আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস। প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন করা হয়। বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের প্রায় ১৭০টি দেশে শিক্ষকদের সম্মানার্থে এই দিবসটি উদযাপন করছে। এদিন বিশ্বব্যাপী শিক্ষকদের নিজস্ব কর্মক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন দিবসে এদিনটি উদযাপন করা হলেও মূলত ৫ অক্টোবর ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব শিক্ষক দিবস। দিবসটি উপলক্ষে প্রতি বছর একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে থাকে, যা জনসচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকতা পেশায় অবদানকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। বাংলাদেশে যেমন মানসম্মত শিক্ষকের সংকট রয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় শিক্ষকেরও সংকট রয়েছে। তথাপি যে সংখ্যক শিক্ষক রয়েছে তাদের সবাইকে অবশ্যই আদর্শ শিক্ষক হয়ে উঠতে হবে।
ইসলাম মানুষকে জ্ঞানের পথে চলতে বলে, জ্ঞানচর্চাকে উৎসাহিত করে। জাহেলি যুগে আরবে শিক্ষিত লোক ছিল মাত্র ১৭ জন। তৎকালীন সমাজ ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়ার এটাও একটা কারণ ছিল। মহান আল্লাহ সে অন্ধকার সমাজে সর্বপ্রথম নির্দেশ দিলেন, ‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে-যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন...। তিনি মানুষকে শিখিয়েছেন, যা সে জানত না।’ (সুরা আলাক, আয়াত : ১-৫)। এ আয়াত থেকেই মুসলিম সমাজে জ্ঞানচর্চা ও তার সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষের মর্যাদা ও অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। ইসলাম শিক্ষকসহ জ্ঞানচর্চা ও প্রসারের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান হতে পারে?’ (সুরা জুমার, আয়াত : ৯)। অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘যাকে জ্ঞান দান করা হয়েছে তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয়েছে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৬৯)
শিক্ষকদের মর্যাদা সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে ছিল ব্যাপক সমাদৃত। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘তোমরা জ্ঞান অর্জন করো এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য আদব-শিষ্টাচার শিখ। তাকে সম্মান করো, যার থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন করো’ (মেশকাত)। সুতরাং যার থেকে জ্ঞান অর্জন করা হয় তিনিই আমাদের শিক্ষক। শিক্ষকের সম্মান করা কর্তব্য।
শিক্ষকের মর্যাদায় ইসলামের বক্তব্য ফুটে ওঠে একটি হাদিস থেকে। একবার হজরত জায়েদ ইবনে সাবিত (রা.) তাঁর সওয়ারিতে ওঠার জন্য রেকাবে পা রাখলেন। তখন ইবনে আব্বাস (রা.) রেকাবটি শক্ত করে ধরেন। হজরত জায়েদ ইবনে সাবিত বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর চাচাতো ভাই! আপনি রেকাব থেকে হাত সরান। উত্তরে ইবনে আব্বাস (রা.) বললেন, ‘না’, আলেম ও বড়দের সঙ্গে এমন সম্মানসূচক আচরণই করতে হয়।’ (মেশকাত)
জ্ঞানই মানুষের যথার্থ শক্তি ও মুক্তির পথনির্দেশ দিতে পারে। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেই বলেছেন, ‘আমাকে শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে বা আমি শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি’ (বুখারি)। প্রিয়নবী (সা.) শিক্ষা, শিক্ষা উপকরণ, শিক্ষক ও শিক্ষার ব্যাপকায়নে সদা সচেষ্ট ছিলেন। তাই তো প্রিয় নবী বদরের যুদ্ধবন্দিদের মুক্তির জন্য মদিনার শিশুদের শিক্ষা দেওয়ার চুক্তি করেছিলেন। যার মাধ্যমে তিনি বন্দিদের মুক্তির ব্যবস্থা করেছিলেন, যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, এক দিন জনৈক বয়স্ক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে হাজির হলে উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম নিজ স্থান থেকে সরে তাকে জায়গা করে দেন। তখন তিনি ইরশাদ করেন, ‘যারা ছোটদের স্নেহ, বড়দের সম্মান করে না, আলেমদের মর্যাদা দেয় না তারা আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (তিরমিজি)
ইসলামের দৃষ্টিতে শিক্ষকতা অতি সম্মানিত ও মহান পেশা। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সামাজিক দায়িত্ব ও মর্যাদার দিক থেকে শিক্ষকতার পেশা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও শিক্ষকতার মতো মহান পেশাকে আমাদের সমাজে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখা হয়। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত ও শারীরিকভাবে নিগৃহীত হতে দেখা যায়। যা অত্যন্ত ঘৃণ্য ও অমানবিক কাজ। আবার অনেক শিক্ষককে দেখা যায়, ‘শিক্ষকতার এ মহান পেশাকে কলঙ্কিত করে নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত কাজে জড়িয়ে পড়ে; এটাও অত্যন্ত ঘৃণিত ও বর্জনীয় কাজ।
পরিশেষে আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কথাই বলি। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক হতে গিয়ে তিনি কত যে লাঞ্ছনা আর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তা তো সবার জানা। কিন্তু পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে মহান আল্লাহর প্রেরিত হুকুম-আহকাম মানুষকে শিক্ষা দিতে কখনো পিছপা হননি। জাগতিক কোনো কিছুর জন্য নয়, বরং মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তিনি আজীবন শিক্ষাদানের কাজটি করে গেছেন। যার ফলে বিশ্ব আজ পেয়েছে শান্তির এক পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান ইসলাম, যা ইহকাল আর পরকালের শান্তি ও কামিয়াবি লাভের উপায়। তাই বিশ্ব শিক্ষক দিবসের অঙ্গীকার হোক; শিক্ষকের প্রতি যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা প্রদান। আসুন প্রিয় নবী (সা.)-এর হাদিসের অনুসরণ করি। শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা দিই। শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষা করে দুনিয়া ও পরকালে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করি। আল্লাহ আমাদের কবুল করুন।
সময়ের আলো/আরএস/