ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

পুরান ঢাকার জেনারেল হাসপাতাল
নাই ডাক্তার নাইরে রোগী নামেই হাসপাতাল
প্রকাশ: বুধবার, ২ অক্টোবর, ২০২৪, ৬:৩০ এএম  (ভিজিট : ২৪২)
কথায় বলে আছে গরু না বয় হাল, তার দুঃখ সর্বকাল। রাজধানীর পুরান ঢাকার জেনারেল হাসপাতালটির অবস্থাও তেমনি। সরকারি হাসপাতালগুলোতে সবসময়ই ভিড় লেগে থাকে রোগীদের। ব্যস্ত সময় পার করেন চিকিৎসক ও নার্সরা। অথচ এর বিপরীত চিত্র পুরান ঢাকার ১৫০ শয্যাবিশিষ্ট মহানগর জেনারেল হাসপাতালে। সকালের দিকে হাতেগোনা কিছু রোগী এলেও সন্ধ্যার পরে এক ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয় হাসপাতালটিতে। থাকে না কোনো রোগী ও স্বজনের চাপ। ওষুধ সংকট, চিকিৎসক, নার্স ও টেকনিশিয়ানের সংকটসহ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত এ হাসপাতাল।

শুধু এসব সমস্যা নয়, যন্ত্রপাতি কেনার চার বছর পরও হাসপাতালে চালু হয়নি আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র)। তালাবদ্ধ কক্ষেই পড়ে আছে সেগুলো। একই অবস্থা হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটেরও (এইচডিইউ)। হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলাসহ বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জাম পড়ে আছে বছরের পর বছর। অব্যবহৃত ও অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থেকে নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে যন্ত্রপাতিগুলো। ব্যবহার ছাড়াই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ। এ ছাড়া চিকিৎসক-লোকবলের অভাবে করা হয় না সিজারিয়ানসহ জটিল কোনো অস্ত্রোপচার। মাত্র একজন সার্জারি চিকিৎসক দিয়ে চলছে চিকিৎসা। আর সপ্তাহে দুদিন হয় আলট্রাসনোগ্রম ও এক্সরে পরীক্ষা। এখানে ৩১ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে- এমন কথা সাইনবোর্ডে লেখা থাকলেও বাস্তবে এর অস্তিত্ব নেই।

সোমবার হাসপাতালটিতে দেখা গেছে, সর্বাধুনিক প্রযুক্তির বিভিন্ন রুম। কিন্তু হাসপাতালের ইনডোর এবং আউটডোরে হাতেগোনা কয়েকজন রোগী। এমনকি হাসপাতালের অধিকাংশ শয্যা খালি পড়ে আছে। রোগী না থাকায় আবার অনেক শয্যায় মরিচা ধরে গেছে। হাসপাতালের কেবিনগুলোর কয়েকটিতে রোগী ভর্তি থাকলেও বেশিরভাগই ছিল তালাবদ্ধ। পুরুষ ও মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ডে কয়েকজন রোগী ভর্তি আছেন। প্রসূতি বিভাগেও একই অবস্থা। বাকি বেডগুলো খালি পড়ে আছে। দাঁতের চিকিৎসার জন্য আধুনিক সরঞ্জাম থাকলেও চিকিৎসকের অভাবে বন্ধ সেবা কার্যক্রম।

হাসপাতালটিতে প্রয়োজনীয় ওষুধ মিলছে না বলেও অভিযোগ করেন একাধিক রোগী ও তাদের স্বজন। তারা বলেন, পুরান ঢাকায় যে একটি সরকারি হাসপাতাল রয়েছে তা সবাই জানে; কিন্তু সেখানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক নেই, নার্স নেই। দুই-চারজন যারা আছেন তারাও ঠিকমতো আসেন না। ফলে চিকিৎসা না পাওয়ায় রোগীও আসেন না। পুরান ঢাকার নয়াবাজারে ১৯৮৯ সালে শ্রমজীবী হাসপাতাল নামে প্রতিষ্ঠিত হয় এ হাসপাতাল। শুরুতে এর শয্যা সংখ্যা ছিল ৫০টি। ১৯৯৭ সালে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতাল। ওই সময় শয্যা সংখ্যা বাড়িয়ে ১৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও বাড়ানো হয়নি লোকবলসহ অন্যান্য কারিগরি সক্ষমতা। এখন এটি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালনা করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, ২০২০ সালের করোনাকালে এ হাসপাতালে সংকটাপন্ন রোগীদের চিকিৎসার জন্য জরুরি ভিত্তিতে ১০টি আইসিইউ শয্যা স্থাপন করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। এরপরে ১৫টি হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিট ও ভেন্টিলেশন মেশিন, ১২ শয্যার হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা (অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা, যা মিনিটে ৬০ লিটার বা তার বেশি অক্সিজেনের প্রবাহ দিতে সক্ষম) স্থাপন করা হয়। তখন দ্বিতীয় তলায় দুই ওয়ার্ড চালু করার জন্য জনবল ও নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ পেতে বিভিন্ন সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় চাহিদা জানানো হয়। তবে তাতে সাড়া দেয়নি মন্ত্রণালয়। এরপর আইসিইউ শয্যাসহ যন্ত্রপাতি ফেরত নিতে মন্ত্রণালয়কে তিনবার চিঠি পাঠায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এ চিঠির কোনো উত্তর দেয়নি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থাও। ফলে দীর্ঘদিন অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকায় এসব যন্ত্র কার্যক্ষমতা হারাচ্ছে। একই সঙ্গে জনবল সংকটের কারণে রক্ষণাবেক্ষণেও জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। দৈনিক প্রায় ১২ ঘণ্টা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র চালু রাখায় অপচয় হচ্ছে অর্থের।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এখানে জনবল কাঠামো অনুযায়ী ৩১ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও আছে মাত্র ১৭ জন। জরুরি বিভাগে থাকার কথা ৮ জন, কিন্তু কাজ করছেন ৪ জন। নার্স থাকার কথা ৩৭ জন। আছেন ১৪ জন। এর মধ্যে নিয়মিত ৯ জন, সংযুক্তিতে পাঁচজন। হাসপাতালটি সিটি করপোরেশনের আওতায় থাকলেও চিকিৎসক, নার্স নিয়োগ দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

হাসপাতালটিতে বহির্বিভাগে রোগী দেখাতে বা হাসপাতালে ভর্তির জন্য দিতে হয় মাত্র ১০ টাকা। কিন্তু হাসপাতালের নিচ তলায় মাত্র দুজন রোগীকে দাঁড়িয়ে টিকেট কাটতে দেখা গেছে। এ ছাড়াও মেডিসিন, গাইনি ও প্রসূতি, প্যাথলজি, চর্ম ও যৌন, দন্ত এবং নাক, কান ও গলা বিভাগের সামনে চিকিৎসা নিতে অপেক্ষা করছিলেন তিন-চারজন করে রোগী। কিন্তু বেশিরভাগ চিকিৎসকের রুমে কোনো রোগী ছিল না। মহিলা বহির্বিভাগে চিকিৎসকদের দুই রুমের সামনে গিয়ে দেখা যায়, একজন চিকিৎসক তার সহকর্মীর সঙ্গে খোশগল্প করছেন। আরেক চিকিৎসক মোবাইল নিয়ে সময় কাটাচ্ছেন। মেডিসিন বিভাগের ডা. হোমায়রার রুমে মাত্র দুজন রোগী দেখা গেছে।

বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী সাইদুল ইসলাম সময়ের আলোকে বলেন, জ্বর, গলাব্যথা নিয়ে এসেছি। আমার বাসা এখানেই। শরীরের অবস্থা ভালো নয়। তাই ঠেকায় পড়ে এসেছি। তা হলে কি এখানে আসি। শুধু আমি না, আমার মতো অনেকেই নিরুপায় হয়ে এ হাসপাতালে আসে।
আনজুমান আরা নামে আরেক রোগী বলেন, এ হাসপাতালে ডাক্তার নেই, নার্স নেই, পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। তবুও এখানে আসি। শুধু প্রেসক্রিপশন নেওয়ার জন্য। পরে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনব, এ জন্যই এসেছি। বাইরে ডাক্তার দেখাতে অনেক টাকা লাগে।

হাসপাতালটির তিন তলার পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ডে আগে ছিল করোনার আইসোলেশন ওয়ার্ড। এখন সেখানে পুরুষ ওয়ার্ডে দুজন ও মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ডে তিনজন রোগী ভর্তি আছেন। বাকি বেডগুলো খালি পড়ে আছে। এ ছাড়া হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে ১৬টি শয্যা থাকলেও রোগী ভর্তি রয়েছে ৪ জন।

পুরুষ ওয়ার্ডে ভর্তি হওয়া আকমল হোসেন নামে এক রোগীর স্বজন সময়ের আলোকে বলেন, এখানে ভর্তি হওয়ার পর আমরা কম সময়ই ডাক্তারের দেখা পাই। সকালে একবার আসে, তারপর সারা দিন আর দেখা যায় না। আর রাতে তো কোনো ডাক্তারই থাকে না। রাতে শুধু ডাক্তার নয়, হাসপাতালের অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীও খুব কম থাকে। তখন খুব ভয় ভয় লাগে।

প্রসূতি বিভাগে ভর্তি হওয়া মিনু বেগম সময়ের আলোকে বলেন, এখানে ডাক্তার-নার্স কম। তবে যারা আছেন তারা খুবই ভালো। ডাক্তার-নার্স কম থাকার পরও কেন এখানে ভর্তি হলেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা দরিদ্র মানুষ, দিন আনি দিন খাই। বড় হাসপাতালগুলোতে যেতে পারি না, আর এখানে খরচ খুব কম, তাই ভর্তি হয়েছি।

লোকবলের সংকটে পরিপূর্ণ সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না স্বীকার করে হাসপাতালের পরিচালক ডা. আম্মাতে নূর ওয়াহিদা সুলতানা সময়ের আলোকে বলেন, এ হাসপাতালে চাহিদার তুলনায় জনবল খুবই কম। এ বিষয়টি সবাই জানে। আমরা জনবল চেয়ে কয়েকবার আবেদন করেছি, কিন্তু পাইনি। জনবলের বিষয়ে গত রোববারও ঊর্ধ্বতন কর্মকতাদের সঙ্গে মিটিং হয়েছে। আমরাও চাহিদাপত্র দিয়েছি। তবে তারা চিকিৎসকসহ জনবল নিয়োগের ব্যাপারে আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন।

হাসপাতালে তালাবদ্ধ হয়ে পড়ে থাকা যন্ত্রপাতির বিষয়ে তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবে ব্যবহার না হওয়ায় যন্ত্রপাতিগুলো ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এখন পর্যন্ত তিনবার চিঠি দিয়েছি। পরে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে একটি চিঠির অনুলিপিও পাঠানো হয়েছে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সেগুলো রুমের মধ্যে তালাবদ্ধ হয়ে পড়ে আছে। আমরা এক দিনে জন্য ব্যবহার করতে পারিনি। এখন এ যন্ত্রপাতি ঠিক আছে কি না সেটিও জানি না।

সময়ের আলো/জিকে




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close