স্বাধীন বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে যখন দেখি আমরা ইতোমধ্যেই পেরিয়ে এসেছি দীর্ঘ ৫০ বছর তখন গর্বে বুক ভরে যায়। সেই একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে আমরা আমাদের দেশকে স্বাধীন করেছি। পালন করেছি বিজয় উৎসব। সেই বিজয় উৎসবের এবারে ৫০ বছর পূর্তি হলো। পালন করলাম স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও এর সঙ্গে জাতির পিতা, স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’। আমাদের সেই ৯ মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোয় ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে’র কর্মী ও শিল্পীদের অনুপ্রেরণাও কম ছিল না। তারাও ছিলেন যুদ্ধজয়ের দিনগুলোতে ‘মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের’ অদম্য সাহসী সৈনিক। তাদের কথাও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা সংগ্রামে এক অনন্যসাধারণ ভূমিকা রেখেছিল এই বেতার কেন্দ্রটি। আর সেজন্যই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে বলা হতো ‘মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট’।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন রণাঙ্গনে দিনরাত এক করে দিনের পর দিন নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে যে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিল তাদের সেই বীরত্বগাথা আর বিভিন্ন রণাঙ্গনে হানাদার সেনাদের গেরিলা অপারেশনে পর্যুদস্ত হওয়ার খবরাখবর সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে দেশের ভেতরে এবং বহির্বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।
এই গুরুদায়িত্ব স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দেশপ্রেমিক কর্মী, কলাকুশলী এবং শিল্পীরা শত দুঃখ-কষ্ট, সমস্যা-সঙ্কট আর দুঃসহ অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে থেকেও হাসিমুখে পালন করে গেছেন। যদিও তাদের সেই দুঃখ-কষ্ট আর পরিশ্রমের শেষ অবধি ‘শব্দসৈনিক’ হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি মিলেছে দেশ স্বাধীন হওয়ার দীর্ঘ ৪৫ বছর পরে বর্তমান সরকারের আমলে।
যদিও স্বাধীনতার পরে আমাদের অনেক শিল্পী ও কলাকুশলী আর জীবিত নেই। তারা তাদের মৃত্যুর আগে স্বীকৃতির সান্ত্বনাটুকুও পাননি। তাদের অমলিন স্মৃতিটুকুই শুধু বাংলার মানুষের হৃদয়ে রয়ে গেছে যেমন মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের বীরত্বগাথা অতি শ্রদ্ধার সঙ্গে ভাস্বর হয়ে আছে প্রতিটি বাঙালির মনের মধ্যে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্ম হয়েছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সময়কালে রেডিও পাকিস্তান চট্টগ্রাম কেন্দ্রের কয়েকজন কর্মকর্তা ও কলাকুশলীর দুঃসাহসিক উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে। সূচনা হয়েছিল একাত্তরের ২৬ মার্চ। সেই বিদ্রোহী বেতার কর্মীদের নেতৃত্বে ছিলেন- বয়োজ্যেষ্ঠ সংস্কৃতিমনা বেতার কর্মী বেলাল মোহাম্মদ এবং তার সহযোগী আব্দুল্লাহ আল-ফারুক, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, সৈয়দ আব্দুস শাকের, মোস্তফা আনোয়ার, রাশেদুল হোসেন, রেজাউল করিম চৌধুরী, আমিনুর রহমান, শরফুজ্জামান, ও হাবিবুর রহমান মনিরের দেশপ্রেমে। প্রাথমিক পর্যায়ে কালুরঘাটের ট্রান্সমিটার ভবন থেকে শুরু হয় এর কার্যক্রম ও নাম দেওয়া হয় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র।
এখান থেকেই মূলত মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার ঘোষণা প্রচার করা হয়। তবে শুরু হওয়ার কিছুদিন পরে এই নামটি বদলে দেওয়া হয় ‘বিপ্লবী’ শব্দটি বাদ দিয়ে নতুন নামকরণ করা হয় ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। পরবর্তী পর্যায়ে একাত্তরের ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার বৈদ্যনাথতলায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ার পরে ভারত সরকারের সাহায্য সহযোগিতায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নতুন করে স্থাপিত হয় দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের একটি দোতলা বাড়িতে।
তখন আগরতলা থেকে কলকাতায় চলে যান শহিদুল ইসলাম, তাহের সুলতান, আশফাকুর রহমান খানসহ আরও কয়েকজন। তাদের কাছেই দেওয়া হয় সেখান থেকে হাজার অনুষ্ঠানে সম্প্রচারের দায়িত্ব ও তত্ত্বাবধানে থাকে প্রবাসী সরকার। নির্ধারিত হলো ২৫ মে, নজরুল জয়ন্তীর দিন থেকে অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু হবে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ সূচনা সঙ্গীতসহ শুরু হলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ৫০ কিলোওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন মিডিয়াম ওয়েভ ট্রান্সমিশন।
কেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্বভার দেওয়া হয় টাঙ্গাইলের তৎকালীন এমএনএ আব্দুল মান্নানকে। অন্যদের মধ্যে কামাল লোহানী দায়িত্ব পান বার্তা বিভাগের, বেলাল মোহাম্মদ এবং আশফাকুর রহমান খান অনুষ্ঠান এবং সৈয়দ হাসান ইমাম নাটকের ও পরে ইংরেজি অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য পাওয়া গেল চলচ্চিত্র নির্মাতা আলমগীর কবিরকে। তাকেই দায়িত্ব দেওয়া হলো ইংরেজি বিভাগের ওপরে সেখানে যোগ দিয়েছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও অভিনেতা আলী যাকের।
শুরুতে সালেহ আহমদ নামে বাংলা খবর পাঠ করেছিলেন সৈয়দ হাসান ইমাম, ইংরেজি খবর আবু নঈম নামে কামাল লোহানী। পরে সংবাদ পাঠক হিসেবে আসেন বাবুল আখতার, আলি রেজা চৌধুরী, নুরুল ইসলাম সরকার ও ইংরেজি সংবাদ পাঠ করতেন আব্দুল্লাহ আল-ফারুক। পরে যোগ দেন আলমগীর কবির, আলী যাকের, পারভিন হোসেন, নাসরিন আহমেদসহ আরও দুয়েক জন।
এক সময় উর্দু ভাষা জানা ময়মনসিংহের জাহিদ সিদ্দিকী নামের একজনকে উর্দু বিভাগের প্রধান করে উর্দু জীবন্তিকা প্রচার করা শুরু করা হয়। প্রচারণামূলক এসব জীবন্তিকা প্রধানত প্রচার করা হতো উর্দুভাষী পাকিস্তানি সেনাদের মনোবল দুর্বল করে দেওয়ার জন্য। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বেশিরভাগ অনুষ্ঠানই ছিল অনেকটা মনস্তাত্ত্বিক প্রচারণা, যার মাধ্যমে চেষ্টা থাকত দেশের ভেতরের মুক্তিকামী বন্দিপ্রায় অসহায় মানুষগুলোর মানসিক শক্তিকে উজ্জীবিত করা। অন্যদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মনোবল বিপর্যস্ত করে বিপথে চালিত করা এবং মানসিকভাবে হীনবল করে ফেলা।
এর পাশাপাশি ছিল চেনা-অচেনা শিল্পীদের স্বাধীনতার গান, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল গীতি ও দেশাত্মবোধক গান। আরও প্রচারিত হতো এম আর আখতার মুকুলের কণ্ঠে সেই অতি জনপ্রিয় ‘চরমপত্র’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠান এবং ‘বজ্রকণ্ঠ’ শিরোনামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাত মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণভিত্তিক একটি অনুষ্ঠান, যা ধর্ম বর্ণ ও দলমত নির্বিশেষে সব মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষাকে প্রবল করে তুলত। জুলাইয়ের প্রথম দিকে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। তার মধ্যেই ওপরের নির্দেশ অনুযায়ী স্থানীয় রাজাকার বাহিনী আমাকে ধরার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার খবর পেলাম। বুঝলাম গ্রামের বাড়িতে আমার থাকার দিন ফুরিয়েছে।
শেষ পর্যন্ত পরিবারের সবাইকে নিয়ে তিন দিন পরে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া থেকে রেয়াজউদ্দিনের নৌকার বহরে সুন্দরবনের গহীন বনাঞ্চলের ভেতর দিয়ে দিন পাঁচেক পরে পৌঁছালাম গিয়ে মাতলা নদীতীরে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন অঞ্চলের মৎস্য বন্দর ঝড়খালি। সেখান থেকে দুদিন পরে ক্যানিং হয়ে চলে গেলাম নৈহাটিতে, আমার বোনের বাড়িতে।
সপ্তাহখানেক পরে শিয়ালদহর কাছে শ্রীনিকেতন হোটেলে গেলে দু-তিনজন নেতার সঙ্গে দেখা হলো। তাদের একজনের কাছ থেকে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খোঁজটা পেয়ে গেলাম। দুদিন পরে একদিন সকালের দিকে চলে গেলাম বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে। বড় রাস্তার পাশে ট্রাম থেকে নেমে কোয়ালিটি রেস্টরেন্টের উল্টো দিকের রাস্তা ধরে বেশ কিছুটা হেঁটে আসার পরে ডান পাশে চোখে পড়ল গাছপালায় ঘেরা বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের বাড়ি। সে বাড়ি ছাড়িয়ে আরও কিছুটা সামনে গিয়েই পেয়ে গেলাম সেই দোতলা বাড়িটা। তার উল্টো দিকে রাস্তার ওপারে একটা অতি সাধারণ চায়ের দোকান। তার সামনে দেখলাম চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে পুরনো দিনের সাংবাদিক বন্ধু আমিনুল হক বাদশা, আশরাফুল আলম আর ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বন্ধু সুব্রত বড়ুয়া।
ওদের সঙ্গে দেখা হবার পর বেশ কিছুটা সময় কাটানো হলো ওদের সঙ্গে। খবরা-খবর নেওয়া হলো। সবার অবস্থাই প্রায় একরকম। উদ্বাস্তু হয়েই এ দেশে এসেছে সবাই আমাদের মতো। কিছু সময় পরে ওরাই আমাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। ভেতরে গিয়ে দেখি অতি সাধারণভাবে কাজকর্ম চলছে। টেবিল চেয়ারের সংখ্যা কম। একটা রুমের ভেতরে ভারী পর্দা টানিয়ে অনুষ্ঠান রেকর্ডিংয়ের কাজ চলছে ওপরে। একপাশে দেখলাম গানের রিহার্সাল চলছে। সেখানে হারমোনিয়াম ছাড়া তেমন কোনো বাদ্যযন্ত্র দেখলাম না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই চেনা পেয়ে গেলাম অনেককে পেলাম। সে সময়ের বিখ্যাত গিটারিস্ট সমর দাস, অভিনেতা সৈয়দ হাসান ইমাম, শহিদুল ইসলাম, অনু ইসলাম, টিএইচ সিকদারসহ আরও অনেককে। ঘণ্টাখানেক পরে দেখা হলো আমার অসীম শ্রদ্ধার মানুষ আলমগীর কবির ভাইয়ের সঙ্গে। রাঙামাটিতে জন্ম হলেও বরিশালের মানুষ কবির ভাইয়ের সঙ্গে আমার চেনা-জানা ছিল বেশ আগে থেকেই। ষাটের দশকের প্রথমদিকে আমি যখন জগন্নাথ কলেজে পড়ি তখন পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও অক্সফোর্ড বিশ^বিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং,সাংবাদিকতা এবং চলচ্চিত্রের ওপরে ডিগ্রি নিয়ে ঢাকায় ফিরেছেন। অসাধারণ মেধাবী কবির ভাই প্রথমে কিছুদিন সাংবাদিকতা তারপর পুরোপুরি চলচ্চিত্র নির্মাণে মনোযোগী হলেন।
কোথাও মন বসেনি অনন্য সাধারণ এই গুণী মানুষটির একমাত্র সিনেমা ছাড়া। আমাকে দেখে তো অবাক। বসিয়ে আমাদের সবার খবরা-খবর নেওয়ার পরে বললেন, বাংলা কবিতা আর কথিকা লেখ, ঠিক আছে। তবে এখন থেকে এখানকার জন্য কিছু ইংরেজিতে লিখতে হবে। আমার সঙ্গে সময় দিতে হবে। পারবে না?
বললাম, অবশ্যই পারব। সেই থেকে শুরু। কয়েকদিন পর থেকে অসম্ভব ব্যস্ত হয়ে গেলাম। নৈহাটি ছেড়ে চলে গেলাম হাবরায় বীরেন নামে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে। কারণ প্রতিদিন কিছু না কিছু লেখার জন্য বন্ধুটি আমাকে যেমন উৎসাহ দিত তেমনি তার সঙ্গে তাড়াও। নৈহাটিতে বোনের বাসায় সবার সঙ্গে থেকে মনোযোগ আর সময় নিয়ে লেখার কাজ ঠিকভাবে করতে পারতাম না। এরপরে আমরা যতদিন ছিলাম প্রতিদিন সকাল ১০টা-১১টার দিকে চলে যেতাম বেতার কেন্দ্রে, ফিরতাম শেষ বিকালে।
এভাবেই চলছিল দিনের পর দিন । মাঝে মাঝে খুব অসহায় লাগত। সবকিছু কেন জানি এলোমেলো মনে হতো। বারবার ফেলে আসা বাড়িঘর আর অসহায় নিখোঁজ আত্মীয়স্বজনদের কথা মনে পড়ত। দেশের বিভিন্ন স্থানের খবরা-খবর প্রায় প্রতিদিনই পেতাম রণাঙ্গনের বিভিন্ন সূত্র থেকে। সেসব খবর আমরা প্রচার করতাম বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। সেসব খবর অন্যদের মতো আমার মনের মধ্যেও কখনও কখনও আশা জাগাতো, হয়তো একদিন স্বাধীন হবে দেশ। আমরাও আমাদের ফেলে আসা বাড়িঘরে ফিরে যেতে পারব । এসব স্বপ্ন আর সান্ত্বনা নিয়ে দিনের পর দিন যাতায়াত করেছি বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের সেই দোতলা ভবনটিতে। একবার রেডক্রসের কাছ থেকে ২০০ টাকা পেয়েছিলাম। তার থেকে ১০০ টাকা দিয়ে কলেজ স্ট্রিটের একটা শালের দোকান থেকে একখানা উলেন চাদর কিনেছিলাম। সেই চাদরখানা আমার কাছে এখনও আছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে যত্ন করে রেখে দিয়েছি।
একদিন কবির ভাই বললেন, ঠিক আছে, এসব নিয়ে যদি লিখতে চাও তাহলে পাকিস্তানের বর্তমান রাষ্ট্রীয় কাঠামো আর সামরিক জান্তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে ভালো করে খোঁজখবর নাও। বিদেশি মিডিয়ার খবর শোনো আর যতটা পার পত্র-পত্রিকা দেখে নাও। সেই অনুসারে আমি দুই-তিন দিন ধরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় পাকিস্তান সম্পর্কে যেসব খবর বেরিয়েছে সব পড়ে ফেললাম, পাশাপাশি বিবিসিসহ অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের খবরও শুনে নিলাম। পরের দুই দিন বসে শুধু লিখলাম। এভাবেই সেই সময় তৈরি হয়েছিল তিন পর্বের ‘দ্য ডাইং পাপেট স্টেট’ শিরোনামের কথিকাটি। কথিকাটি প্রচার করে আমার মতো কবির ভাইও খুশি হয়েছিলেন।
বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলায় কথিকা পাঠের জন্য পাওয়া যেত কুড়ি টাকা এবং ইংরেজির জন্য তিরিশ টাকা। যদিও তখন সে টাকা অনেক বলে মনে হতো। কলকাতার অন্যান্য পত্রপত্রিকায় মাঝে মাঝে লেখালেখি করেও কিছু পাওয়া যেত। কখনও কখনও কোনো সংস্থা কিছু আর্থিক সাহায্য করত। এসব মিলিয়ে কোনোরকমে চলে যেত।
দেখতে দেখতে চলে এলো ডিসেম্বর মাস। চারদিকে নানা ধরনের খবরা-খবর ও গুজব। তার মধ্যেও ‘দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে’ এরকম একটা প্রচারণা ধীরে ধীরে চারদিকে বেশ জোরদার হয়ে উঠছিল। রণাঙ্গনের খবর যা পাচ্ছিলাম তাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে যাওয়ার খবরসহ তাদের ক্রমশ পিছু হটার খবরও পাচ্ছিলাম। সেই সঙ্গে তাদের অত্যাচার নির্যাতনের খবরও আসছিল। পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম তাদের দিন শেষ হয়ে এসেছে। তাদের আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।
তারপরে একসময় পেলাম বিজয় বার্তা। সেই সময় আমাদের স্বাধীনতার সূচনা লগ্নে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে একটি বিশেষ সংবাদ বুলেটিন যথেষ্ট তাড়াহুড়োর মধ্যে প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেটি লিখে তখন প্রচার করেছিলেন কামাল লোহানী। তার পরপরই প্রচারিত হয়েছিল একটি অবিস্মরণীয় গান ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’। গানটি লিখেছিল শহিদুল ইসলাম ও সুর দিয়েছিলেন সুজেয় শ্যাম। গানটি সেদিন কোরাস কণ্ঠে প্রচারিত হয়েছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী অজিত রায়ের নেতৃত্বে।
লেখক: শব্দসৈনিক ও কথাসাহিত্যিক