ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্মেলন জরুরি
রোহিঙ্গা সংকট ‘একটি তাজা টাইম বোমা’
প্রকাশ: সোমবার, ৭ অক্টোবর, ২০২৪, ৪:৩০ এএম  (ভিজিট : ১৩৮)
দীর্ঘদিন ধরে জিইয়ে থাকা রোহিঙ্গা সংকট এখন একটি তাজা বোমা, যে কোনো সময়েই বিস্ফোরিত হতে পারে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জরুরি ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠানের প্রয়োজন। যেখান থেকে এই সংকট সুরাহার জন্য একটি নীতি বা করণীয় বেরিয়ে আসবে। প্রয়োজন প্রভাবশালী দেশগুলোর পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে চাপে রাখা।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশের পটপরিবর্তনের পর রোহিঙ্গা সংকট ইস্যুতে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের সঙ্গে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনা হয়নি। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সদ্য সমাপ্ত জাতিসংঘ সম্মেলনে এই সংকট সমাধানে তিন দফার প্রস্তাব দিয়েছেন। 
এগুলো হচ্ছে-১) রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘ মহাসচিবকে বৈশ্বিক সম্প্রদায়কে নিয়ে খুব দ্রুত বৈঠকের (কনফারেন্স) আয়োজন করতে হবে। যাতে নতুন করে সৃজনশীল ও কার্যকরি পন্থায় এই সংকটের সমাধান করা যায়। ২) রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের পরিচালনায় চলমান যৌথ সাড়াদান প্রকল্পকে (জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান-জেআরপি) বেগবান করতে হবে। জেআরপিতে প্রয়োজনীয় তহবিল জোগানোর জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা বাড়াতে হবে। ৩) রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে গণহত্যার মতো অপরাধের বিচার ও জবাবদিহিতায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন নিশ্চিত করতে হবে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে চলমান মামলাটি গুরুত্বপূর্ণ। এই মামলা এগিয়ে নিতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমর্থন নিশ্চিত করতে হবে। 

 এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টা গত শুক্রবার মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরে এই ইস্যুতে তাদের সহযোগিতা চেয়ে বলেন, দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত রোহিঙ্গা সংকট ‘একটি তাজা টাইম বোমা’, এটি যে কোনো সময় বিস্ফোরিত হতে পারে। এটি মালয়েশিয়ার জন্যও একটি সমস্যা। সেখানেও অল্পসংখ্যক রোহিঙ্গা রয়েছে। আমাদের এই সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে হবে এবং আমরা আসিয়ান (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট), মালয়েশিয়ার সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে একসঙ্গে কাজ করব। গত ৭ বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বছরে গড়ে ৩২ হাজার শিশু জন্মগ্রহণ করেছে। প্রতিদিন প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। কক্সবাজারে অবস্থিত আশ্রয় শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গা তরুণদের একটি পুরো নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে। এটি ক্ষুব্ধ তরুণদের একটি প্রজন্ম। তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। আমি এই উদ্বেগের কথা মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেছি।

আগের সরকার রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে স্বল্প পরিসরে প্রত্যাবাসনসহ যে সব পলিসি নিয়েছিল, গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশের পটপরিবর্তনের সেসব পলিসিতে আমূল পরিবর্তন আসছে। অন্তর্বর্তী সরকার রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে কার্যকর এবং বাস্তবমুখী পলিসি নিচ্ছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, এই সংকট সমাধানে জাতিসংঘের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠান করা, মিয়ানমার বিশেষ করে রাখাইনে দেশটির যারা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়া এবং বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে বেড়ে ওঠা তরুণ প্রজন্মকে কাজে লাগানো।

মিয়ানমারের একটি সূত্র জানিয়েছে, গত করোনা অতিমারির সময়ের পর মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণ সংঘাত বেড়েছে। রাখাইনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১৭ শিবিরের মধ্যে ১১টি শিবির মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। বাকি ৬ শিবিরও যে কোনো সময় অন্যরা জান্তা সরকারের হাত থেকে নিয়ে নিতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে এই সময়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অসম্ভব। গত ৫ আগস্টের পর এই ইস্যুতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার দুই পক্ষের মধ্যে কোনো আলাপ-আলোচনা হয়নি।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তিনটি প্রস্তাব দিয়েছেন। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠান করা। যা এখনও হয়নি, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্মেলনে মিয়ানমারকেও রাখা যেতে পারে। সর্বশেষ গত শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টা এই ইস্যুতে মালয়েশিয়ার মাধ্যমে আসিয়ানের সহযোগিতা চেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রও জাতিসংঘে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে আসিয়ানের কথা বলেছেন। এই সংকট সমাধানে আসিয়ান তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কেননা মিয়ানমারের ওপর আসিয়ান রাষ্ট্রগুলোর প্রভাব রয়েছে ও মিয়ানমার ওই ফোরামের সদস্য। কাজেই প্রধান উপদেষ্টার বন্ধুত্বের খাতিরে হলেও মালয়েশিয়াকে দিয়ে আসিয়ানকে সংকট সমাধানে কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ উপকৃত হবে। এর আগে ভারত-চীন এই ইস্যুতে অনেক কথা বললেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এ ছাড়া এই সংকট সহজেই মিটবে না, এর জন্য লম্বা সময় প্রয়োজন। তাই তৃতীয় দেশে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ইস্যুতেও মালয়েশিয়াকে কাজে লাগানো যেতে পারে।

আসিফ মুনীর বলেন, বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই নাজুক। এমন পরিস্থিতির উন্নতিতে সেখানে সমন্বিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ করে যে সব বাহিনীর সদস্যদের সরাসরি সংঘর্ষ মোকাবিলার অভিজ্ঞতা রয়েছে সে সব সদস্যদের নিয়ে একটি সমন্বিত বাহিনী গঠন করা যেতে পারে। কেননা সাধারণ বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা যথার্থই বলেছেন যে, রোহিঙ্গা সংকট একটি তাজা বোমা, যে কোনো সময়ে বিস্ফোরিত হতে পারে। রোহিঙ্গা সংকট শুধু বাংলাদেশের জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকি নয়, এই অঞ্চলের জন্যও নিরাপত্তা ঝুঁকি। এই সংকট মেটাতে প্রধান উপদেষ্টা মালয়েশিয়াসহ আন্তর্জাতিক বিশ্বের সহায়তা চেয়েছেন। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আমাদের প্রধান উপদেষ্টার বন্ধু। এখন দুই বন্ধুর চিন্তা থেকে নতুন কোনো পলিসি বের হয় কি না তা জানতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিশ্বের অন্য নোবেলজয়ীরা, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের নেতৃবৃন্দ ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। সেদিক থেকে ভবিষ্যতে এই ইস্যুতে আমরা ইতিবাচক বাস্তবমুখী উদ্যোগ দেখতে পারি।

জানা গেছে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে প্রতি বছর ৩২ হাজার নতুন শিশু জন্ম নিচ্ছে। অতি সম্প্রতি ২০ হাজার নতুন শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত চাপ তৈরি করছে, যা নিরাপত্তা ঝুঁকিরও জন্ম দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) গত জুলাই মাসে জানিয়েছে, বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো গত ২০২২ সালে ৪০ জনেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে হত্যা করেছে এবং ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে এই সংখ্যা ছিল কমপক্ষে ৪৮ জন। গত ৬ ও ৭ জুলাই তিনটি ঘটনায় সাতজন শরণার্থী নিহত হয়েছেন।

কক্সবাজার জেলা পুলিশ ও এপিবিএনের তথ্য বলছে, কক্সবাজারের ৩৩টি রোহিঙ্গা শিবিরে গত সাড়ে পাঁচ বছরে ১৭৬টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন কমিউনিটি নেতা, স্বেচ্ছাসেবক ও সাধারণ রোহিঙ্গা। এর মধ্যে চলতি বছরের সাত মাসে (১২ জুলাই পর্যন্ত) শরণার্থী শিবিরে একাধিক সংঘর্ষ ও বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় ৬০ জন নিহত হন। গত জুলাই মাসের প্রথম ১২ দিনেই ১১টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজি এবং মাদকসহ বিভিন্ন অভিযোগে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ৭৬টি ফৌজদারি মামলা করা হয়। ২০১৮ সালে মামলা হয়েছে ২০৮টি এবং ২০১৯ সালে মামলা হয়েছে ২৬৩টি। চলতি বছরের প্রথম সাত মাসের মধ্যেই রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ১৭৮টি মামলা হয়। 


সময়ের আলো/আরএস/





https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close