে পড়েছে সামরিক-বেসামরিক সব অবকাঠামো। ইউক্রেনের একটি নিউক্লিয়ার স্থাপনা যুদ্ধের কবলে পড়ায় বেড়ে গেছে নিউক্লিয়ার অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কা। যোদ্ধারা নিজেরাই নিউক্লিয়ার অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দেওয়ায় পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সত্যি বলতে ১৯৯১ সালে শীতল যুদ্ধের পরিসমাপ্তির পর পৃথিবী কখনো এমন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়ায়নি।

ইউক্রেন যুদ্ধ অস্ত্রব্যবসায়ীদের কপাল খুলে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রগুলো কোটি কোটি ডলারের অস্ত্র পাঠাচ্ছে ইউক্রেনে। অনেক অপরীক্ষিত অস্ত্রের কার্যকারিতার পরীক্ষাও হয়ে যাচ্ছে এই সুযোগে।

রাশিয়াকে শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের রাশিয়ার ওপর চাপিয়ে দেওয়া নিষেধাজ্ঞার ফলে বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই ক্ষতির মূল শিকার হয়েছে বিশ্বের দক্ষিণাঞ্চলের দরিদ্র দেশগুলো। এই যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিনিয়োগ প্রবাহ কমে আসায় স্থবির হয়ে পড়েছে অর্থনীতি। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বহু দূরের দেশগুলোতেও কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও নিয়োগের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

দীর্ঘস্থায়ী ও সাম্প্রতিক উভয় ধরনের রাজনৈতিক সংকটই এই যুদ্ধের দ্বারা উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত হয়েছে। কাশ্মির এখনও দখলের অধীনে রয়েছে এবং স্থানীয় জনতা এখনও প্রতিরোধ অব্যাহত রেখেছে, তবুও পরাশক্তিদের যুদ্ধের তোড়ে সংবাদমাধ্যমগুলো এখন আর তাদের দিকে নজর রাখতে পারছে না। একইভাবে ইসরাইলের কঠোর আগ্রাসনে ফিলিস্তিন প্রতিদিনই আগুনে পুড়ছে। কিন্তু বিশ্ব ইউক্রেনকে নিয়েই ব্যস্ত। কারণ ইউক্রেনই এখন বিশ্বব্যাপী আধিপত্যের লড়াইয়ের রঙ্গমঞ্চ।

আমি আমার এই লেখায় ২০২২-এর আরও তিনটি বড় ঘটনার ওপর আলোকপাত করতে চাই, যেসব বিষয়ে জনগণের আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত। প্রথমটি হলো ওয়াশিংটনের অভিজাতদের সমর্থন পাওয়া সামরিক বাহিনীর একটি অংশের হাতে গত এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর পাকিস্তানে সৃষ্টি হওয়া গণঅভ্যুত্থান। পাকিস্তানের মানুষ জানে, বেইজিং ও মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করে দেশের জন্য একটি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি তৈরি করতে চাওয়াতেই ইমরানকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন অভিজাতরা এমন নীতির বিরুদ্ধে, কারণ তারা মনে করে এর ফলে পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ বাধাগ্রস্ত হবে। এপ্রিল থেকে যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে এবং ইমরানের পক্ষে প্রতিবাদ করতে রাজপথে নেমে এসেছে পাকিস্তানের হাজারো মানুষ। গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার এমন অভিব্যক্তি পৃথিবীর আর কোথাও সচরাচর দেখা যায় না।

জুলাইয়ের উপনির্বাচনে ইমরানের দল পিটিআইয়ের বিপুল বিজয় জনতার এই আন্দোলনকে আরও সুসংহত করেছে। ইমরান এবং তার দল অবিলম্বে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছেন, যাতে জনগণ নিজেদের মনমতো পাকিস্তানের শাসক বেছে নিতে পারে। পূর্ব ও পশ্চিমের কিছু সংবাদমাধ্যমে এই গণজাগরণের কিছু খবর আসলেও এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য প্রাপ্য মনোযোগ পায়নি, কারণটা সহজেই অনুমেয়। বিশ্বের ওপর ছড়ি ঘোরানোর স্বপ্নদ্রষ্টাদের অন্যতম অস্ত্র ক্ষমতার পরিবর্তনের রাজনীতির দিকে প্রত্যক্ষ চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে এই গণঅভ্যুত্থান। মার্কিন শাসকগোষ্ঠীর নেতৃত্বে বিশ্ব-আধিপত্যের প্রবক্তাদের জন্য পাকিস্তানি জনতার সাহস ও সংকল্প দুঃস্বপ্ন হয়ে এসেছে। 

এবার পাকিস্তানের প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তানের দিকে নজর দেওয়া যাক। ২০ বছরের মার্কিন দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে তালেবান যখন কাবুলের ক্ষমতায় ফিরে আসে, পরাজিত মার্কিন শাসকগোষ্ঠী তখন দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাখা আফগান জনগণের সম্পদ হিমায়িত করে প্রতিশোধ নেয়। এ বছরের সেপ্টেম্বরে তারা ৭০০ কোটি ডলার অর্থমূল্যের এই সম্পদ একটি তথাকথিত স্বাধীন প্যানেলের কর্তৃত্বে রাখে, যার ওপর তালেবান বা আফগান জনগণের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বাস্তবে মার্কিন সরকারই এখনও সিদ্ধান্ত নেবে, কখন এই অর্থ সচল করা হবে এবং কী উদ্দেশ্যে এর ব্যবহার হবে।

এ এক ভয়াবহ অন্যায়। কাবুলে নিযুক্ত জাতিসংঘের কর্মকর্তারাও এই পদক্ষেপের সমালোচনা করেছেন। তারা মনে করেন, ক্ষুধা ও অপুষ্টির শিকার লাখো আফগানের আহার জোগানোর জন্য অবিলম্বে এই অর্থের একাংশ ব্যবহার করা উচিত। দেশটির কিছু অংশে দুর্ভিক্ষ শুরু হওয়ার আশঙ্কার কথা শোনা যাচ্ছে। নিজেদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়া এবং এই অঞ্চলে বৃহত্তর আধিপত্যবাদী এজেন্ডা পূরণ করার জন্য এভাবে আফগানদের অর্থ আটকে রাখা অত্যন্ত অনৈতিক।

এবার ২০২২-এর তৃতীয় ঘটনার দিকে ফেরা যাক, যেদিকে আমাদের অনেক বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত। পূর্ব আফ্রিকা দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত, যার মধ্যে রয়েছে সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, কেনিয়া এবং দক্ষিণ সুদান। অক্সফামের জরিপ অনুসারে এই অঞ্চলে প্রবল ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের কারণে প্রতি ৩৬ সেকেন্ডে একজনের মৃত্যু হচ্ছে। পূর্ব আফ্রিকাজুড়ে ৬০ লাখ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে।

এই দুর্দশার কারণ বহুবিধ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট খরা নিঃসন্দেহে একটি বড় কারণ, সেই সঙ্গে স্থানীয় সংঘাতও দায়ী। বিগত বছরে বিভিন্ন কারণে খাবারের দাম অনেক বেড়ে গেছে, ইউক্রেন যুদ্ধ যার মধ্যে অন্যতম।
২০২২ সালে আরও কিছু বড় ঘটনা ঘটেছে, মূলধারার সংবাদমাধ্যম যেগুলোকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়নি। জলবায়ু সংকট তার মধ্যে অন্যতম। এই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের হিমশীতল তুষারঝড় অনেকের কাছেই বিস্ময় হয়ে এসেছে। আরেকটি জলবায়ু বিপর্যয়ের দিকেও মূলধারার সংবাদমাধ্যমের মনোযোগ দেওয়া উচিত ছিল জুন থেকে অক্টোবরে পাকিস্তানে সংঘটিত ভয়াবহ যে বন্যায় দেশটির এক-তৃতীয়াংশ পানির নিচে তলিয়ে গেছে।

মূলধারার সংবাদমাধ্যম এখনও কোভিড-১৯ এর দিকে যথাযথ মনোযোগ দিয়ে যাচ্ছে, যদিও ২০২২ সালে এর প্রকোপ অনেক কম ছিল। বৈশ্বিক উত্তর ও দক্ষিণের মানুষ এমন এক রোগ নিয়ে উদ্বিগ্ন, যার উৎস নিয়ে এখনও রহস্য রয়ে গেছে। জনমনে প্রশ্ন, ভূরাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াইয়ের সূচনায় এই মহামারি কি কোনোভাবে সংযুক্ত?

২০২২ সালের ঘটনাগুলোর দিকে ফিরে তাকালে তাদের দুই শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। এক, যেগুলো ইউক্রেন যুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত, দুই, যুদ্ধের কারণে যেসব সমস্যা চাপা পড়ে গেছে, কিন্তু বৃহত্তর স্বার্থে যাদের সমাধান অত্যন্ত জরুরি। এই দুই শ্রেণির বাইরেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু মোটাদাগে দেখলে ইউক্রেনই ছিল ২০২২ সালে মানবতার উদ্বেগের কেন্দ্রবিন্দু। পৃথিবী বুঝতে পারছে, এই যুদ্ধের অবসান ঘটানো, এই দ্বন্দ্বের কূটনৈতিক সমাধান বের করা কতটা জরুরি।

সেদিকে পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। সংঘাতের শুরুর দিকে পোপ ফ্রান্সিস মধ্যস্থতার চেষ্টা করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে জি২০-এর সভাপতি হিসেবে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। তিনি উভয় পক্ষের রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এবং বৈশ্বিক দক্ষিণের ওপর এই যুদ্ধের বিরূপ প্রভাবের কথা জানিয়ে যুদ্ধ বন্ধ করার অনুরোধ করেছেন। বিভিন্ন মহলের আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এসব শান্তি উদ্যোগ কোনো ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করতে পারেনি। ইউক্রেন যুদ্ধ অব্যাহত থাকার অনেক রকম কারণ রয়েছে। কিন্তু খলনায়কদের গোঁ ধরে থাকাটাই শান্তির পথে সবচেয়ে বড় বাধা।

রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমিরি পুতিন কাছে ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যোগদান থেকে বিরত রাখা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ইউক্রেনের যোগদানের ফলে ন্যাটো রাশিয়ার দোরগোড়ায় চলে আসবে এবং রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। 

কিন্তু পশ্চিমা ও ন্যাটোর সামরিক সাহায্যের ফলে ইউক্রেন যুদ্ধ জটিল হয়ে পড়ায় পুতিন এখন তার প্রতিবেশী দেশটিকে পুরোপুরি ধ্বংস করার নেশায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছেন।

একইভাবে, যুদ্ধের শুরুর দিকে ইউক্রেন এবং তার সমর্থকদের উদ্বেগের বিষয় ছিল শুধু ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন। কিন্তু ইউক্রেন যখন রাশিয়ার আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তুলে দাঁড়ায়, তখন ইউক্রেনের সমর্থকেরা মনে করে তারা রাশিয়াকে পরাজিত করতে পারবে, এই সুযোগে রাশিয়ার সামরিক শক্তিকে একেবারে গুঁড়িয়ে দেওয়া যাবে।

দুপক্ষের এই চরমপন্থি অবস্থান কেবল অবাস্তবই নয়, বরং বিপজ্জনক। ইউক্রেন মানচিত্র থেকে মুছে যাবে না, রাশিয়াকেও গুঁড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। যুদ্ধ যতই দীর্ঘায়িত হবে, ইউক্রেনিয়ান এবং রাশিয়ানরা তত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং তাদের সঙ্গে ইউরোপিয়ানরাও। শীত ক্রমেই বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে জ্বালানি-সংকটের আশঙ্কা। দিনে দিনে জনজীবন আরও বেশি দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।

উভয় পক্ষেরই ছাড় দেওয়ার এবং আপস করার সময় এসেছে। চরমপন্থি অবস্থান থেকে সরে এসে দুদলেরই আলোচনার মাধ্যমে দ্বন্দ্বের মীমাংসা করা দরকার। বিশ্বের, বিশেষ করে সুশীল সমাজের উচিত দ্বন্দ্বরত দলগুলোর কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া। এই যুদ্ধে কারও পক্ষেই নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন সম্ভব নয়। তাই শান্তি প্রতিষ্ঠার এখনই সময়।

চন্দ্র মুজাফফর একজন মালয়েশিয়ান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং ইসলাম সংস্কারপন্থি। এশিয়া টাইমসে প্রকাশিত এ লেখাটি সময়ের আলোর জন্য অনুবাদ করেছেন রূপম আদিত্য




সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close