প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২১, ৮:০৩ পিএম (ভিজিট : ১৪৭৬)
সামাজিক অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ যুবকদের মাদকে আসক্তি। বর্তমানে এ সমস্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে বিশ্বব্যাপী, বাংলাদেশেও রয়েছে এর ব্যাপক বিস্তার। তরুণরা মাদকে আকৃষ্ট হয়, অসামাজিক কাজে লিপ্ত হচ্ছে। বিনষ্ট হচ্ছে অসংখ্য পরিবারের স্বপ্ন এবং সামাজিক শৃঙ্খলতা। মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা এবং জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া এর অন্যতম কারণ। পাশাপাশি পরিবারের নজরদারি ও সুশিক্ষার অভাবে সন্তানরা সহজেই জড়িয়ে পড়ছে এ ভয়ঙ্কর মরণব্যাধিতে।
কড়া নজরদারি এবং মাদকদ্রব্য নির্মূল কার্যক্রম সম্পূর্ণ বাস্তবায়নের অভাবে সহজেই সরবরাহ হচ্ছে মাদকদ্রব্য। বর্তমানে মাদকাসক্তের সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দেওয়া তথ্য মতে প্রায় ৭৫ লাখের বেশি মানুষ মাদকাসক্ত রয়েছে। এর ৫০ শতাংশই বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী মাদকাসক্তের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগই তরুণ-কিশোর যাদের মধ্যে প্রায় ৪৫ ভাগ বেকার এবং অধিকাংশই শিক্ষার্থী। অবৈধ মাদকদ্রব্য আমদানির জন্য প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। জনশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে হ্রাস পাচ্ছে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন।
পরিবার হচ্ছে সামাজিক জীবনের প্রথম ধাপ। প্রত্যেকটা মানুষই কোনো একটি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। একজন মানুষ তার ভালো-মন্দ, সামাজিকতা, আচার-আচরণ ইত্যাদির প্রাথমিক শিক্ষাটা পায় পরিবার থেকে। এ ক্ষেত্রে পরিবার থেকে সে কী শিখছে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এরপর শুরু হয় শিক্ষা জীবন। মাদকের নেশার শুরু হয় মূলত বন্ধুবান্ধব থেকে। প্রথম পর্যায়ে এর তীব্রতা কম হলেও একপর্যায়ে ধারণ করে ভয়াবহতা। ধূমপান বা তামাকজাত পণ্য থেকে শুরু করে ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী মাদকে আকৃষ্ট হয় যেখান থেকে ফিরে আসা অত্যন্ত কঠিন। তাই ছোট থেকেই সন্তানদের সুপরামর্শ দিয়ে সচেতন করতে হবে। সন্তান কাদের সঙ্গে মেলামেশা করছে সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। খারাপ সঙ্গ দেখতে পেলে দ্রুত সরিয়ে আনতে হবে। পারিবারিক অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা থেকেও সন্তানদের মনমানসিকতা বিকশিত হতে পারে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে এবং পড়াশোনার প্রতি আকৃষ্ট করাতে হবে। দিতে হবে খেলাধুলার সুযোগ।
সন্তানদের মাঝে ভিন্ন আচরণ দেখা দিলে সে বিষয়ে পরামর্শ করতে হবে। সন্তান যেন মানসিক বিষণ্নতা কিংবা একাকিত্বে না ভোগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সন্তানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে সহজ এবং স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ। পরিবারের অনেক বড় সদস্যরা ছোটদের সামনে ধূমপান করে থাকেন যা তাদের আকৃষ্ট করতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মাদকাসক্তের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে সতর্ক করতে হবে। যেসব অনুষ্ঠানে মাদক সেবন খুবই স্বাভাবিক সেসব অনুষ্ঠান থেকে সন্তানদের দূরে রাখুন। রাতে নিয়মিত বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা থেকে বিরত রাখুন। সন্তানদের ধর্মীয় জ্ঞানের আলোকে সুশিক্ষা দান করুন এবং ধর্ম চর্চায় মনোনিবেশ করতে উৎসাহিত করুন। মূল্যবোধের চর্চাও জরুরি যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। সন্তানদের মোবাইল ফোনে আসক্তি থেকে বিরত রাখতে হবে।
মাদক মৃত্যু আনে। অনেকেই এর পরিণতি সম্পর্কে জেনেও সেবন করে থাকে এবং অন্যকেও প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। মাদকাসক্তের নির্দিষ্ট কোনো বয়স বা গণ্ডি নেই। শহর কিংবা গ্রাম, ছোট কিংবা বড়, যেকোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ এতে আকৃষ্ট হতে পারে যেকোনো সময়। মাদকাসক্ত ব্যক্তি শুধু পরিবারের নয় দেশেরও বোঝা। অনেকেই পরিবার কিংবা ঘর ছাড়া হয়ে অন্ধকার জগতে প্রবেশ করে। অনেক সময় মাদকাসক্ত হয়ে সমাজে নানা প্রকার বিশৃঙ্খলতা ও অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। অন্যের স্বাভাবিক জীবনে অশান্তি তৈরি করে। চুরি, ডাকাতি কিংবা ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধে লিপ্ত হয়। দেশের মূল্যবান সম্পদ এবং অর্থের অপচয় করে। মেধাশক্তিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়। যেখান থেকে সবাই ফিরে আসতে পারে না। সুন্দর স্বাভাবিক জীবনে ক্রমান্বয়ে নেমে আসে ভয়াবহতা।
মাদকাসক্তের বড় একটি শ্রেণি শিক্ষিত তবে অশিক্ষিতের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। মানসিক অবসাদ, বেকারত্ব, পারিবারিক কলহের কারণে মাদকের দিকে ধাবিত হয় সাময়িক প্রশান্তির খোঁজে। পুরুষের পাশাপাশি অনেক নারীও মাদক সেবন এবং সরবরাহের সঙ্গে জড়িত। মাদক সরবরাহকারীরা নারী ও পথশিশুদের ব্যবহার করে মাদকদ্রব্য ছড়িয়ে দেয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে আমাদের দেশে মাদকের উৎপাদন তুলনামূলক কম হলেও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে মাদকের সরবরাহ অনেক। আমাদের দেশে ফেনসিডিল থেকে শুরু করে ইয়াবা, মদ কিংবা এলএসডির মতো ভয়ঙ্কর মাদকদ্রব্যের সরবরাহ রয়েছে। এসব মাদকদ্রব্যের ক্রেতা এবং বিক্রেতার অনেকেই কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও প্রভাবশালী মহলের লোকজন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদক সেবন সমীচীন নয়। তবুও সচেতনতার অভাবে অনেকেই এ কাজ করে থাকে। ধ্বংস করে জাতির সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের একটা অংশ। মাদক সেবনের ফলে শরীর ও স্বাভাবিক মনের ব্যাপক ক্ষতি হয়। নষ্ট হয় সঠিক চিন্তাশক্তি এবং উগ্রতার সৃষ্টি হয়। তরুণ প্রজন্মের অপার সম্ভাবনাময় জীবনে নেমে আসে কালো অন্ধকার। যা দেশের সার্বিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে।
বাংলাদেশে ১৯৭৬ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর প্রতিষ্ঠিত হয়। অবৈধ মাদকদ্রব্যের বিস্তার রোধে এবং সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম পরিচালনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে এ দফতরটি চালু হয়। এরপর থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় মাদক নির্মূল অভিযান কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য ও এর সরবরাহকারীদের আইনের আওতায় আনা হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে আছে বড় একটি অংশ। পাশাপাশি মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে মাদকাসক্তদের জন্য। তাই একদিকে যেমন পরিবারকে পালন করতে হবে মুখ্য ভূমিকা তেমনি সংশ্লিষ্টদেরও অপরিহার্য ভূমিকা পালন করতে হবে। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সচেতনতা ও মাদকের ভয়াবহতা তুলে ধরতে হবে। অবৈধ মাদকদ্রব্যের সরবরাহ বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বদা তৎপর থাকতে হবে। মাদকদ্রব্য দ্রব্য উৎপাদনে নিরুৎসাহিত করতে হবে।
মাদকদ্রব্যের ব্যাপ্তি কমাতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরকে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। ব্যক্তি পর্যায়েও সবাইকে সচেতন থাকতে হবে এবং অন্যদের এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। তবেই দেশের যুবসমাজ রক্ষা হবে এবং সার্বিক উন্নয়নের অগ্রগতি হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়