ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

ভালো নেই প্রাথমিকের শিক্ষকরা
প্রকাশ: রবিবার, ৬ অক্টোবর, ২০২৪, ২:০৯ এএম আপডেট: ০৬.১০.২০২৪ ২:১৭ এএম  (ভিজিট : ৬৭৩)
শিক্ষা মানুষের মননের বিকাশ এবং সামগ্রিক সক্ষমতায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রপঞ্চ হিসেবে রসদ জোগায়। সমাজে মূর্খতা, অন্যায়, পাপাচার, অস্থিরতা ও অরাজকতা দূরীভূত করে কাঙ্ক্ষিত আলোর সন্ধানে শিক্ষার বিকল্প নেই। আর এ শিক্ষার হাতেখড়ি মায়ের পাঠশালায় শুরু হলেও প্রাথমিকের বেদিতে মূলত বীজ থেকে অঙ্কুর এবং প্রস্ফুটিত হওয়ার সুযোগ পায়।

যে জাতি যত বেশি জ্ঞানে-গরিমায় উন্নত সে জাতি ততই ভদ্র, মার্জিত এবং উন্নত। ফলত সব সমাজ, রাষ্ট্র, দেশ-সর্বাগ্রে শিক্ষার প্রয়োজনীতাকে ধারণ করে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার প্রচেষ্টা চালায়। যেখানে প্রাথমিক শিক্ষায় সবিশেষ মনোযোগ দেওয়ার মাঝেই কাঙ্ক্ষিত আকাঙ্ক্ষা অর্জনের ভিত রচিত হয়। প্রাথমিক শিক্ষক এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে তাচ্ছিল্য, তুচ্ছ, অবহেলা-অনাদর করে আর যাই হোক সুস্থ, স্বাভাবিক, মার্জিত ও কাঙ্ক্ষিত নাগরিক পাওয়া যাবে না। আমাদের দেশে কেন যেন এক অজানা কারণে প্রাথমিকের শিক্ষকরা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার। কেন এমন হবে? যাদের হাতে আগামীর ভিত্তি এবং অগ্রগতির জাদুকাঠি, তাদের সামাজিকভাবে হেয় করে অর্থনৈতিকভাবে কষ্ট দিয়ে কীভাবে সর্বোচ্চ সেবা আশা করতে পারি? অথচ এদিকটায় বেশি মনোযোগী হওয়ার কথা ছিল। তা হলে কি আমরা উল্টোপথে হাঁটছি? এর শেষ কোথায়?  

শিক্ষকতা এক মহান পেশা। যা ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি দ্বারা নানাভাবে প্রমাণিত। কুরআনের প্রথম বক্তব্যই হলো পড়ো। মহানবী (সা.) বলেছেন আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি। তা থেকে এ পেশার শান-মান কিঞ্চিত হলেও অনুমেয়। পৃথিবীর নানা দেশে প্রাথমিকের শিক্ষকরা সম্মানিত এবং বেতনক্রম বেশ উচ্চ। লুক্সেমবার্গ, জার্মানি, সুইজারল্যান্ডসহ বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে প্রাথমিক শিক্ষকতা লোভনীয়, মর্যাদাপূর্ণ এবং অধিক বেতনের। ভার্কি ফাউন্ডেশনের গবেষণায় দেখা যায় চীন, দক্ষিণ কোরিয়া এবং সিঙ্গাপুরেও প্রাথমিকের শিক্ষকদের সম্মানের চোখে দেখা হয়। এসব দেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। সামাজিক পরিমণ্ডলে পরিপূর্ণ বিকাশে প্রাথমিক শিক্ষকদের হাড়ভাঙা খাটুনি কি চাইলেই ভুলে থাকা যায়? এ প্রসঙ্গে কবি ইকবালের বক্তব্য হলো ‘বিদ্যালয়ের শিক্ষক হচ্ছেন মিস্ত্রি, যিনি গঠন করেন মানবাত্মা।’ ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, ন্যায্যতা এবং বৈষম্যহীন সুন্দর মানবিকতা বিনির্মাণে শিক্ষক সমাজ সদা জাগ্রত। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সর্বদাই শিক্ষকের মর্যাদার বিষয়ে সতর্ক থাকতেন। তাই তো তিনি বলেন, যদি তুমি জীবনের সাফল্য অর্জন করে থাক। তা হলে মনে রাখবে তোমার পাশে একজন শিক্ষক ছিল। যে তোমাকে সাহায্য করেছিল। অথচ আজকাল কী দেখি? প্রাথমিক শিক্ষকের ঘামে সৃজিত বড়কর্তারা পিতৃতুল্য শিক্ষকের আকাংখা এবং মর্যাদাকে থোড়াই মূল্যায়ন করে। বড়ই আফসোসের বিষয়। 

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা তাবৎ যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও যা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রজ্ঞাপনের সমপর্যায়ের, তারাই কি না ২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেলে ১৩তম গ্রেডে সুপারিশপ্রাপ্ত। যা সাবেকি আমলের তৃতীয় শ্রেণির সমমান। ভেবেই লজ্জিত এবং বিব্রত হই। যাদের হাত ধরে আমাদের আজকের অবস্থান। এ জন্যই কি দেশ স্বাধীন হয়েছিল? এসব শিক্ষকের মূল বেতন ১১ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাসহ সাকুল্যে ১৯ হাজারের মতো। অথচ সমান যোগ্যতা নিয়ে পিটিআইসংলগ্ন প্রশিক্ষণ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা দশম গ্রেডে। এ কেমন রসিকতা! পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর, উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা, সরকারি মাধ্যমিকের সহকারী শিক্ষক, নার্স, মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দশম গ্রেড কপালে জুটলেও শিক্ষকরা কেন বৈষম্যের বলি? বৈষম্যহীন বাংলাদেশে আমরা আর এমনটা দেখতে চাই না।

প্রাথমিকে কেবল শিক্ষকরা অবহেলিত এবং অনাদরে আলবৎ তা ঠিক নয়। শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারাও একই পদে যুগ অবধি। পদোন্নতি যেন অধরাই থেকে যায়। উপরের পদে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের প্রেষণে আগমন। এসব যেন হরহামেশাই ঘটছে। সর্ববৃহৎ এ খাতকে এভাবে উপেক্ষা করে কি যোগ্য ও সুন্দর আগামীর নাগরিক পাওয়া যাবে? যেখানে দেশে ৬৫ হাজার ৫৬৭টি বিদ্যালয় রয়েছে। আর এসব বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকের সংখ্যা ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৯৮১ জন। যার মাঝে ৩ লাখ ২০ হাজার ৪৭ জন স্নাতক পাস। বৈরী পরিবেশ, বেতনবৈষম্য ও সামাজিক মর্যাদার ঘাটতির মাঝেও এখানে ৩৬ জন শিক্ষক এমফিল পিএইচডি ডিগ্রিধারী। সাম্প্রতিক সময়ের বেশিরভাগ শিক্ষকই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া। অথচ তাদের সঙ্গে এহেন আচরণ! এসব করে কি সর্বোচ্চ প্রাপ্তি আশা করা যায়? 

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সারা দিন শিক্ষকতার পাশাপাশি নানা কাজ করে থাকেন। এমন মানুষরাই দ্রব্যমূল্যের লাগামহীনতার যুগে স্বস্তি এবং মর্যাদা পায় না। যেখানে শিক্ষকরা প্রতিদিন ৬-৭টা ক্লাস করার পাশাপাশি কর্মশালা, মিটিং, উপবৃত্তি, হোম ভিজিট, অনলাইনে ডাটাবেজ হালনাগাদ, শিক্ষার্থীদের প্রোফাইল তৈরি, ভৌত কাঠামো মেরামত, ভোটার তালিকা, শিশু জরিপ, ভিটামিন ও ক্রিমিনাশক ক্যাপসুল খাওয়ানো এবং সময় সময় জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। আমাদের প্রিয় এবং শ্রদ্ধার শিক্ষকরাই কি না নানাভাবে অযত্ন-অবহেলায় দিনযাপন করছেন। লজ্জায় লোম শিহরিত হয়। বেতনের পরিমাণের দিক থেকেও এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে আমাদের অবস্থান ৪৫তম এবং বেতনের মাসিক গড় ১৭০ ডলার। তাদের সংসার, সন্তানসন্ততি আছে, সামাজিকতা তাদেরও করতে হয়। বাসস্থান, চিকিৎসা, খাবার, যাতায়াতের ন্যূনতম আকাক্সক্ষাও তাদের রয়েছে। নীতিনির্ধারক এবং কর্তাব্যক্তিদের চোখে কি এসব দৃশ্যমান হয় না? কর্তারা তো তাদেরই বাই প্রোডাক্ট! কৃতঘ্নতার শেষ কোথায়?  

শিক্ষকের প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রের এহেন আচরণ আমাদের পশ্চাৎমুখীই করবে। তাবৎ মানসিক, সামাজিক, আর্থিক অস্থিরতা এবং মনোবৈকল্যে থেকে সুস্থ স্বাভাবিকভাবে জ্ঞান বিতরণ কীভাবে সম্ভব? অপর্যাপ্ত বেতন কাঠামো তুলনামূলক কম সুযোগ-সুবিধা থাকায় উচ্চ শিক্ষিত এবং মেধাবীদের কাছে এ পেশা আজও আকর্ষণীয় হতে পারেনি। ইদানীংপ্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের মাধ্যমে নন-ক্যাডার হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হলেও ১১তম গ্রেডে যোগদানকে কীভাবে দেখবেন। এসব কি দেখার কেউ নেই? অথচ নন-ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্তরা অন্যত্র দশম গ্রেডে যোগদান করছেন। এসব কেন হচ্ছে? 

শিশুরাই আগামীর ভবিষ্যৎ। বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশে যোগ্য এবং কাঙ্ক্ষিত নাগরিক তৈরিতে প্রাথমিক শিক্ষকদের জুড়ি মেলা ভার। তাদের প্রতি যদি আরেকটু সদয় ও যত্নশীল হই তা হলে এ দেশ সামনে আগানোর রসদ পাবে। জেন-জি এবং জেনারেশন আলফাকে সঠিক পথে পরিচর্যার মূল চালিকাশক্তি হলো প্রাথমিকের শিক্ষকরা। মহৎ মানুষগুলো নীরবে-নিবৃত্তে আলোর মশাল নিয়ে রোশনাই বিলাচ্ছে। এ মানুষগুলোর চাওয়া খুবই অল্প। তারা সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে চায়। স্নাতকধারী অন্যান্য পেশার আদলে ন্যূনতম তাদের দশম গ্রেড দেওয়াটা সময়ের দাবি। শিক্ষকের সম্মান ও সামাজিক মর্যাদা যেখানে সারা বিশ্বে অনেক বেশি, নিদেন পক্ষে এ প্রাপ্তিটুকু যদি তাদের ভাগ্যে জোটে, তবেই অনেকটুকু স্বস্তি ফিরে পাবে। শিক্ষকের স্থায়ীকরণ ও পদোন্নতি যদি প্রত্যাশিত সময়ে হয় এবং ভেকেশনাল বিভাগের কালিমা যদি রহিত হয়, বিশ্বাস আর আশা মানসিক, শারীরিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তার ফলে জাতি গঠনে তারা আরও বেশি উচ্ছল এবং প্রাণবন্ত হবে। এসবের হাত ধরে দেশ ও সমাজ এগিয়ে যাবে।



অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় 


সময়ের আলো/আরএস/





https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close