ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

একের পর এক অগ্নিকাণ্ড
অচল হচ্ছে লাইটার ট্যাঙ্কার নাশকতার আশঙ্কা
প্রকাশ: রবিবার, ৬ অক্টোবর, ২০২৪, ১:০৯ এএম  (ভিজিট : ৩৩৪)
চট্টগ্রাম বন্দর বহির্নোঙরে একের পর এক অগিকাণ্ডে অচল হচ্ছে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) লাইটার ট্যাঙ্কার। এমটি বাংলার জ্যোতি অচল হওয়ার পাঁচ দিনের মাথায় অগ্নিকাণ্ডে এমটি বাংলার সৌরভ বিকল হয়ে যায়। অল্প সময়ের ব্যবধানে দুর্ঘটনায় দুটি লাইটার ট্যাঙ্কার বিকল হওয়ায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে শিপিং সেক্টরে।

শনিবার এ ঘটনাকে নাশকতা আশঙ্কা করেছেন খোদ বিএসসির চেয়ারম্যান কমডোর মাহমুদুল মালেক। ঘটনা তদন্তে গঠন করা হয়েছে ৮ সদস্যের কমিটি। দুটি লাইটার ট্যাঙ্কার অচল হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দর বহির্নোঙর থেকে শতকোটি টাকার অপরিশোধিত জ্বালানি তেল (ক্রুড) খালাস কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আসা বৃহদাকার অয়েল ট্যাঙ্কার ‘এমটি ওমেরা লিগেসি’ থেকে ক্রুড খালাস শেষ করা যায়নি। এরই মধ্যে গত শুক্রবার সকাল ৮টা ৪০ মিনিটে কুতুবদিয়ার কাছে গভীর সাগরে ভিড়ে এক লাখ টন ক্রুডবাহী ট্যাঙ্কার ‘এমটি নরবিক কাফটার’। সৌদি আরবের রাস্তানূরা বন্দর থেকে আসা এই বৃহদাকার ট্যাঙ্কারের ক্রুড খালাসে কোনো জাহাজ এই মুহূর্তে নেই বিএসসির কাছে। দুটি বৃহদাকার লাইটার ট্যাঙ্কার থেকে ক্রুড খালাস বিঘ্নিত হওয়ায় অন্তত ১৫০ কোটি টাকার ডেমারেজের (ক্ষতিপূরণ) মুখে পড়েছে বিপিসি।

চট্টগ্রাম বন্দর বহির্নোঙরে শুক্রবার গভীর রাতে লাইটার ট্যাঙ্কার এমটি বাংলার সৌরভে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। প্রায় চার ঘণ্টা চেষ্টার পর শনিবার ভোররাতে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে কোস্ট গার্ড, নৌবাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থার অগ্নিনির্বাপক দল। এ ঘটনার পর ৪৮ নাবিককে উদ্ধার করে কোস্ট গার্ডের টিম। এক নাবিক স্টুয়ার্ড সাদেক মিয়া (৬০) পানিতে লাফ দেওয়ার পর উদ্ধার করা হলেও হাসপাতালে মারা যান। তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তির পর কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

চট্টগ্রাম কোস্ট গার্ড পূর্ব জোনের মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট শাকিব মেহবুব বলেন, এক নাবিককে উদ্ধারের পর চমেকে নেওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। কোস্ট গার্ডসহ বিভিন্ন সংস্থার অগ্নিনির্বাপক টিম বাংলার সৌরভের আগুন নেভানোর কাজ করেছে।

বিএসসি সূত্র জানায়, ১৯৮৭ সালে ডেনমার্কে নির্মিত এমটি বাংলার সৌরভের বয়স ৩৮ বছর পার হতে চলেছে। ট্যাঙ্কারটি স্ক্র্যাপ না করে সচল রাখার কারণে আরও অনেকবার দুর্ঘটনায় পড়েছে। তবে এমটি বাংলার জ্যোতি দুর্ঘটনার পরপরই এমটি বাংলার সৌরভ বিকল হওয়ায় ক্রুড অয়েল খালাস বন্ধ হয়ে গেছে। ২০০৭ সালের জুন মাসেও একবার বিস্ফোরণে বিকল হয়েছিল বাংলার সৌরভ। তখন থেকেই জাহাজটি বহরে না রাখার সুপারিশ ছিল। গত ৩০ সেপ্টেম্বর অগ্নিকাণ্ডে ডলফিন অয়েল জেটিতে বিকল হয় এমটি বাংলার জ্যোতি। এ ঘটনায় তিনজন নিহত হন। জাহাজটিকে বর্তমানে মেরামতের জন্য ডক ইয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

নাশকতার আশঙ্কা : বিএসসির পরপর দুটি অয়েল ট্যাঙ্কারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে নাশকতা সন্দেহ করছেন বিএসসির কর্মকর্তারা। সেই সঙ্গে জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার অপচেষ্টা বলে আশঙ্কা করছে বিএসসি। শনিবার সকালে বিএসসির সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলন করেন সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর মাহমুদুল মালেক। তিনি বলেন, শুক্রবার রাত সাড়ে ১২টায় অয়েল ট্যাঙ্কারে কোনো কাজ ছিল না। কিন্তু জাহাজে চারটি পয়েন্টে আগুন দেখা যায়। কাজ না থাকা অবস্থায় ট্যাঙ্কারের চার পয়েন্টে আগুন লাগায় মনে করছি এটি নাশকতা হতে পারে। তাই আমাদের আশঙ্কা সৌরভে আগুন নাশকতা। তিনি আরও বলেন, কয়েক দিন আগে বাংলার জ্যোতিতে আগুন লেগেছিল। এরপর আগুন লাগল বাংলার সৌরভে। তাই আমরা ধারণা করছি, এ ঘটনা জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকিতে ফেলার অপচেষ্টা। এ ঘটনায় কারা জড়িত তা শনাক্ত করা উচিত। আমরা চেষ্টা করছি ঘটনার কারণ উদঘাটনের।

সৌরভে দুর্ঘটনার আগ মুহূর্তে পরিস্থিতি বর্ণনা করে কমডোর মাহমুদুল মালেক বলেন, বৃহদাকার অয়েল ট্যাঙ্কার এমটি ওমেরা লিগেসি থেকে সৌরভ সবশেষ ক্রুড ভর্তি করে ডলফিন অয়েল জেটির দিকে আসছিল। জেটি খালি থাকলে শনিবার ভেড়ার কথা ছিল। কিন্তু শুক্রবার গভীর রাতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে বাংলার সৌরভে। নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড ও বন্দরের ৭টি টাগ একযোগে কাজ করে। আগুন নেভানোর দেড় ঘণ্টা পর আবার আগুন ধরে যায়। এরপর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।

দুর্ঘটনার সময় বাংলার সৌরভে ১১ হাজার ৫৫ টন ক্রুড ছিল বলে জানিয়ে এমডি বলেন, ট্যাঙ্কারে ৪৮ জন ক্রু ও ওয়াচম্যান ছিলেন। তাদের জীবিত উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে বিএসসির স্টুয়ার্ট সাদেক মিয়াকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান। ঘটনা তদন্তে বিএসসির টেকনিক্যাল ডিরেক্টরকে প্রধান করে আট সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।

ক্রুড খালাস এখনই বন্ধ হচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, বৃহদাকার দুই ট্যাঙ্কার থেকে ক্রুড খালাস করতে ৩০ হাজার টন ধারণক্ষমতার একটি বিদেশি ট্যাঙ্কার ভাড়া করা হয়েছে। আপাতত এই ট্যাঙ্কার দিয়ে খালাস করা হবে ক্রুড। গভীর সাগরের তলদেশের পাইপ লাইন বা এসপিএম চালু হলে ট্যাঙ্কারের মাধ্যমে লাইটারিং বন্ধ করা হবে।

আট সদস্যের তদন্ত কমিটি : এমটি বাংলার সৌরভে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা খতিয়ে দেখতে আট সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিএসসি। শনিবার বিএসসির সচিব আবু সাফায়াৎ মুহাম্মদ শাহেদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে এ তদন্ত কমিটি গঠনের বিষয়টি জানানো হয়। আগামী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা দুর্ঘটনার কারণ, দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ এবং এ ধরনের ঘটনা এড়াতে ভবিষ্যতে করণীয় বিষয় নিয়ে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দেবে। তদন্ত কমিটির সভাপতি বিএসসির নির্বাহী পরিচালক (প্রযুক্তি) ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ ইউসুফ, সদস্য সচিব বিএসসির মহাব্যবস্থাপক (ডিপিএ অ্যান্ড সিএসও) মঈন উদ্দিন আহাম্মদ মজুমদার। কমিটির বাকি ছয় সদস্য হলেন-বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের প্রতিনিধি, ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) প্রতিনিধি, বিএসসি আঞ্চলিক কার্যালয় ঢাকার পরামর্শক (মেরিন সুপার-ডেক), বিএসসির মহাব্যবস্থাপক (মেরিন ওয়ার্কশপ), বিএসসির মহাব্যবস্থাপক (কার্গো সুপারভিশন অ্যান্ড অপারেশন) এবং বিএসসির মহাব্যবস্থাপক (জাহাজ মেরামত)।

অনিশ্চিত দুই ট্যাঙ্কারের শতকোটি টাকার ক্রুড খালাস : ৩০ সেপ্টেম্বর অয়েল ট্যাঙ্কার এমটি বাংলার জ্যোতি বিকল হয়ে যায়। এই লাইটার ট্যাঙ্কারটি বিকল হওয়ার পর একটি মাত্র সচল ট্যাঙ্কার এমটি বাংলার সৌরভের মাধ্যমে বৃহদাকার অয়েল ট্যাঙ্কার থেকে ক্রুড খালাস চলছিল। মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যে শনিবার অগ্নিকাণ্ডে সেই ট্যাঙ্কার বিকল হয়। এখন বৃহদাকার অয়েল ট্যাঙ্কার থেকে ক্রুড খালাস করতে বিএসসির কাছে আর কোনো ট্যাঙ্কার নেই। দুটি অয়েল ট্যাঙ্কারের মধ্যে এমটি ওমেরা লিগেসির ক্রুড খালাস শেষ পর্যায়ে। এটির ক্রুড খালাস শেষ করার আগেই শুক্রবার সকালে সৌদি আরবের রাস্তানূরা বন্দর থেকে বৃহদাকার অয়েল ট্যাঙ্কার আসে কুতুবদিয়ার কাছে গভীর সাগরে। এটির নাম এমটি নরডিক কাফটার। এটিতে প্রায় এক লাখ টন আরব লাইট ক্রুড বা এলএলসি আছে। বৃহদাকার এই ট্যাঙ্কার থেকে কবে ক্রুড খালাস হবে তা নিশ্চিত নয়। তবে বিএসসির এমডি কমডোর মাহমুদুল মালেক শনিবার দাবি করেন, তারা একটি ট্যাঙ্কার ভাড়া করছেন। এই ট্যাঙ্কারের মাধ্যমে ক্রুড খালাস হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএসসির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, দুটি লাইটার ট্যাঙ্কার দুর্ঘটনায় বিকল হওয়ায় নতুন ট্যাঙ্কার ভাড়া করা ছাড়া বিকল্প নেই। চট্টগ্রাম বন্দরে ফার্নেস অয়েল নিয়ে বিদেশ থেকে আসা একটি ক্রুড অয়েলবাহী ট্যাঙ্কার ভাড়া করার চিন্তা করা হচ্ছে। ট্যাঙ্কারটির ফার্নেস অয়েল খালাস শেষ। পানামার পতাকাবাহাী ওই ট্যাঙ্কারের মাধ্যমে ক্রুড খালাস শুরু করা হলেও বিএসসির খুব একটা লাভ হবে না। কারণ এই ট্যাঙ্কার চড়া মূল্যে ভাড়া করতে হবে। অন্যদিকে এমটি বাংলার জ্যোতি ও এমটি বাংলার সৌরভে করে ক্রুড খালাস করা হলে বিএসসির বিপুল আয় হতো। দুটিই বিএসসির নিজস্ব ট্যাঙ্কার। বছরে দুই ট্যাঙ্কারের মাধ্যমে ক্রুড খালাস করে অন্তত ৮০ থেকে ১০০ কোটি টাকা আয় করে বিএসসি।

এদিকে দুই লাইটার অয়েল ট্যাঙ্কার বিকল হওয়ায় বৃহদাকার দুই ট্যাঙ্কারের ক্রুড খালাসে দেরি হচ্ছে। ইতিমধ্যে এমটি ওমেরা লিগেসি ট্যাঙ্কার থেকে ক্রুড খালাসে নির্ধারিত সময় থেকে পাঁচ দিন পেরিয়ে গেছে। এতে প্রতিদিন ১০ হাজার মার্কিন ডলার করে শনিবার পর্যন্ত ৫০ হাজার ডলার ক্ষতির মুখে পড়েছে বিপিসি। বিপিসির পক্ষে বৃহদাকার ট্যাঙ্কার ভাড়া করে বাংলাদেশ বিএসসি। ভাড়া চুক্তি অনুযায়ী ট্যাঙ্কার মালিককে ডেমারেজের অর্থ পরিশোধ করে বিপিসি।


সময়ের আলো/আরএস/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close