ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

প্রজন্মান্তর
প্রকাশ: শুক্রবার, ৪ অক্টোবর, ২০২৪, ৩:০৬ এএম আপডেট: ০৫.১০.২০২৪ ৭:৪৩ এএম  (ভিজিট : ১৪৯)
শহরের কোল ঘেঁষে চলে যাওয়া রেলপথটির পাশে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের বাড়ি ‘চন্দ্রানন’। মস্ত উঠোন, বাইরে সিঁড়ি দিয়ে তৈরি একতলা দালান, শান বাঁধানো ঘাটঅলা পুকুর, অসংখ্য গাছগাছালি আর একান্নবর্তী সংসার! 
আমাদের বাড়ির উত্তরে দোফসলি ধানিজমি, তার প্রান্তে কোর্ট স্টেশন; মিনিট তিনেক পশ্চিমে হাঁটলে ঝিনাই নদী; দক্ষিণে একফসলি জমি, বছরের আট-নয় মাসই পানিতে ডুবে থাকে; আর পূর্বে বিজিবি ক্যাম্প, মৃত্তিকা গবেষণা কেন্দ্র, স্টেডিয়াম এবং আবাসিক এলাকা। 
আমাদের বাড়ির নামের সঙ্গে মিলিয়ে গ্রামের নাম হয়েছে ‘চন্দ্রা’। হয়তো কারোর মনে উঁকি দিতে পারে ‘চন্দ্রানন’ এই গ্রামের একমাত্র বাড়ি! সত্যি, একসময় তা-ই ছিল! এখন দক্ষিণ-পশ্চিমে আরও অনেক বাড়িঘর হয়েছে। কাগজে-কলমে ওগুলোও আমাদের গ্রামেরই অন্তর্ভুক্ত। 
দক্ষিণ-পূর্ব থেকে উত্তর-পশ্চিম কোনাকুনি চলে যাওয়া রেলপথটি যেন প্রাচীর! ওপারে শহর, এপারে গ্রাম। এই বাড়িতে বসবাস করে আমরা শহরের গন্ধ মেখে গ্রামীণ প্রশান্তি উপভোগ করি। 
‘চন্দ্রানন’ নামটি একজন কবির দেওয়া। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পরপরই তিনি এই শহরে এসেছিলেন। 
তাদের রাতের খাবারের আয়োজন করেছিলেন আমার প্রপিতামহ, তখনকার ডাকসাইটে উকিল এবং মহকুমার অন্যতম রাজনীতিবিদ। সে-রাতে পূর্ণিমা ছিল। রেললাইন পেরিয়ে আমাদের বাড়ির উঠোনে উঠতে উঠতে তিনি বলেছিলেন, ‘আরে, জোছনায় এই বাড়িকে তো মনে হচ্ছে আমার প্রেয়সীর মতো! আহা, চাঁদের মতো মুখ! এই বাড়ির নাম হওয়া উচিত ‘চন্দ্রানন’।’ 
আর পরদিনই বাড়ির গেটে লিখে ফেলা হয়েছিল নামটি।  
আমি এই বাড়ির চতুর্থ প্রজন্মের অংশ। পঞ্চম প্রজন্মও পা রেখেছে আমার মেয়ের হাত ধরে।
বাড়ির বাইরের উঠোনের কোনায় আমাকে পেয়ে দাদু জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই অবেলায় হাত ধরাধরি করে মেয়ের সঙ্গে কোথায় যাচ্ছিস রে?’ 
বললাম, ‘মা-ছেলে মিলে জীবনের পথ ধরে একটু হেঁটে আসি দাদু।’
‘জীবনের পথ ধরে? কেমনে?’
‘আহা, বুঝলে না! এই যে, বহু বছর ধরে বহু পথ মাড়িয়ে আমরা চলছি, আদতে ওগুলো তো আমাদের জীবনের পথ-ই। তাই না?’ 
‘হ্যাঁ, কথা সত্যি। তবে জীবনের পথ বদলে গেছে খুব! আমরা যে-পথ ধরে চলে এসেছি, তাতে শ্রম ঘাম সংগ্রাম দেশপ্রেম সব ছিল। তোদের প্রজন্মে এসে চাতুর্য সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে! অবশ্য এর বীজ বপন করেছিল তোদের আগের প্রজন্ম!’
আমি কিছু বলার আগেই কোত্থেকে ছুটে এসে আব্বা কথাটির প্রতিবাদ করলেন, ‘আপনার এই শেষ কথাটি আমি মানতে পারলাম না আব্বা! আপনাদের প্রজন্মের সারল্যের পাশাপাশি যে বোকামিটুকু ছিল, আমাদের প্রজন্ম সেটুকু সরিয়ে একটু চালাক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এই প্রজন্ম তো চতুর; এরা খাদ্যে ভেজাল দেয়, নির্মাণে বাঁশ, অযথা টেস্ট দেয়, টুকে করে পাস!’
হঠাৎ হারমোনিয়াম ঢোল বাঁশি বেজে উঠল! আর আমি অবাক হয়ে দেখলাম আমাদের উঠোনটা একটা নাট্যমঞ্চ হয়ে গেছে এবং এখানে আমরা সবাই তুখোড় অভিনেতা! আব্বা বললেন, ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এদের হাতে নিরাপদ নয় জাঁহাপনা! এরা বড্ড চতুর!’
দাদু পা ঠুকে মঞ্চ কাঁপিয়ে বলে উঠল, ‘খামোশ! বীজ বপন হয়েছিল তোদের হাতে, ওটা এখন বৃক্ষে পরিণত হয়েছে! আর তার ফল ভোগ করতে হবে আগামী প্রজন্মকে! অবিচার, এ বড় অবিচার বিধাতা!’ হঠাৎ আমার মেয়েটা শক্ত করে আমার ডানহাত আঁকড়ে ধরে বলল, ‘চলো বাবা, পশ্চিমাকাশে সূর্য এখনো দাঁড়িয়ে। চলো এগোই।’ 
আমি বিস্ফারিত নয়নে দেখলাম, আমার মেয়েটার কাঁধে পুরো বাংলাদেশ! টাল সামলাতে না পেরে ওখান থেকে টুপটাপ ঝরে পড়ছে অমানুষগুলো! আর মানুষের চোখেমুখে স্বস্তি। 
তক্ষুনি দর্শকদের তুমুল করতালি আর হর্ষধ্বনিতে ঘুম ভেঙে গেল আমার! দেখলাম, আমার মেয়েটা খুবই মায়াভরা চোখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কোমল স্বরে ও বলল, ‘বাবা ওঠো। সকাল হয়ে গেছে। আমরা পতাকা হাতে হাঁটতে বের হবো না?’ 
আমি স্বপ্নের আবেশ কাটিয়ে উঠতে পারিনি। তাই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম ওর মুখের দিকে। মনে হলো মাত্র এক রাতে আমার মেয়েটা অনেক বড় হয়ে গেছে। 
আমি নিজের অজান্তেই মাইকের আওয়াজের সঙ্গে আওড়াতে লাগলাম পরবর্তী কথাগুলো। আমার সঙ্গে আমার মেয়েটাও আওড়াচ্ছে, হুবহু।     


  সময়ের আলো/আরএস/





https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close