ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

রাজনীতিতে ফ্যাসিস্ট শব্দটি এখন বেশি উচ্চারিত
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৩ অক্টোবর, ২০২৪, ২:১২ এএম  (ভিজিট : ৩১৮)
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ফসল হচ্ছে নতুন বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশে কোনো ধরনের বৈষম্য থাকবে না। সবার সমান অধিকার নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। যে যার অবস্থান থেকে স্বাধীনভাবে ভূমিকা পালন করবে। এই নতুন বাংলাদেশের কারিগর যারা তারা বেশিরভাগ বয়সে তরুণ। কবি হেলাল হাফিজের সেই কবিতার পঙক্তি ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার সময় তার’। এই তরুণরা পারে বাংলাদেশের নতুন পথরেখা তৈরি করতে। তবে এই পথে কোনো ধরনের ফ্যাসিস্ট থাকবে না। যে ফ্যাসিবাদের গ্যাঁড়াকলে দেশ এক অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাবে।

গত ৫ আগস্টের অনেক আগে থেকে কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। তবে এর আগেও এই আন্দোলন হয়েছিল। সে সময়ের সরকারের ফ্যাসিস্ট মনোভাবে ফলাফল পাওয়া যায়নি। তবে ফ্যাসিস্টকে একসময় হার মানতে হয় দেশের আপামর ছাত্র-জনতার কাছে।

এখন বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট শব্দটি বহুল প্রচলিত। মূলত আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছরে দেশ শাসনের যে উদাহরণ রেখেছে সেই থেকে এই শব্দটি দেশের মানুষের মনে গেঁথে গেছে। কেউ সাহস করে মুখ ফুটে বলতে পারেনি। বলার সাহস দেখাতে পারেনি। একমাত্র কারণ গুম, খুন আর গায়েবি মামলার ভয়। এরপরও দেশের মানুষের মনে যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ছিল তা মূলত দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতি, দুর্নীতি আর বিরোধী দলের মতকে পদদলিত করা।

ছাত্রদের কোটা আন্দোলন পথ দেখিয়ে দেয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। সেই প্রতিবাদে আস্তে আস্তে শামিল আপামর ছাত্র-জনতা ও দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলো।

কোটা আন্দোলনকে সরকার অনেকভাবে দমন করতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারেনি। অথচ ত্রাস সৃষ্টি করেছে। আর দেশের করের টাকায় বেতনে চলা বেশ কিছু সরকারের পোষ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এদের সঙ্গে যোগ দেয় আওয়ামী লীগের নেতারা। কিন্তু অসীম সাহস নিয়ে যে ছাত্র-জনতা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এগিয়ে এসেছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো কেন আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্ট হিসেবে ছাত্র-জনতার সামনে চলে এলো। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনে করেছিলেন, তার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে সবকিছু পরাস্ত করবেন। ছাত্রদের কোটাবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখনও তিনি ছাত্রদের সঙ্গে উপহাস করেছেন। হাইকোর্টের কাঁধে বন্দুক রেখে খেলতে চেয়েছেন।

শুধু কোটাবিরোধী আন্দোলন কেন, যখন দেশের মানুষ ঊর্ধ্বগতি দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে জর্জরিত তখনও তিনি উদাস থেকেছেন। তারই পোষ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে তার বাসার চাকর যখন দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। তিনি ছিলেন নিশ্চুপ। স্রোতের বাইরে গিয়ে তিনি দেশের মানুষের কথা পড়তে পারেননি। বরং নিজের ক্ষমতা বজায় রাখতে সবাইকে সুযোগ দিয়েছেন।

ন্যায়-অন্যায় বলে ফ্যাসিস্টদের কাছে মূল্যহীন। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এক ফ্যাসিস্ট রূপে দেশ চালিয়েছেন। আপামর মানুষ কী চায় তা কোনো আমলে নেননি। দেশের মানুষ তাকে চায় কি না তাও পরখ করার চেষ্টা করেননি। যে কারণে ফ্যাসিস্টের চূড়ান্ত ফলাফল দেখতে পাখির মতো ছাত্র-জনতা ওপর গুলি করার নির্দেশ দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি। তার এই ফ্যাসিস্ট আচরণ আপামর দেশের মানুষের কাছে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।

এ কথা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না বিগত আওয়ামী লীগ সরকার দেশের মানুষের প্রতি যে আচরণ করেছে তা ফ্যাসিবাদী ছাড়া অন্যভাবে বলার কোনো সুযোগ নেই। যে কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফ্যাসিস্ট শব্দটি বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। কেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই ফ্যাসিস্ট শব্দটি ব্যবহার হচ্ছে। এর আগে তো এই শব্দ ঘরে ঘরে উচ্চারিত হয়নি। আবার আওয়ামী লীগের যারা সমর্থক তাদেরও বলা হচ্ছে ফ্যাসিস্টদের দোসর।

ফ্যাসিস্ট শব্দটি এলো কোথা থেকে। যা অনেকে বলে থাকেন ফ্যাসিজম বা ফ্যাসিবাদ। এই শব্দটি এসেছে মূলত ইতালি থেকে। ইতালিতে ফ্যাসিমো এসেছে ফ্যাসিও শব্দ থেকে। ফ্যাসিও শব্দটি মূলত লাতিন শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে, লাঠি। কাঠ বা রডের আঁটি একসঙ্গে বেঁধে রাখা হয়।

ফ্যাসেস থেকে ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দলের নামকরণ হয়। আসলে একতা বা ঐক্য বোঝানোর জন্য এ ধরনের প্রতীক ব্যবহার করা হয়েছিল। এক বান্ডেল কাঠ ও রড যখন একসঙ্গে বেঁধে রাখা হয় তখন কিন্তু তা ভাঙা যায় না। একটি রড বা কাঠ আলাদা থাকলে সেটি ভেঙে ফেলা হয়।

এনসাইক্লোপিডিয়া বিট্রানিকায় বলা হয়েছে, ফ্যাসিজম হচ্ছে একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ ও গণআন্দেলন। ১৯১৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ইউরোপের অনেক দেশে এই মতাদর্শের ব্যাপক দেখা গেছে। ফ্যাসিজম মূলত ইউরোপে উগ্রপন্থি জাতীয়তাবাদের আবির্ভাব হয়। এই বিরোধীদের কোনো জায়গা ছিল না। 

কর্তৃত্বময় শাসন ক্ষমতাই ছিল ফ্যাসিবাদের মূলমন্ত্র। এখানে ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যের কোনো স্থান নেই। এর মাধ্যমে ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে শুরু করে সবকিছু হরণ করা হতো। মোট কথা ক্ষমতাকে একটি কেন্দ্রে আবদ্ধ করে রাখা।

ফ্যাসিবাদের উৎপত্তি হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। আর তা হয় ইতালিতে। এরপর এই মতবাদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। জার্মানিতে হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসিবাদের উত্থান হয়। এটি ছিল ফ্যাসিজমের একটি রূপ।

ইতালি ও জার্মানিতে প্রথম ফ্যাসিস্ট নেতা আবির্ভূত হয়। যার নাম ইতালির বেনিতো মুসোলিনি। ২০২৪ সালে প্রকাশিত এক ইতিহাসবিদ রবার্ট পেক্সটন বইয়ে উল্লেখ করা হয়, ১৯১৯ সালের ১৫ এপ্রিল এক বৈঠকের পর মুসোলিনির একদল বন্ধু ও সহচর মিলে ইতালিতে সমাজতন্ত্রী সমর্থিত একটি পত্রিকা অফিসে হামলা চালায়।

অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, ফ্যাসিজমের আসলে কোনো সংজ্ঞা নেই। ফ্যাসিস্ট দলগুলো জনসমাবেশ করে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করে। কিন্তু অন্যকে সেই শক্তি প্রদর্শন করার কোনো সুযোগ দেয় না। যেমন করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। গত ১৫ বছরে দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামকে কোনো ধরনের জনসভা করার ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের বিধিনিষেধ দেয়। আবার কোনো কোনো দলকে একেবারেই জনসভা করতে দেয়নি। সবশেষ ছাত্র-জনতা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় জামায়াতে ইসলামী দলকে নিষিদ্ধ করে।

ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ এক ব্যক্তির শাসনে চলেছে। কোনো বিরোধী মতকে কোনো ধরনের একটু জায়গা দেয়নি। ফ্যাসিবাদ সবসময় মনে করে তারাই সবেসর্বা। যে কারণে নিজেদের কর্তৃত্ব ও শাসনে বিশ্বাস করত। অন্যের মতবাদকে কোনোভাবেই বিশ্বাস করত না।

ফ্যাসিবাদের আরেক বৈশিষ্ট্য রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে একই ব্যক্তি থাকবেন। যার হাতে থাকবে সর্বময় ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে ফ্যাসিবাদ মানবাধিকারকে অবজ্ঞা করে। তারা মনে করে, প্রয়োজনের স্বার্থে বা নিজেদের স্বার্থে মানবাধিকার উপেক্ষা করা যায়। অথচ তারাই আবার মানবাধিকার নিয়ে বেশি কথা বলে।

ফ্যাসিবাদ আবার গণমাধ্যমকে অনেক ভয় পায়। যে কারণে গণমাধ্যমকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে যত ধরনের উপকরণ তৈরি করা দরকার তাই করেছে। বিভিন্ন আইনকানুন দিয়ে গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ চাপানো হয়। আওয়ামী লীগ সরকার সেই পথে হেঁটেছে। দেশের মানুষের কথা অনেক সময় বলা হয়েছে, অপতথ্য।

ফ্যাসিবাদ করপোরেটকে বিভিন্নভাবে ভয় দেখিয়ে কাজে লাগায়। বিশেষ করে সরকারের সঙ্গে কিছু ব্যবসায়ী-শিল্পপতির বিশেষ সম্পর্ক তৈরি করে। একই সঙ্গে কাউকে কাউকে সিন্ডিকেট গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আবার কখনো নীরব থাকে।

সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ফ্যাসিবাদ প্রকৃত গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে খুব বেশি পাত্তা দেয় না। তারা নিজেরা মনে করে, তাদের জনপ্রিয়তা রয়েছে। যে কারণে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নির্বাচনের কারচুপির আশ্রয় নেয়।

শুধু তাই নয়, কোনো ধরনের রাজনৈতিক দল যেন কোনোভাবে নির্বাচনে অংশ না নিতে পারে। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে নানা ধরনের কৌশল নেয়। যেন বিরোধী দল কোনোভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কোনো স্থান না পায়।


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক
দৈনিক সময়ের আলো  


সময়ের আলো/আরএস/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close