ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর বাড়িঘর ছেড়ে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা টাকার বিনিময়ে এলাকায় ফিরতে চাইছেন। ইতিমধ্যেই কেউ কেউ বিএনপি ও তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের টাকা দিয়ে এলাকায় ফিরেছেন। কেউ কেউ আবার এলাকায় ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, টাকার মাধ্যমে পুনর্বাসন সম্ভব হবে না। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু সময়ের আলোকে বলেছেন, আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের সুযোগ নেই।
সূত্র বলছে, সভাপতি শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করায় হতাশায় পড়েন আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। ভয়ে দিন কাটছিল তাদের। নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশ চলে গিয়েছিল আত্মগোপনে। কেউ কেউ গোপনে দেশও ছেড়েছেন। অনেকেই হয়েছেন গ্রেফতার। দলটির কেন্দ্রীয় এমপি-মন্ত্রীসহ তৃণমূলের নেতাকর্মীরা সবাই এখন বাড়িঘর ছাড়া। পরিবার পরিজনের সঙ্গে নেই কোনো যোগাযোগ। সন্তানরা বাবাকে দেখতে চায়। অন্য কারোর ফোন দিয়ে যোগাযোগ করতে হয়। চাইলেই পরিবার তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না।
শেখ হাসিনা কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ করে দেশ ত্যাগ করায় আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা দেশ ছাড়ার সুযোগটুকওু পাননি। কেউ গোপনে দেশের বাইরে যেতে চাইলেও বিমানবন্দর বা ইমিগ্রেশনেই আটকে দেওয়া হয়েছে। সংগত কারণে যে নেতাকর্মীরা বাড়িঘর ছেড়ে আত্মগোপনে ছিলেন, তারা এখন টাকার বিনিময়ে ঘরে ফিরতে চাইছেন। তবে হঠাৎ করে এলাকায় ফিরলে আবার হামলার শিকারও হতে পারেন-এমন ভয়ও পাচ্ছেন তারা। আওয়ামী সূত্র বলছে, স্থানীয় বিএনপির প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন তারা। তারা অভয় দিলেই শুধু তারা ঘরে ফিরছেন। ইতিমধ্যে কেউ কেউ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এলাকায় ফিরছেন। আবার এমনও হয়েছে, টাকা দিয়ে ঘরে ফিরে আবার হামলার শিকারও হয়েছেন কেউ কেউ। তবে বিএনপির কোন নেতাকে কত টাকা দিয়ে তারা বাড়িঘরে ফিরছেন, তা নিয়ে মুখ খুলতে চাননি। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপি নেতাদের ২-৫ লাখ টাকাও কোনো কোনো নেতাকে দিতে হয়েছে। নেতার পদমর্যাদা ও সম্পদের পরিমাণ হিসাব করে টাকার পরিমাণ নির্ধারণ করা হচ্ছে।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারে পতনের পর বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখল বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ ওঠে। আওয়ামী লীগের তৃণমূলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ওপর হামলাও হয়েছে। ঘরবাড়ি ভাঙচুর, অগ্নি সংযোগের পাশাপাশি প্রকাশ্যে নেতাকর্মীদের পিটিয়ে মেরে ফেলারও অভিযোগ রয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা চলে যান আত্মগোপনে। কিন্তু ঘটনার দেড় মাস পরে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়েছে। এতে করে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী নিজ উদ্যোগে এলাকায় ফিরতে শুরু করেছেন। তবে বাড়ি ফেরার জন্য তাদেরকে মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হচ্ছে। যারা টাকা দিচ্ছেন না, তাদেরকে এলাকায় ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। টাকা দিয়ে এলাকায় বহাল তবিয়তে রয়েছেন। স্থানীয় প্রভাবশালী বিএনপি নেতাদের সঙ্গে করছেন যোগাযোগ। এরপর তারা গ্রিন সিগনাল দিলেই তাদের কেউ এলাকায় ফিরছেন। আবার কেউ কেউ ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন। এমন আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কয়েকজন নেতাকর্মীর কথা হয় সময়ের আলোর সঙ্গে।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের এক সহ-সভাপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে সময়ের আলোকে বলেন, আমি ঢাকায় আছি। স্থানীয় বিএনপি নেতারা আমাকে পছন্দ করেন। তারা বলেছেন, আপনি নিরাপদে থাকেন। আমরা আপনার কোনো ক্ষতি করব না। আপনি আমাদের বিপদের সময় আগলে রেখেছেন। এখন আমরা আপনার পাশে আছি। তাই আমার বাড়িতে থাকি না। কিন্তু এলাকায় আছি।
বিএনপি নেতাকর্মীদের কোনো টাকা পয়সা দিতে হচ্ছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের আমলে তাদেরকে আমরা আগলে রেখেছি। তাদের বিভিন্ন বিপদ আপদে সহযোগিতা করেছি। তাই তারা আমাকে ভালোবাসেন। তবে আমি যেহেতু বাইরে যাই না, তাদেরকে কিছু টাকা পয়সা দিই। তারাই আমার খাবার থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নিয়ে আসেন। ভালো আছি। আর কিছু বলার নেই।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের অন্তর্গত থানা আওয়ামী লীগের এক সাধারণ সম্পাদক সময়ের আলোকে বলেন, আমি এলাকায় আছি। নিজ বাড়িতেই আছি। প্রকাশ্যে আসছি না। স্থানীয় বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলেই আছি। রাজনীতি যখন শুরু হবে তখন প্রকাশ্যে আসব। বেশ কয়েক দিন আত্মগোপনে ছিলাম। কিন্তু বিএনপি নেতাদের অনুরোধেই আমার বাড়িতে অবস্থান করছি। যেহেতু আমার তিনটা বাড়ি আছে ঢাকায়। সে কারণে আগে যে বাড়িতে ছিলাম সেখানে থাকছি না। কারণ সাধারণ মানুষ আমার ওই বাড়ি চিনে। তাই অন্যবাড়িতে থাকি। নিজ বাড়িতে থাকতে গিয়ে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে লেনদেন হয়েছে কি না জবাবে তিনি বলেন, বিএনপি নেতারা আমাকে বলেছেন অনেক টাকা কামাই করেছেন। তখন আমরা ছিলাম না খেয়ে, তাই এলাকায় থাকুন। আপনাকে আমরা সব ধরনের সাপোর্ট দেব। শুধু কিছু টাকা দেন। সে কারণে আমি কিছু টাকা দিয়েছি। তবে কত টাকা দিয়েছি, সেটি আমি বলতে চাই না।
ঢাকা মহানগর উত্তরের অন্তর্গত আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক ওয়ার্ড সভাপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে সময়ের আলোকে বলেন, আমি এলাকায় আছি। তবে স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে মিলে মিশে আছি। তারা আমাকে যথেষ্ট সম্মান করে। কোনো টাকা পয়সা দিতে হয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, টাকা তো কিছু দেওয়া লাগবে। এটাই তো স্বাভাবিক। তারা আমাকে সম্মান করে। তারা আমাকে অভয় দিয়ে রেখেছেন। তবে সেটা কোনো আহামরি কিছু না।
ফরিদপুরের নগরকান্দার পৌর যুবলীগের সভাপতি ও সদ্য অপসারিত সাবেক পৌর মেয়র নিমাই সরকার সময়ের আলোকে বলেন, আমার এলাকায় আপাতত তেমন কোনো ঝামেলা নেই। বিএনপি-আওয়ামী লীগ সবাই মিলেমিশে আছেন। ফলে এখানে ভয়ের কোনো কারণ নেই। এলাকায় থাকতে বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা টাকা পয়সা দিয়েছেন কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গোপনে কেউ দিতে পারেন। তবে প্রকাশ্যে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি।
ময়মনসিংহের ঈশ^রগঞ্জের এক স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সময়ের আলোকে বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করার পর ভয়ে দিন কাটছিল। ভয়ে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিলাম। পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। সন্তানকেও দেখতে পারিনি। কিন্তু স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা আমাদের ভাই ব্রাদার। তারাই আমাকে আবার এলাকায় নিয়ে এসেছেন। তারা বলেছেন, আপনি আমাদের ভাই। এলাকায় থাকেন। আপনাকে কেউ কিছু বলবে না। এরপর গত ৫ দিন আগে এলাকায় এসেছি। তবে ঘরে থাকি না এখনও। আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে আছি। স্থানীয় বিএনপি নেতাদের কোনো টাকা পয়সা দিতে হয়েছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কিছু পেতে হলে কিছু তো দিতে হয়। আমাকে তারা এলাকায় থাকার সুযোগ দিয়েছেন, এটা তো কম কিছু নয়। মাঝেমধ্যে গিয়ে সন্তানদের দেখে আসি।
গাজীপুর জেলাতেও একই রকম কয়েকটি ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। গাজীপুর মহানগরে যুবলীগের এক নেতার বিএনপিতে যোগ দেওয়া নিয়ে সমালোচনা চলছে। সামাজিক মাধ্যমে তার বেশকিছু ছবি ভাইরাল হয়েছে, যেখানে ওই নেতাকে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিতে দেখা গেছে। জানা গেছে, সম্প্রতি তিনি একটি ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের হাত ধরে বিএনপিতে ভিড়ছেন। যদিও ওই ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি সামাজিক মাধ্যমে এমন ঘটনার সমালোচনা করেছেন। অভিযোগের জবাবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সময়ের আলোকে বলেন, ঘটনা হলো কয়েক দিন আগে হঠাৎ এক রাতে শখানেক কর্মীসমর্থক নিয়ে আমার বাসায় আসেন ওই নেতা। আমাকে বিভিন্ন প্রমাণ দিয়ে বলেন তারা সবাই বিএনপির কর্মীসমর্থক। কিন্তু নানা কারণে তারা সক্রিয় থাকতে পারেননি। শেখ হাসিনা সরকারের সময় নানা হয়রানি ও জুলুমের শিকার হয়েছেন। আমি পরে খোঁজখবর নিয়েছি। বিএনপি করত, তবে সক্রিয় ছিল না। এখানে টাকা পয়সা লেনদেনের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক উপমন্ত্রী এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেছেন, যেসব হাইব্রিড নেতাকর্মী গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ করেছেন, তাদের যদি বিএনপির উপজেলা, ইউনিয়ন বা ওর্য়াড পর্যায়ের কোনো নেতা আবার বিএনপিতে ফিরিয়ে নিয়ে আসে তা হলে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শামসুজ্জামান দুদু সময়ের আলোকে বলেন, ১৬ বছর ধরে বিএনপি নেতাকর্মীরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। এর মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন হয়েছে। হাসিনা দেশ থেকে পালানোর পর এখন আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মী নিখোঁজ, আত্মগোপনে কিংবা দেশত্যাগ করেছেন। তাদেরকে পুনর্বাসন করার কোনো সুযোগ নেই। কেন্দ্র থেকে নিষেধাজ্ঞা আছে। আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান উপর্যুক্ত নির্দেশ দিয়েছেন। তবে অনেক জায়গায় বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।
সময়ের আলো/আরএস/