ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

আসাদ চৌধুরী
প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড়
প্রকাশ: শুক্রবার, ৪ অক্টোবর, ২০২৪, ৩:৪৪ এএম  (ভিজিট : ২৪০)
কবি আসাদ চৌধুরী আমাদের কাছে প্রাণবন্ত এক প্রতিকৃতি হয়ে অন্তর্মাধুর্য নিয়ে নিকটবর্তী হয়ে আছেন, কখনো দূরবর্তী থাকবেন না, তিনি তো আমাদের পারিপাশির্^কতায় রয়েছেন সজীব! দূরদেশ কানাডার টরন্টোয় ২০২৩ সালের ৫ অক্টোবর তিনি মারা যান। সেখানকার এক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। তিনি জন্মেছিলেন ১৯৪৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের বাকেরগঞ্জ জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলায়।

কবি আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে সরাসরি বা প্রত্যক্ষ পরিচয় হওয়ার আগেই, তার কবিতার সঙ্গে পাঠক হিসেবে আমার পরিচয় হয়েছিল। তার কবিতা তো বিভিন্ন পত্রিকা ও সাময়িকীতে পড়েছিলাম, তারপর যখন তার প্রথম কবিতার বই ‘তবক দেওয়া পান’ ১৯৭৫ সালে বের হলো, বত্রিশ বছর বয়সে, তা বেশ আলোচিত হয়ে উঠেছিল। এর পর ১৯৭৬ সালে তার আরও দুটি কাব্যগ্রন্থ ‘বিত্ত নাই বেসাত নাই’ ও ‘প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড়’ প্রকাশিত হয়। এই বই তিনটি বের হওয়ার পরপরই- গাইবান্ধার মতো মহুকুমা শহরে এসে পৌঁছেছিল তখন, তা আমরা পাঠ করেছি- সরকারি তথ্যকেন্দ্রে! সে সময় ঢাকা ও দেশের অন্যান্য এলাকার সঙ্গে সড়ক ও প্রযুক্তিনির্ভর যোগাযোগ এখনকার মতো এতটা ছিল না, গণমাধ্যমেরও এত বিকাশ হয়নি, তখন তো এত পত্র-পত্রিকা ছিল না। টিভি বাড়ি বাড়ি ছিল না! তখন রেডিও ছিল গুরুত্বপূর্ণ এক গণমাধ্যম ও জনপ্রিয় মাধ্যম, বাড়ি বাড়ি বিস্তৃত ছিল এর শ্রোতা।  সেই সত্তর দশকে ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে আসাদ চৌধুরীর পরিচালনায় উদীয়মান কবি-লেখকদের জন্য ‘কথাকলি’ নামে একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো এবং তা নতুন কবি-লেখকদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণার আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল। তাতে আমিও কবিতা পাঠিয়েছিলাম, বেশ কবার। তা পঠিত, প্রচারিত ও আলোচিত হয় কবি আসাদ চৌধুরীর কণ্ঠে। এভাবে মফস্বল শহর থেকেও আমাদের মতো নতুন লিখিয়েদের সঙ্গে কবি আসাদ চৌধুরীর নিকটতা গড়ে উঠেছিল, সংযোগ সৃষ্টি হয়েছিল মুগ্ধতা আর সম্মোহনে। এরপর বিভিন্ন ঘটনাস্রোত ও পরিম-লে  সেই সম্পর্ক আমাকে আরও কাছাকাছি নিয়ে যায় তার!

আশির দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘প্রচ্ছদ’ নামের একটি সাহিত্য ও গ্রন্থবিষয়ক একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন আসাদ চৌধুরী। সেই অনুষ্ঠানটি  কবি-লেখক ও সাহিত্য অনুরাগীদের কাছে ভালো লাগা এক অনুষ্ঠান হিসেবে গোচরে এসেছিল। শুধু বিটিভি নয়, পরবর্তী সময়ে আসাদ চৌধুরী অন্যান্য টিভি চ্যানেলেও বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপন করেছেন। আর কোনো কবি তার মতো টিভি চ্যানেলে এত সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য অনুষ্ঠান তার সময়ে উপস্থাপন করেননি, তা হয়ে আছে দৃষ্টান্তমূলক ও তুলনারহিত। আমরা অনেকে বিটিভি ও অন্যান্য চ্যানেলে তার উপস্থাপিত কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে উদ্দীপিত হয়েছি, সান্নিধ্য লাভ করেছি। 

গাইবান্ধার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে সর্ববৃহৎ সাহিত্য সম্মেলন  অনুষ্ঠিত হয় গাইবান্ধা  ১৯৮০ সালে। এসেছিলেন বহু গুণিজন। এসেছিলেন সে সময়ের জনপ্রিয় ও পরিচিত মুখ কবি আসাদ চৌধুরীও। এই সাহিত্য সম্মেলনের অন্যতম সংগঠক হিসেবে সেই সম্মেলনের প্রেক্ষাপটে কবি আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে আরও নিকটবর্তী হওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমারও। সেই সম্মেলনে সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়, বশীর আল হেলাল, আবুল কাশেম চৌধুরী, যতীন সরকার,  নির্মলেন্দু গুণ, সুকুমার বড়–য়াসহ অনেকে এসেছিলেন। 

আসাদ চৌধুরীর প্রথম কবিতার বই ‘তবক দেওয়া পান’; পানের সঙ্গে তার অচ্ছেদ্য সখ্য ছিল আজীবন! পান খাওয়া লাল ঠোঁট নিয়ে হাসিমাখা মুখে জর্দার ঘ্রাণ ছড়িয়ে তিনি প্রাণবন্ত হয়ে থাকতেন, এক ধরনের প্রসন্নতা লেপ্টে থাকত তার অবয়বে। আর এই প্রসন্নতা নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন দেশে-বিদেশে কতখানে! মানুষের উপকণ্ঠে যাওয়ার অভিলাষ নিয়ে সবসময় তিনি চঞ্চল ছিলেন বলেই আমার মনে হয়েছে। ষাট দশকের অন্য আর কোনো কবি এতটা অবারিত হয়ে দিগি^দিক ছুটতে পারেননি! ষাট দশকের কবিদের মধ্যে মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, সমুদ্র গুপ্ত প্রমুখ বিভিন্নখানে বিভিন্ন সময়ে গেছেন, তবে আসাদ চৌধুরীর মতো ততটা নন! ছবিটা ভাসছে- কাঁধে ঝোলা, ঢিলেঢালা শার্ট বা পাঞ্জাবি পরা সহজ-সরল একজন কবিতার পথিক, হাঁটছেন কী-এক প্রেষণায়, কী-এক সংশ্লেষ নিয়ে মানুষের অভিমুখে। তার সঙ্গে আমিও দু’একবার ভ্রমণসাথী হয়েছিলাম, সে-সব স্মৃতিও ভিড় করছে! করোনাকালে যখন আমরা অবরুদ্ধ অনেকটা, তখন তিনি বিদেশে অবস্থান করছিলেন, তখন আমরা অনেকে অনলাইনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে আত্মশক্তি বাড়িয়ে অনেকের নিকটবর্তী হয়ে বেঁচে থাকার উদ্দীপনা খুঁজছিলাম, তখন আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে ক’টি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে তার আন্তরিক সংস্পর্শ অনুভব করেছিলাম। ফেসবুকের কল্যাণে আমার ও পরিবারের কুশলাদিও তিনি জেনেছেন, সেই সময়ে! সে-সব স্মৃতিও মনে পড়ছে আজ! তিনি আমাদের অনেকের প্রতি আন্তরিক ছিলেন, আমার প্রতিও। তাই তো, দু-একটি দ্বন্দ্বমূলক পরিস্থিতিতে কানে কানে বলেছেন, ‘তুমি এত ভদ্র, পারবে না।’ তিনি আমার কবিতার প্রশংসা করেছেন, দু-একজনের কাছে! আমার মুক্তিযুদ্ধের কবিতার পঙ্্ক্তি বলতেন- ‘নয় মাস/কত মাসে তৈরি হয়েছিল?’ ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে আমার একটি ছড়ার বই ‘ঝুমঝুমি’ বের হয়। ছড়ার বইটি বের হওয়ার পর জেনেছিলাম, এই পা-ুলিপিটি মনোনীত করার ক্ষেত্রে কবি আসাদ চৌধুরীর ভূমিকা ছিল। আরও দু-একটি ঘটনা উল্লেখ না করেই বলি- আমাদের তিনি অলক্ষ্যে ইন্দ্রিগোচরে রেখে ভালোবাসতেন বলে মনে হতো, সবসময় নিকটবর্তী না থেকেও তা আমরা অনুভব করতে পারতাম। 

এরশাদবিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে এদেশের মূলধারার অগ্রসরমান কবিরা ঢাকায় ‘জাতীয় কবিতা উৎসব’-এর আয়োজন করেছিলেন। সেই উৎসবকে কেন্দ্র করে জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠন হয় ১৯৮৭ সালে। কবি শামসুর রাহমান হয়েছিলেন প্রথম কমিটির সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন কবি মোহাম্মদ রফিক। এর প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আমিও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হই, সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনসহ বিভিন্ন পদে থেকে ধারাবাহিক ভূমিকা পালন করি ২০০৯ পর্যন্ত। প্রায় ২০ বছরের অধিককাল সংগঠনটির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত থেকে রাজনৈতিক ও সরকার পরিবর্তনের সময়ে-বিভিন্ন দ্বন্দ্ব ও প্রতিকূল পরিস্থিতির  মধ্যে কবিদের ভূমিকা, দায়িত্ব ও বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। কবি আসাদ চৌধুরীকে সে সময় জাতীয় কবিতা পরিষদের অবস্থানে থেকে আরও প্রত্যক্ষভাবে সাংগঠনিক পর্যায়ে দেখার সুযোগ ঘটেছিল। কবি আসাদ চৌধুরী জাতীয় কবিতা পরিষদ ও জাতীয় কবিতা উৎসবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মৃত্যুর আগপর্যন্ত জড়িয়ে ছিলেন, সম্পর্কটা কখনো বিচ্ছিন্ন হয়নি তার! তাকে দেখেছি, জাতীয় কবিতা পরিষদের সাংগঠনিক ও জাতীয় কবিতা উৎসবের প্রেক্ষাপটে, বিভিন্ন দ্বন্দ্ব ও সংকটে মাথা ঠান্ডা রেখে তিনি তার সহ্যশক্তির সম্মোহন দিয়ে একে অপরকে মিলিয়ে দিয়ে ঘটনাপ্রবাহকে বেশিমাত্রায় যন্ত্রণাতুর হতে দেননি, উদ্বেগের পারদকে নামিয়ে ফেলে প্রতিবেশকে করেছেন শান্ত ও প্রসন্ন; তার এমনতরো গ্রহণযোগ্য ভূমিকা আমাদের কখনো কখনো অভিভূত করেছে। 

কবি আসাদ চৌধুরীর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা কম নয়! কাব্যগ্রন্থসমূহ : তবক দেওয়া পান, বিত্ত নাই বেসাত নাই, প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড়, জলের মধ্যে লেখাজোখা, যে পারে পারুক, মধ্যমাঠ থেকে, মেঘের জুলুম পাখির জুলুম, আমার কবিতা, ভালোবাসার কবিতা, প্রেমের কবিতা, দুঃখীরা গল্প করে, নদীও বিবস্ত্র হয়, টান ভালোবাসার কবিতা, বাতাস যেমন পরিচিত, বৃন্তির সংবাদে আমি কেউ নই (১৯৯৮), কবিতা-সমগ্র (২০০২), কিছু ফল আমি নিভিয়ে দিয়েছি, ঘরে ফেরা সোজা নয়। কবিতা ছাড়াও তার শিশুসাহিত্য, জীবনী, ইতিহাস, অনুবাদ ও সম্পাদনা গ্রন্থ রয়েছে। সব মিলিয়ে তার সাহিত্য-রচনা কম নয়, তা উল্লেখযোগ্য ও বিশিষ্ট। চাকরি, আড্ডা, অনুষ্ঠান উপস্থাপনা, ঘোরাঘুরি ও বিবিধ কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার পরও তার সৃজনশীল কর্মকা- কৌতূহলোদ্দীপক ও অভিনব।

আত্মমুখী কবিতার পাটাতনে তিনি টেনে এনেছেন মুক্তিযুদ্ধ, শোষণ-পীড়ন, স্বদেশ ও প্রকৃতির বিভিন্ন অনুষঙ্গ। মুখের ভাষার কাছাকাছি উচ্চারণের আদলে এক ধরনের নিরীক্ষা তার কবিতায় লক্ষ করা যায়।
‘আমার বাবা বাসতো ভালো আমাকে
আমার ময়লা জামাকে, 
শোনো বলি চুপি চুপি
আমার উলের রঙিন টুপি
দিতো মাথায় ফাঁক পেলেই,
হাসতো তখন দাঁত মেলেই।’
 (আমার বাবা, তবক দেয়া পান)

‘যে পারে পারুক, আমি পারব না’ কবিতায় তিনি উচ্চারণ করেন-
‘অভুক্ত শিশুর কান্না, অপুষ্টি অকাল বার্ধক্যে নত
তৃতীয় বিশ্বের ভিক্ষুকের শীর্ণ হাত, আমি যাই! 
রোগীদের সুতীব্র যন্ত্রণা, ক্ষুধা ও অভাব, অপচয়
শরণার্থী শিবিরের ভয়াবহ আর্তনাদ, নির্যাতন-
গুডবাই, গুডবাই!’

কবি আসাদ চৌধুরী মূলত কবি, জনপ্রিয় কবি, কবিতার জগতে অনুধ্যান নিয়ে প্রভাববলয় তৈরি করে এক উজ্জ্বল অবস্থান সৃষ্টি করেছেন। শুধু কবি হিসেবে শুধু নন, আমরা যারা তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছি, ভালোবাসায় ধন্য হয়েছি- তাদের হৃদয়কন্দরেও তিনি উজ্জ্বলভাবে বেঁচে থাকবেন।


সময়ের আলো/আরএস/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close