ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

ইরানকে পালটা জবাবের হুশিঁয়ারি ইসরাইলের
বিধ্বংসী হামলার ছক
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৩ অক্টোবর, ২০২৪, ২:৫১ এএম আপডেট: ০৩.১০.২০২৪ ৭:২৫ এএম  (ভিজিট : ৩৬৩)
বছরের পর বছর ধরে ইরান ও ইসরাইল একে অপরের বিরুদ্ধে নানা ধরনের গোপন তৎপরতা চালিয়ে আসছে। ইসরাইল ইরানকে তাদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি বলে মনে করে। ইরানও মার্কিন মিত্র ইসরাইলকে তাদের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে। এ ছাড়াও ইরানের আঞ্চলিক শক্তি হয়ে ওঠার বিরুদ্ধে ইসরাইলকে তারা একটি বড় বাধা হিসেবেই দেখে। এসবের জেরে মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিন ধরেই ছায়াযুদ্ধ বা প্রক্সি ওয়ারে জড়িত দেশ দুটি। সেই যুদ্ধ এবার রূপ নিয়েছে সরাসরি হামলায়।

ইরানের হামলার পর একদিকে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন ‘ইরানকে মূল্য দিতে হবে’। অন্যদিকে ইসরাইল যদি জবাব দেওয়ার চেষ্টা করে আবারও পাল্টা হামলা চালানো হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইরান। বিবিসির আন্তর্জাতিক সম্পাদক জেরেমি বোয়েন তার বিশ্লেষণে বলছেন, ইরান ‘সিরিয়াস ড্যামেজ’ (গুরুতর ক্ষতি) ঘটানোর চেষ্টা করেছিল বলেই দেখা যাচ্ছে। ফলে ইসরাইলের জবাব কী হয় সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।

ইসরাইলের স্পর্শকাতর কৌশলগত স্থাপনাগুলো লক্ষ্য করে ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলাকে বৃহত্তর সংঘাতের উসকানি হিসেবে বিবেচনা করছে ইসরাইল। ইসরাইলি বিমান বাহিনী, তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ডের (সেন্টকম) মধ্যে নিবিড় সমন্বয়কেই ইরানের হামলা ব্যর্থ করে দেওয়ার কৃতিত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ হামলায় অল্প কয়েকজন আহত হওয়া ছাড়া বড় ধরনের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলে দাবি ইসরাইলের। এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ইসরাইলে সরাসরি হামলা চালাল ইরান। তেহরানের দাবি, তারা ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অকার্যকর করে দিতে দেশটির বিমানঘাঁটি ও রাডার সিস্টেমগুলোকে লক্ষ্যস্থল করেছে। 

ইসরাইলের বহুদর্শী যুদ্ধ সাংবাদিক রন বেন-ইশাই লিখেছেন, ইরান এখন গাজা, লেবাবন ও পশ্চিম তীরের মতো ইসরাইলের এক প্রাথমিক মনোযোগ পরিণত হয়েছে। প্রায় এক টন ওজনের বোমা যুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে কৌশলগত স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্যস্থল করার পাশাপাশি ইসরাইলজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছে ইরান। তাই ইসরাইলকে অবশ্যই তাদের প্রতিক্রিয়া বৃদ্ধি করতে হবে।

ইরানের নেতৃবৃন্দও ইসরাইলের পাল্টা হামলার অপেক্ষায় সতর্কভাবে তাদের পরবর্তী পদক্ষেপের পরিকল্পনা তৈরি করছেন। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ইসরাইলের ধারাবাহিক হামলায় ইরানের আঞ্চলিক প্রতিরোধ অক্ষের ছায়া বাহিনীগুলো অনেকটা দুর্বল হয়েছে। এর মধ্যে ইসরাইল হামাসের শীর্ষ নেতা ইসমাইল হানিয়া, হিজবুল্লাহর শীর্ষনেতা হাসান নাসরাল্লাহ ও লেবাননে ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) এক শীর্ষ কমান্ডারকে হত্যা করে ইরানের অবস্থান আগের চেয়ে দুর্বল করে তুলেছে।

ইসরাইল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা বা তেল অবকাঠামোগুলোকে লক্ষ্যস্থল করতে পারে। কিন্তু ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালালে তা একই সঙ্গে ইসরাইল ও মার্কিন স্বার্থের পরিপন্থী হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এ ধরনের কোনো হামলা চালানো হলে তা পুরো মাত্রার যুদ্ধের সূচনা ঘটাতে পারে আর তাতে ইরান তাদের পারমাণবিক উচ্চাকাক্সক্ষা পূরণে উঠেপড়ে লাগতে পারে। রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের গবেষক বুর্কু ওজচেলিক বলেন, এই ধরনের হামলা উত্তেজনা বাড়ানোর সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে এবং এর ফলে অপ্রত্যাশিত ঘটনার চক্র শুরু হতে পারে। যা পশ্চিমা স্বার্থকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে।

ইরানের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে তেল ও গ্যাস রফতানির ওপর নির্ভরশীল। এসব স্থাপনায় হামলা চালালে ইরান নিশ্চিতভাবে হরমুজ প্রণালির মতো গুরুত্বপূর্ণ জলপথ বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করবে। যার অনিবার্য প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতি এড়াতে পারবে না। মধ্যপ্রাচ্যে বিস্তৃত আঞ্চলিক যুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ আছে আর ইসরাইলকে এর সঙ্গে সংগতি রেখেই ইরানে হামলার আওতা বিবেচনা করতে হবে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। এ কারণে ওয়াশিংটন যেটিকে উপযুক্ত, বৈধ ও কম ঝুঁকিমুক্ত বলে বিবেচনা করবে; হামলা চালানোর জন্য ইসরাইলকে সম্ভবত তেমন লক্ষ্যই বেছে নিতে হবে। লেবানন ও অন্য যুদ্ধক্ষেত্রগুলোতে মনোযোগ দেওয়ার জন্য এই অধ্যায়টি শেষ করার মধ্যেই ইসরাইলের বৃহত্তম স্বার্থ নিহিত বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

ইসরাইলের ক্ষয়ক্ষতি : ইরানের হামলার পর ইসরাইলের সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, এসব ক্ষেপণাস্ত্রের বেশিরভাগই তারা প্রতিহত করেছে। তবে কিছু ক্ষেপণাস্ত্র তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ভেদ করে ভূমিতে আঘাত করতে সক্ষম হয়েছে। এসব ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলের কী কী ক্ষতি করে সেই সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল বিবিসি। বুধবার রাতে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে বিবিসি জানিয়েছে, ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর আঘাতে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা এখনও পুরোপুরিভাবে নিরূপণ করতে পারেনি ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ।

আজ তেল আবিবের ঠিক উত্তরে মোসাদের সদর দফতরের কাছে বেশ কয়েকটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ি এবং একটি রাস্তার পাশে মাটির স্তূপ খুঁজে পেয়েছেন বিবিসির সংবাদদাতা। সেখানে একটি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ৮ থেকে ১০ মিটার গভীর গর্তের সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে। নিকটবর্তী হোড হাশারন পৌরসভা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ওই এলাকায় ক্ষেপণাস্ত্র বিস্ফোরণ এবং শ্র্যাপনেলের আঘাতে প্রায় ১০০টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

এদিকে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) দ্বারা প্রকাশিত একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, এই বাহিনীর হোম ফ্রন্ট কমান্ডের প্রধান দেশটির অ্যাশকেলন শহরের পূর্ব দিকে অবস্থিত গেদেরা এলাকায় ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত একটি স্কুল পরিদর্শন করছেন। ভিডিওতে স্কুলটির একটি শ্রেণিকক্ষের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ দেখা গেছে। 

এদিকে মার্কিন কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছে, ইরান ইসরাইলের নেভাতিম বিমানঘাঁটিকে লক্ষ্য করে যেসব ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে সেগুলোই সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি করেছে। তবে এই বিমানঘাঁটির ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী। তারা মনে করছে, ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করলে, তা ইরানকে তার হামলার কার্যকারিতা বুঝতে সাহায্য করবে। বিবিসি জানিয়েছে, ইসরাইলের ম্যাগেন ডেভিড অ্যাডম অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবার প্যারামেডিকরা তেল আবিব এলাকায় শ্র্যাপনেলে আঘাতপ্রাপ্ত দুই ব্যক্তি এবং আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সময় পড়ে গিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত কিছু ব্যক্তিকে চিকিৎসা করেছেন।

এদিকে রাতে ইরানের হামলার পর সকালে হুতি ও হিজবুল্লাহও ইসরাইলে হামলা চালিয়েছে। দুই বাহিনীর অর্ধশতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র আছড়ে পড়ে ইসারইলের বুকে। এতে বহু ক্ষয়ক্ষতি হলেও ইসরাইল ১০টি বাড়ি ধ্বংসের কথা জানিয়েছে।

হিজবুল্লাহ-ইসরাইল সম্মুখ লড়াই : দক্ষিণ লেবাননে ইরানপন্থি সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর সঙ্গে সংঘর্ষে সেনা নিহতের কথা প্রথমবার স্বীকার করল ইসরাইল। ইসরাইলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, লেবাননে সামরিক অভিযানে তাদের আট সেনা নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে একজন ক্যাপ্টেন পদমর্যাদার কর্মকর্তা ছিলেন। এটি ছিল ইসরাইলি বাহিনী হিজবুল্লাহকে লক্ষ্য করে সীমান্ত অতিক্রম করার পর প্রথম প্রাণহানি। বুধবার সামরিক বাহিনী এক বিবৃতিতে নিহতের কথা নিশ্চিত করেছে।

হিজবুল্লাহ জানিয়েছে, তাদের যোদ্ধারা ইসরাইলি সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। ইসরাইলি সেনারা লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি সীমান্ত গ্রামে প্রবেশ করেছিল। এর আগে হিজবুল্লাহ দাবি করে, ইসরাইলি সেনারা আদাইসেহ গ্রামে প্রবেশের চেষ্টা করলে তাদের পিছু হটতে বাধ্য করা হয়।

হিজবুল্লাহর মুখপাত্র মোহাম্মদ আফিফ বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলে সাংবাদিকদের জানান, এটি সংঘর্ষের শুরু মাত্র। দক্ষিণের প্রতিরোধ যোদ্ধারা সর্বোচ্চ প্রস্তুতিতে রয়েছে। লেবাননের সেনাবাহিনী জানিয়েছে, ইসরাইলি বাহিনী সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য দেশটির সীমান্ত লঙ্ঘন করেছে। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়, ইসরাইলি শত্রু বাহিনী ব্লু লাইন অতিক্রম করে প্রায় ৪০০ মিটার লেবাননের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে। তবে পরে তারা ফিরে যায়।

বুধবার সকালে ইসরাইলি বাহিনী দক্ষিণ লেবাননের অতিরিক্ত এলাকাগুলো খালি করার নির্দেশ দিয়েছে। সেখানে ২০টিরও বেশি গ্রাম ও শহরের বাসিন্দাদের চলে যেতে বলা হয়েছে। এর একদিন আগে, ইসরাইলি সামরিক বাহিনী স্থল অভিযান শুরু করার ঘোষণা দেওয়ার পর একই ধরনের একটি নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ইসরাইলি বাহিনী জানিয়েছে, তাদের হামলায় বৈরুতের দাহিয়েহ এলাকার ৪টি আবাসিক ভবন ধ্বংস হয়ে গেছে। 

জাতিসংঘের জরুরি বৈঠক : মধ্যপ্রাচ্য সংকট নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসছে জাতিংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। ইসরাইলের অভ্যন্তরে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরপরই জরুরি ভিত্তিতে এই বৈঠকে বসতে যাচ্ছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। বুধবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় (বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার রাত ৯টা) নিউইয়র্কের জাতিসংঘের সদর দফতরে বৈঠকটি হওয়ার কথা রয়েছে।

আলজাজিরা লিখেছে, নিরাপত্তা পরিষদকে লেখা চিঠিতে জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যানন জানান, ইসরাইলকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে ইরান। এই অভিযোগ তুলে ইরানের নিন্দা এবং দেশটির ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসকে (আইআরজিসি) একটি ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। তবে ইরানের দাবি, গাজা উপত্যকায় ও লেবাননে ইসরাইলি হত্যাযজ্ঞের প্রতিশোধ এবং হামাস, হিজবুল্লাহ ও আইআরজিসির নেতাদের গুপ্তহত্যার জবাবে তারা ইসরাইলে এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে।


সময়ের আলো/আরএস/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close