সারাটি বছরই তো শহীদ হওয়ার বছর ১৯৭১ সাল। বিশেষ করে ২৫ মার্চের রাত্রি থেকে। সমাপ্তি ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে এসে। বলা চলে আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বরের পর নতুন সরকার গুছিয়ে ওঠা এবং মুক্তিযোদ্ধারা দেশে ফিরে সংগঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন আরও বেশ কিছু শহীদ হয়েছেন। মোট শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখ যা তৎকালীন সময়ে সাত কোটি জনসংখ্যার ছোট্ট এই দেশটিতে এক বিশাল জনসংখ্যা। এর মধ্যে বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা কতজন তা জাতীয়ভাবে আজও নির্ধারিত হয়নি। এই নিবন্ধের শিরোনামে দুজন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম উল্লেখ করেছি। আজ তাদের নিয়েই, খণ্ডিত হলেও, লিখব বলে স্থির করেছি। এতে অবশ্য এ কথা মনে করার কারণ নেই যে অন্যান্য শহীদ বুদ্ধিজীবীকে আমি অবহেলা করলাম বা তাদের প্রতি আমার অশ্রদ্ধা প্রকাশ করলাম। প্রতিবছর আমি আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ শহীদ অধ্যাপক আনোয়ার পাশার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে লিখে থাকি কিন্তু এবার যুক্ত করলাম পাবনার সন্তান খ্যাতনামা চিকিৎসক ডা. ফজলে রাব্বীর নামটাও যা এই লেখার শুরুতেই উল্লেখ করব। পরের অংশে লিখব অধ্যাপক আনোয়ার পাশা সম্পর্কে।
পাবনা শহরের অদূরে একটি নিভৃত গ্রামে ডা. ফজলে রাব্বীর পৈতৃক ভিটা আজও আছে- সম্পূর্ণ অরক্ষিত এবং অযত্নে-অবহেলায় পড়ে আছে। তার পরিবারের কেউই সেখানে থাকেন না ডা. রাব্বীর আমল থেকেই। তাই গুটিকয়েক বাদে বাদ-বাকি পাবনাবাসীও তাকে যেন ভুলতে বসেছে। তার নামে একটি ফাউন্ডেশন আছে ঢাকায়। একবার তাদের সঙ্গে ইমেইলে যোগাযোগ হয়েছিল অনেকদিন আগে। প্রথমত পাবনার উৎসাহীদের সমন্বয়ে ওই ফাউন্ডেশন পুনর্গঠিত করে হেড অফিসটা পাবনাতে স্থানান্তরিত করে সবাই মিলে ডা. রাব্বীকে স্মরণীয় করে রাখার ব্যাপারে কী কী করা সম্ভব তা আলোচনা করে স্থির করা হোক- এমন প্রস্তাব দিয়েছিলাম। তারা বেশ মনোযোগ দিয়েই কথাগুলো শুনেছিলেন বলে মনে হয়েছিল কিন্তু হ্যাঁ-না কিছুই স্পষ্ট করে বলেননি। পরবর্তী সময়ে প্রস্তাবগুলো নিয়ে তারা কী স্থির করলেন তাও আর জানাননি। আর যোগাযোগও নেই তাদের সঙ্গে।
বছর কয়েক আগে তিন চারজন বন্ধু মিলে ডা. রাব্বীর পরিত্যক্ত ভিটা তাদের গ্রামে দেখতে গিয়েছিলাম। মনটা বিষাদে ভরে গিয়েছিল দেখে এবং জেনে। গ্রামবাসীরা বললেন- আমরা তাকে খুব কমই দেখার সুযোগ পেয়েছি তিনি ছাত্রাবস্থা থেকে বরাবই ঢাকায় থাকার কারণে এবং আমাদের বয়স কম হওয়ায়। তবে শুনতাম যে তিনি ছিলেন খুবই বড় মাপের একজন ডাক্তার এবং পাকিস্তান বাহিনী ও রাজাকার আলবদরেরা তাকে মেরে ফেলেছে। এ কথা ভাবলে কষ্ট পাই মনে। ডা. রাব্বীর স্মৃতিতে কিছু করার কথা আপনারা কি ভাবছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বললেন, আমরা ক্ষুদ্র কৃষক। মন থাকলেও সাধ্য তো নেই। তবে আমরা যা পারি তা করেছি। গ্রামে তার নামে একটি প্রাইমারি স্কুল গড়ে তুলেছি। গ্রামের ছেলেমেয়েরা পড়ে সেখানে। মনটা শ্রদ্ধায় ভরে উঠল গ্রামবাসীদের কথাটি শুনে। সেদিন চোখে পড়েছিল- ডা. ফজলে রাব্বীর বাড়ি বা গ্রাম পর্যন্ত ভালো কোনো সংযোগ সড়কও নেই। ইতোমধ্যে হয়েছে কিনা জানা নেই।
আমি ডা. রাব্বীর নামে কিছু একটা পাবনাতে করা সরকারের করণীয় বলে মনে করি। তাই কয়েকবার পত্রিকায় লিখেছি পাবনায় প্রতিষ্ঠিত (সরকার কর্তৃক) মেডিকেল কলেজটির নামকরণ করা হোক ‘পাবনা শহীদ ডা. ফজলে রাব্বী মেডিকেল কলেজ’। তা যথারীতি ছাপাও হয়েছে কিন্তু আজও কোনো ফলোদয় ঘটেনি। এ বছরের প্রথম দিকে বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম পাবনা মেডিকেল কলেজের একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আসেন। সাংবাদিক হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে অনুষ্ঠানে যাই। খুব চমৎকার শামিয়ানা-মঞ্চ-অতিথিদের বসার আয়োজন করা হয়েছিল। আয়োজকরা অতিথিদের প্রথম সারিতে আমাকে নিয়ে বসালেন। মন্ত্রী এবং অন্যরা কিছু পরে মঞ্চে এলেন। আসন গ্রহণ করলেন। বেশ কিছু পড়ে মন্ত্রীর নজরে পড়ল আমি নিচে বসা। তৎক্ষণাৎ তিনি কলেজের একজনকে পাঠালেন আমাকে মঞ্চে নিয়ে যেতে। আকস্মিকতায় কিছুটা বিব্রতবোধ করলেও গেলাম মন্ত্রীর পাশেই আমাকে চেয়ার দেওয়া হলো। বসলাম।
এক পর্যায়ে পকেট থেকে কাগজ-কলম বের করে লিখলাম এই কলেজটির নাম ‘পাবনা শহীদ ডা. ফজলে রাব্বী কলেজ’ রাখা হোক। দিলাম তার হাতে। তিনি দেখে কিছু বললেন না- তবে কাগজের টুকরাটি পকেটে রাখলেন। বছর তো শেষ হতে চলল আজও কিছু হয়নি। তবে আশা ছাড়িনি। দেখা যাক কী হয়। মন্ত্রী তো বৃহত্তর পাবনা জেলার সন্তান এবং পাবনা শহর তার জন্মস্থান এবং বাল্যের ও যৌবনের কর্মস্থল। তাই আশাবাদটা একটু বেশি। আর সড়ক বিভাগ যদি ডা. ফজলে রাব্বীর বাড়ি পর্যন্ত ভালো সড়ক নির্মাণ করে দেন ওই মানুষ যেমন তাতে উপকৃত হবে তেমনই যারাই ডা. রাব্বীর বাড়ি দেখতে যেতে চাইবেন- তারাও সহজেই যেতে পারবেন। আশা করতে চাই এ কাজটিও অচিরেই হবে।
অধ্যাপক আনোয়ার পাশা পাবনার সন্তান নন ছিলেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক। তিনি মুর্শিদাবাদের সন্তান। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যের স্নাতকোত্তর করে মুর্শিদাবাদ-বহরমপুর কলেজে শিক্ষকতা করছিলেন। বরাবরের ভালো ছাত্র তিনি। পড়েছেনও বহরমপুর কলেজেই। তার আকাক্সক্ষা ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার। হঠাৎ এক দিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক বিজ্ঞাপনে জানতে পারেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে একজন শিক্ষকের পদ খালি হওয়ায় ওই পদে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হবে। প্রার্থীদের যোগ্যতা ও শর্তাবলি বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা ছিল।
তার দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নপূরণের সম্ভাবনা দেখে অত্যন্ত আশাবাদী চিত্তে বিজ্ঞাপনের চাহিদা মোতাবেক কাগজপত্র সংগ্রহ করে দরখাস্ত করলেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে। সময়মতো ইন্টারভিউয়ের কার্ডও পেলেন। গেলেন কলকাতা, ইন্টারভিউ দিয়ে এলেন। ইন্টারভিউ ভালো করেছেন বলে আশাবাদের মাত্রা আরও বেড়ে গেল আনোয়ার পাশার মনে। থাকলেন অপেক্ষায়। কিন্তু অপেক্ষার যেন আর শেষ নেই- শেষ হয় না অপেক্ষার পালা। অবশেষে সংশয়। শেষতক এক দিন ছুটলেন কলকাতায় অনুসন্ধান নিতে। জানলেন ওই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং যাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তিনি যোগদানও করে ফেলেছেন। গেলেন ইন্টারভিউ বোর্ডের তার পরিচিত একজন সদস্যের কাছে বিস্তারিত জানতে। তিনি প্রথমে দুঃখ প্রকাশ করলেন- অতঃপর জানালেন যোগদানকারীর নাম। দেখা গেল ওই যোগদানকারী আনোয়ার পাশারই একজন সাবেক ছাত্র। সাবেক শিক্ষক হিসেবে তিনি এও জাননে তার অভিজ্ঞতা এবং যোগ্যতা তার চাইতে অনেক কম জিজ্ঞেস করলেন ইন্টারভিউ বোর্ডের সদস্যকে কি করে সম্ভব হলো এটা। তিনি বললেন, আপনার সব রেকর্ড তার চাইতে ভালো ইন্টারভিউও সর্বাপেক্ষা ভালো দিয়েছেন। একজন বাদে বোর্ডের সবাই আপনার পক্ষে দৃঢ়মত দিয়েছিলেন কিন্তু বোর্ডের প্রধান সব নাকচ করে ওই প্রার্থীকে মনোনীত ঘোষণা করে নিয়োগ দেন একটি মাত্র কারণে যে ওই প্রার্থীটি হিন্দু ঘরের সন্তান। শুনে মাথায় বাজ পড়ল অধ্যাপক আনোয়ার পাশার। সাম্প্রদায়িকতা? তাও আবার ভারতের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে? নির্বাক হয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে ফিরে এলেন বহরমপুর। বিতৃষ্ণা জাগল মনে। ক্ষোভে, দুঃখে, অপমানে অধ্যাপক আনোয়ার পাশা মারাত্মকভাবে হতোদ্যম হয়ে পড়েন। যে ভারত তার মাতৃভূমি, যে ভারত তার স্বপ্নের ও সাধনার, যে ভারত ধর্মনিরপেক্ষ, যে ভারত গান্ধীজীর, পণ্ডিত নেহরুর, মওলানা আজাদের, যে ভারত অজস্র গৌরবের ইতিহাস রচনাকারী তারই এবং রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ও জীবনানন্দের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুকে সাম্প্রদায়িকতা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না, বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছিল তার। এহেন মানসিক অবস্থা চলাকালে অকস্মাৎ একদিন জানতে পারেন পূর্ব পাকিস্তানের পাবনাতে এডওয়ার্ড কলেজে বাংলা বিভাগের জন্য শিক্ষক নেওয়া হবে। দরখাস্ত করে বসলেন ওই চাকরির জন্য। পেয়েও গেলেন। ছুটে চলে এলেন পাবনায়। যে পাকিস্তান দ্বিজাতি তত্ত্বের, যে পাকিস্তান ইসলামী রাষ্ট্র, সেই পাকিস্তান ছিল তার কাছে ঘৃণার ও অপছন্দের। কিন্তু ওই পরিস্থিতি এড়াতে তিনি সপরিবারে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তান চলে এলেন। রাধানগরে একটি বাসাও ভাড়া নিলেন।
এটা ষাটের দশকের গোড়ার দিককার কথা। আমি তখন এডওয়ার্ড কলেজ থেকে বিএ পাস করে বেরিয়ে এসেছি কয়েক বছর আগেই। পাবনা সদর মহকুমা ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম তখন। কিন্তু আইয়ুবের মার্শাল ল’। রাজনীতি নিষিদ্ধ তাই প্রকাশ্যে কিছু করা সম্ভব ছিল না।
আমাদের নৈমিত্তিক সকাল-সন্ধ্যা আড্ডা ছিল তখনকার ন্যাপ নেতা শহীদ ডা. অমলেন্দু দাক্ষীর চেম্বারে। ডা. দাক্ষী পেশাগত ব্যস্ততা সত্ত্বেও নিজেই ছিলেন এ আড্ডার মধ্যমণি। তিনি তখন পাবনার একমাত্র দন্তচিকিৎসক। বিশাল ফিগার সদা হাসিমুখ। ওখানে শুধু ন্যাপের নেতাদের আড্ডা ছিল তা নয়। আওয়ামী লীগ নেতা শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলীও ফাঁকফোকর পেলেই চলে আসতেন ওই আড্ডায় ভিন্ন স্বাদে কিছু সময় কাটাতে। আসতেন আরও শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মীরাও। বলা চলে, ওটা ছিল পাবনার প্রগতিশীল শক্তির এক চমৎকার মিলনক্ষেত্র। কমিউনিস্ট পার্টিও গোপন যোগাযোগ রক্ষার সুযোগ পেত দিব্যি। অধ্যাপক আনোয়ার পাশা প্রায়ই আসতে শুরু করলেন। তিনি ছিলেন অসাধারণ রবীন্দ্রভক্ত, রবীন্দ্র গবেষকও। রবীন্দ্র জয়ন্তী, রবীন্দ্র প্রয়াণ দিবস, নানাবিধ সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতে ধীরে ধীরে আনোয়ার পাশা হয়ে উঠলেন সবার অন্যতম প্রিয়জন।
এলো ১৯৬২ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচন। এ নির্বাচন আইয়ুব দিতে চাননি। কিন্তু ক্রমবর্ধমান দাবির মুখে নিজ পছন্দমতো একটা সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে এই আয়োজন। সাধারণ ভোটাররা ভোটার নন। উভয় পাকিস্তান মিলে মোট ৮০ হাজার ভোটার। মৌলিক গণতন্ত্রীরাÑ অর্থাৎ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান- মেম্বাররা ভোট দেবেন। পাবনাতে ন্যাপ ও আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় গোপন সিদ্ধান্ত না মেনে ওই নির্বাচনে পৃথক পৃথক প্রার্থী দেয়। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত ছিল নির্বাচন বর্জনের। দাক্ষীর চেম্বার হয়ে দাঁড়াল ন্যাপের এক অঘোষিত বিকল্প অফিস। যা হোক নির্বাচন সমাপ্ত হলো সন্ধ্যার আগেই। নেতারা বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে ফিরে এসে বিশ্রাম নিচ্ছেন- বিনা পয়সার চা উপভোগ করছেন। হঠাৎ জানা গেল দাঙ্গা লেগে গেছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা বস্তুত হিন্দুরা একতরফাভাবে আক্রান্ত। সারা রাত ধরে চলল অগ্নিসংযোগ, খুন, অপহরণ, লুটপাট প্রভৃতি। পাবনার মতো ছোট্ট শহরে ওই রাতে ৩০ জনের অধিক হিন্দু খুন হন হাজার হাজার বাড়ি অগ্নিদগ্ধ লুটপাট সীমাহীন।
এডওয়ার্ড কলেজের হিন্দু ছাত্রাবাসের আবাসিক ছাত্ররা নিরাপত্তাহীনতায় ছুটে যায় অধ্যক্ষের কাছে। তিনি কিছু করতে অপারগতা প্রকাশ করে এসপির কাছে অথবা থানার সহায়তা চাইতে বলে দরজা বন্ধ করে দেন। খবর পেয়ে ছুটে আসেন অধ্যাপক আনোয়ার পাশা। শুনলেন আতঙ্কিত ছাত্রদের কাছে। ডাকলেন নাইট গার্ডকে। বললেন টিচার্স ওয়েটিং রুম খুলে দিতে। ছেলেদের সবাইকে চুপচাপ সেখানে চলে আসতে বললেন। তাদের ঢুকিয়ে দিলেন ওই রুমে। তালাবদ্ধ করলেন। বলে গেলেন চুপচাপ ওই রুমে রাতটা কাটাতে। নাইট গার্ডকে বললেন কদাপি না খুলতে এবং সর্বদা সতর্ক নজর রাখতে।
আনোয়ার পাশা নিজ বাসায় ছুটে গিয়ে স্ত্রীকে জনা ত্রিশেকের জন্য ডাল-ভাত রান্না করতে বলেন। রান্না শেষে ভাত-তরকারি-ডাল, কয়েকটি প্লেট ও কলসিভরা খাবার জল ও গ্লাস রিকশায় সাধ্যমতো লুকিয়ে নিয়ে নিজেই ছুটে এলেন কলেজ ক্যাম্পাসে। রাত তখন ১১টার কম না। সারা শহর জ্বলছে। যেদিকে তাকানো যায় আগুন-ফুলকি আর ধোঁয়া বাতাসে ভেসে আসে মানুষের আর্তচিৎকার। আর আসে দাঙ্গাকারী গুণাপান্ডাদের পাশবিক উল্লাসের আওয়াজ। নৈশপ্রহরীকে বলে টিচার্স কমন রুমের দরজা খুলে খাবার ঢুকিয়ে দিয়ে ছেলেদের বললেন, তোমরা চুপচাপ খেয়ে নাও। দরজা বন্ধ থাকবে সকালে আসব দেখা হবে। নৈশপ্রহরীকে রুমটি আটকাতে বলে আরও কিছু নির্দেশ দিয়ে ফিরে গেলেন। সকালে এলেন আবার দরজা খুলিয়ে সবাইকে হোটেলে ফিরে যেতে বললেন।
এভাবে তিনি সাম্প্রদায়িক শাক্তির আক্রমণের সম্ভাব্য হাত থেকে হিন্দু ছাত্রদেকে রক্ষা করলেন। অথচ তিনি নিজে ভারতের একজন উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তির সাম্প্রদায়িক আচরণের শিকার হয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে দেশত্যাগী হয়ে পাবনা এসে আশ্রয় নিয়েছেন। ছেলেদের কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধায় আপ্লুত হলেও অধ্যাপক আনোয়ার পাশা সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতি ঘৃণায় ও নিন্দায় সরব ছিলেন। কিছুকাল পর অধ্যাপক আনোয়ার পাশা সুযোগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের একটি শিক্ষক পদে। নিয়োগপত্র পেয়েই সেখানে গিয়ে যোগদান করেন। পরিবার-পরিজনকেও নিয়ে যান সেখানে। সম্পর্ক ছিন্ন হয় পাবনার সঙ্গে। কিন্তু পাবনা তাকে বহুদিন মনে রেখেছেন- তিনিও মনে রেখেছেন পাবনাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ধীরে ধীরে তিনি অন্যতম জনপ্রিয় শিক্ষকে পরিণত হন। আর এই জনপ্রিয়তাই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হয়ে পড়ল তার জীবনের প্রতি হুমকি স্বরূপ। ঠিকই তাকে চিহ্নিত করে পাকিস্তানি জানোয়াররা ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে একজন নির্দোষ শিক্ষকেরই নয় একজন মহৎ প্রাণ নিবেদিত প্রকৃত দেশপ্রেমিক মানুষকে। তাই তিনি অমরত্ব লাভ করেছেন মানুষের হৃদয়ে। তাকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
এই সুযোগে আরও শ্রদ্ধা জানিয়ে রাখি পাবনার শহীদ ডা. অমলেন্দু দাক্ষী, মওলানা কছিম উদ্দিন, অ্যাডভোকেট আমিন উদ্দিন, শিবাজীবাবুসহ স্থানীয় শহীদ বুদ্ধিজীবীদেরও।
লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক